সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ – ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষার জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বাংলা ভাষায় এই ভারতীয় সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তার কবিতার বহু পঙ্ক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক”, “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুরের ডাসার উপজেলায়। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন এবং ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১#
মেয়েরা এখনও অসভ্য বর্বর পুরুষদেরই পছন্দ করে। কোনও ছেলের এক্সসারসাইজ করা মাসল ফোলানো চেহারা দেখলেই মেয়েরা বলে, কী সুন্দর চেহারা!
~ সরল সত্য উপন্যাস থেকে
২#
কোনও একটা বিষয় সম্পর্কে খুব কম জেনেও বাঙালি অনেকক্ষণ আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। এটা বাঙালি চরিত্রের একটা বিশেষত্ব।
৩#
আমাদের দেশে কোনও হদ্দ গরিবের বংশে বেশি ছেলেপুলে হলে তাদের মধ্যে একজনও ম্যাক্সিম গোর্কি কিংবা আব্ৰাহাম লিংকন হয় না। সব হয় চায়ের দোকানের বয় কিংবা বাজারের তরকারিওয়ালা কিংবা চোর-ডাকাত।
~ (তুমি কে? উপ্যান থেকে)
৪#
পাশের বাড়ির সেই মেয়েটি যদি গল্প পড়তে ভালো না বেসে ক্রিকেট খেলা ভালোবাসতো, তবে আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না হয়ে সুনীল গাভাস্কার হতাম!
৫#
অন্ধকার শশ্বানে ভীরু ভয় পায়
সাধক সেখানে সিদ্ধি লাভ করে
৬#
আত্মগোপন করতে গিয়ে কিছুদিন পর অনেকে আত্মপরিচয়টাই ভুলে যায়।
~ পূর্ব পশ্চিম
৭#
কৃতজ্ঞতা একটা বিষম বোঝা। অনেকেই সারাজীবন এ বোঝা বহনে অক্ষম। তাই এই বোঝা ঝেড়ে ফেলে উপকারী ব্যক্তির শত্রুতা করে তারা স্বস্তি বোধ করে।
~ সেই সময় উপন্যাস থেকে
৮#
বাঙালিরা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করে, ধর্মসংস্কারের ব্যাপারে কেউ কিছু বললেই গেল গেল রব তোলে, কিন্তু এই বাঙ্গালিরাই ব্যক্তি জীবনে ধর্মের প্রায় কোন নির্দেশই মানে না। সততা, পবিত্রতা, সেবা এই সব ব্যাপারে তারা প্রায় অধার্মিক। বাঙালিরা খুব পরের সমালোচনা করে, পরনিন্দা করে কিন্তু আত্মসমালোচনা করে না। বাইরে খুব উদার মত প্রচার করে, নিজের পরিবারের মধ্যে অতি রক্ষনশীল। খবরের কাগজে তর্জন গর্জন দেখলে মনে হবে খুব সাহসী, আসলে অত্যন্ত ভীরু।
~ প্রথম আলো উপন্যাস থেকে
৯#
মানুষই মানুষকে বাঁচায়, মানুষই মানুষকে মারে। মানুষই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, আবার মানুষই এই বিভেদের রেখা মুছে ফেলতেও পারে।
~ প্রথম আলো উপন্যাস থেকে
১০#
ঘটনার চেয়ে রটনার রূপ অনেক বেশী বিচিত্র এবং গতিবেগও প্রচন্ড।
~ উপন্যাস সেই সময়
১১#
ইংরেজের এই ন্যায়বিচারের প্রতীক ঐ সুপ্রিম কোর্টের চূড়া। লোকে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ভক্তিভরে সেদিকে তাকায়। এখনো কেউ জানে না যে বিচার ব্যাবস্থার এই আড়ম্বর ইংরেজ জাতির একটি বিলাসিতা মাত্র। প্রয়োজনের সময় এইসব বিলাসিতা ছেঁটে ফেলতে তারা একটুও দ্বিধা করে না।
~ সেই সময় উপন্যাস থেকে
১২#
প্রেমিকরা কখনও অভিজ্ঞ হয় না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রেমিক হতে পারে না।
১৩#
আমার দৃঢ় ধারণা ওর ভগবান ওকে সেই অনুমতি দেবেন না। এই সব ভগবান টগবানেরা অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ হয়।
১৪#
লুকিয়ে রেখো না কোনো গোপন সিন্দুকে কিংবা লিখো না দলিলে
না দিলে থাকে না কিছু, ভালোবাসা ডুবে যায় স্বখাত সলিলে!
১৫#
আগের জন্মে ছিলাম আমি ছপটিওয়ালা
এই জন্মে ঘোড়া
নিজের পিঠে চাবুক মেরে ছুটছি, আমার
ভ্রমণ বিশ্বজোড়া!
১৬#
মানুষ যা গড়তে পারে না, তা ভাঙে কেন?
