মাধুকরী বুদ্ধদেব গুহ’র লেখা একরি বিখ্যাত উপন্যাস। মাধুকরী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। সেই সময়ে বসেই লেখক লিখেছেন একবিংশ শতাব্দীর জীবনচিত্র ও মানুষের মানোভাব। ফুটিয়ে তুলেছেন একবিংশ শতাব্দীর সামাজিক প্রেক্ষায়পট “মাধুকরী” তে।
১#
দেখাশোনা তো দিনভরই চলে, জীবনভর চলে ; জন্ম থেকে মৃত্যু, কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যে মনের মানুষ থাকে কজন? চোখ তো কতই দেখে সকলকেই কি মনে ধরে? সারাজীবন হয়তো একজন কি দুজনকেই তেমন করে চায় মানুষ! আর যাকে বা যাদের সে চোখের চাওয়া নয়, মনের চাওয়া চায়; তারাই তো হচ্ছে মনের মানুষ!
২#
বনের লোকের মনে গভীরতা থাকে। বনেরই মনের মতো। বেশি কথা ভালোবাসে না তারা। বাচালতা, শহরেরই রোগ।
৩#
প্রতিযোগিতা জীবনের সব ক্ষেত্রেই। দিনের প্রতি সময়েই। যে যোদ্ধার সঙ্গে লড়বে যখন, ঠিক তারই মতো, তারই সমতলে, উচ্চতায় বা নিম্নতায় উঠে গিয়ে বা নেমে এসেই লড়বে।
৪#
ভেঙে যাবে, গুঁড়িয়ে যাবে জেনেও তবু পৃথিবীর সব পুরুষ, নারীর হাতে তার হৃদয় তুলে দেয় বারে বারে। বনলতা সেনদের তবুও খুঁজে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
৫#
দুঃখী মানুষের চোখের চেহারাটা আমি চিনি। তাদের দুঃখটা চোখের তলায় থাকে না। চোখের এক্কেবারে মণির মধ্যেই বাসা বেঁধে থাকে, ঝিনুকের মধ্যের মুক্তোর মতো।…দুঃখ নিয়ে দুঃখ করে তো একমাত্র বোকারাই।
৬#
যাওয়া মানেই তো আসা, আর আসা মানেই যাওয়া। যেমন ভাবে যে দেখে।
৭#
সব আরম্ভই বোধহয় শেষে পৌঁছে আবার আরম্ভেই ফিরে যায়। এবং আরম্ভে পৌঁছে আবারও শেষে।
৮#
কাউকে সম্পূর্ণতায় পেতে চাওয়ার ভাবনাটাই হয়তো ভূল। একান্ত করে আজকার মানুষ কেউই কাউকে নিতে বা দিতে পারে না, নিজেদের টুকরো করে টুকরো টাকরাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে বার-চকলেটের মতো তুলে দেয় বোধহয়, একে অপরের হাতে।
৯#
ভুলে যাওয়াই ভালো। ভুলে না যেতে পারলে কি মানুষ বাঁচে? এই অকৃতজ্ঞতার, কৃতঘ্নতার পৃথিবীতে সব কিছুই মনে রাখতে গেলে মনের মধ্যে এক বিরাট ক্যানসারাস গ্ৰোথ হয়ে উঠবে যে কুৎসিত, তারপর সেই দলা পাকানো ভীতিজনক স্মৃতি নিঃশব্দে ফেটে যাবে একসময় মস্তিষ্ক খান খান করে দিয়ে।
১০#
যা হারিয়ে যাবার, তাকে আগলে বসে থাকা সম্ভবও নয় বেশিদিন।
১১#
বেশিরভাগ স্বামী স্ত্রীর ভালবাসাটা এমনই। একটা অভ্যেস। ছেলেমেয়েরা এসে যাবার পর স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টা একটা অন্য ডাইমেনশান পায়। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, আলগা হয়ে যায় হয়তো। আবার গভীরও হয়, ছেলে মেয়েদের জন্যই। মনে করো, কী বলব, ধরো ছিঁড়ে যাওয়া বাথরুম স্লিপারের মতো। ছিঁড়ে গেলেও ছেড়ে যাওয়া, ফেলে দেওয়া বড়ই কঠিন।
১২#
তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি। কীভাবে এবং কোন পথে তুমি খুশি হচ্ছো, তো আমার জানার দরকার পর্যন্ত নেই। খুশি থাকো গো। সবাই খুশি থাকুক। খুশিতে ভরে উঠুক এই খুশিহীন পৃথিবী। আনন্দম। আনন্দম। আনন্দম। দুদিনের এই জীবন। এসেই তো চলে যাওয়া। নিয়ে দিয়ে, দিয়ে নিয়ে ভরপুর করে রেখে সুধন্য করো সকলে, একে অন্যকে।