১৭#
যারা প্রথম কোনও সংস্কার ভাঙে, তাদের অনেক নিন্দাও সহ্য করতে হয়। যারা নতুন কোনও পথ দেখায়, তাদের তৈরি থাকতে হয় পথের অনেক বাধার জন্য। যারা মুক্তি অভিলাষী, তাদের খুলতে হয় অনেক বন্ধ দ্বার। আবার এ কথাও ঠিক, যারা পথিকৃৎ, তারা অত্যুৎসাহে কিছুটা বাড়াবাড়িও করে ফেলে, অনেক সময় তাদের স্বাধীন চেতনা ঔদ্ধত্যের মতন মনে হয়, প্রকট নতুনত্ব মনে হয় দৃষ্টিকটু।
১৮#
অভিমান হল হৃদয়ের অতি গোপন প্রকোষ্ঠের ব্যাপার। যে কেউ সেখানে হাত ছোঁয়াতে পারেনা।
১৯#
বিশ্বাসে-শ্রদ্ধায়-ভক্তিতে কেউ যখন নিমগ্ন থাকে তখন তাকে দেখতে বড় ভালো লাগে। চোখ বুজে কেউ ধ্যান করছে,এই দৃশ্যটা দেখলে আমার এখনও শ্রদ্ধা হয়, সে যারই ধ্যান করুক না কেন।
২০#
কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট যাদের পায়ের তলায় আছি, তাদের মাথায় চড়ে বসি কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতই ইচ্ছে করে অবহেলায় ধর্মতলায় দিন দুপুরে পথের মধ্যে হিসি করি।
২১#
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুনা বলেছিল, যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
২২#
প্রতি সন্ধ্যেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।
২৩#
স্তব্ধ আঁধারে কিছুই যায় না দেখা হে আকাশ তবু ঊষার হৃদয় জ্বালো কোথায় গেল সে দৃষ্টি-পাগল একা খুঁজতে সে কোন আঁধার পারের আলো।
২৪#
সাহিত্য একটা তীব্র নেশা, রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, যাকে একবার এই নেশা ধরে, তার আর অন্য কোনো গতি থাকে না। আবার এ কথাও হয়তো ঠিক, অনেক লেখুই এক এক সময় এই নেশা থেকে মুক্তি পেতে চায়! সাহিত্য সৃষ্টিতে খ্যাতি-কীর্তি-অর্থের সম্ভাবনা আছে বটে, কিন্তু তার জন্য লেখককে ভেতরে ভেতরে কত কষ্ট যে সহ্য করতে হয়! এক একসময় রক্ত ক্ষরণের মধ্যে মিশে যায় শব্দের বিষ, তা অন্যদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়
২৫#
কারোর আসার কথা ছিল না কেউ আসেনি তবু কেন মন খারাপ হয়?
২৬#
আমাকে বিক্রির টাকা হক্কের টাকা আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা।
২৭#
ইচ্ছে করে অফিস যাবার নাম করে যাই বেলুড় মঠে ইচ্ছে করে ধর্মাধর্ম নিলাম করি মুর্গীহাটায় বেলুন কিনি বেলুন ফাটাই, কাঁচের চুড়ি দেখলে ভাঙি ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি আমরা কিছু ভাল্লাগে না।
২৮#
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড় বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম! তবুও কথা রাখেনি বরুনা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ এখনো সে যে-কোনো নারী!
২৯#
ইচ্ছে করে দুপুর রোদে ব্লাক আউটের হুকুম দেবার ইচ্ছে করে বিবৃতি দিই ভাঁওতা মেলে জনসেবার ইচ্ছে করে ভাঁওতাবাজ নেতার মুখে চুনকালি দিই।
৩০#
দুঃখই কবিতার জননী।
৩১#
মেয়েরা এক এক সময় মুখে যা বলে, মনের কথাটা হয় ঠিক তার উল্টো।
৩২#
শরীরের তো পাপ-পুণ্য নেই। সবকিছুই মনের।
৩৩#
পুরুষের চোখে কোনো কোনো নারী চিরন্তন প্রেমিকা হয়েই থাকে।
৩৪#
দেশাত্মবোধের অপর নাম ঘৃণা।
৩৫#
বড় কোনো শোক পেলে মানুষের বয়স বেড়ে যায়।
৩৬#
পুরুষ সম্মুখ যুদ্ধে বিশ্বাস করে, কিন্তু স্ত্রী জাতির রণনীতি সম্পূর্ণ পরোক্ষ।
৩৭#
দুনিয়ায় যাদের টাকা আছে, তারাই টাকা পয়সা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়।
৩৮#
সুখ হল শিশির এর বুকে ভোরের নরম আলো ,
আলো যতক্ষণ ততক্ষণই তার আয়ু।
৩৯#
মানুষ এর মন হল সমুদ্রের বালুচর এর মতো ,
কালের ঢেউ এসে সব ধুইয়ে মুছে নিয়ে যায়।
৪০#
কৃতজ্ঞতা একটা বিষম বোঝা। অনেকেই সারাজীবন এ বোঝা বহনে অক্ষম। তাই এই বোঝা ঝেড়ে ফেলে উপকারী ব্যক্তির শত্রুতা করে তারা স্বস্তি বোধ করে।