১৩#
একটাই জীবন। শুধুমাত্র একটা। অথচ এই আমাদের নিয়তি। এই কালে, এ সমাজে আমরা কেউ বেঁচে থাকি না, আমরা বাঁচতে জানি না। সংস্কার, লোকভয় আর অভ্যাসের দাসত্বই করি শুধু আমরা। প্রেমকে খুন করে তার রক্ত ছেনে অপত্যস্নেহের পুতুলদের নিয়ে পুতুলের ঘর করি। শুধুই প্রশ্বাস নিই আর নিঃশ্বাস ফেলি।
১৪#
মানুষ হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে এ সংসারে, তখন সারা জীবন কতো অসংখ্য ঘুড়িই যে কেটে যাবে ওর চোখের সামনে। কত সুন্দর স্বপ্নের সব ঘুড়ি, সাধের ঘুড়ি, প্রেমের ঘুড়ি, হয়তো সততা এবং বিশ্বস্ততার ঘুড়িও। কোনো ঘুড়ির সুতো থাকবে তার নিজের হাতে, কোনটায় নিজে মাঞ্জা দেবে কিন্তু প্রায়ই সবসময় অপরপক্ষের ক্ষূরধার মাঞ্জার ভার এবং ধারে কচ্ করে কেটে যাবে তার সব ঘুড়ি।
১৫#
একা একা যেকোনও দৌড়েই যে প্রথম হয়, সে একাই আগে থাকে। তার সামনে বা পাশে কেউই নয়।
১৬#
জোরে ছুটে গেলেও অনেক সময় একপাও এগোনো যায় না। আবার এক জায়গায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও ইচ্ছে করলে অনেক দূরে চলে যাওয়া যায় হয়তো।”
১৭#
যে ভালবাসা ফ্রিজে ঢুকে যায়, তা আর গরম হয় না কখনও।
১৮#
যে মরতে চায়, মৃত্যু তাকে ছোঁয় না। যে বাঁচতে চায়, মৃত্যু বাঘের মতো তারই ঘাড়ে এসে পড়ে।”
১৯#
ভালোবাসা তো ব্যবসা নয়। দেনা-পাওনার ব্যাপার নয়। একজনের সঙ্গে অন্যজনের হঠাৎই হয়ে যায়।
২০#
শরীরের ভালোবাসার ভয় নেই, ভয় মনের ভালোবাসায়।
২১#
কেউই যেন কাউকে ভালো না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। যাকিছুই সে মানুষটি দীর্ঘদিনের চেষ্টা, পরিশ্রম, মননশীলতা দিয়ে গড়ে তুলেছিল, যাকিছু ছিল তার গর্বর, পরিচয়ের, শ্লাঘার, তার সবকিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। যাকে ভালোবাসে তাকে নইলে তার আমিত্বই অনস্তিত্বে পৌঁছোয়।
২২#
যার বিবেক বেঁচে থাকে, তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক, বিবশ হলেই বাঁচি।
২৩#
ভালোবাসা বড়ই অপরাধের। যে বেসেছে, সেই জানে।… ভালোবাসার মতো অসুখ কি আর আছে?
২৪#
পুরুষ ও নারী যখন নীরবে থাকে তখনই তাদের সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। মনের গন্ধ, ম্যাগনোলিয়া গ্ৰান্ডিফ্লোরা ফুলের গন্ধের মতো ওড়ে শুধু তখনই।
২৫#
জীবনটা বাঁচবার জন্য, প্রতি মুহূর্ত পস্তাবার জন্য নয়।
২৬#
কেই-ই বা কাকে চেনে বলো? এই ছোট্ট জীবনে! চিনি চিনি বলে মনে হয়, সত্যিই কি চেনা যায়? আমরা নিজেরাই কি চিনি নিজেদের?
২৭#
আমি ওকে ভালোবাসতাম কিনা কখনও তো যাচাই করে দেখার অবকাশও হয়নি। মানে, আমার দিক থেকে। যখন হলো, এই দুঃসময়ে তখন মহা দুশ্চিন্তাতেই পড়লাম। এখনও বুঝে উঠতে পারছিনা অভ্যেসটাকেই ভালোবাসা বলে ভুল করেছি কি এতোদিন?
২৮#
যাকে মানুষ ভালোবাসে, তার কাছ থেকে কোনও সাহায্য নিলে সে ভালোবাসা নোংরা হয়ে যায়। বিচ্ছিরি দেনা পাওনার বিষয় হয়, সুন্দর আর থাকে না।
২৯#
কেই বা কাকে বোঝে বলো? বোঝা কি অতো সোজা?… বোঝাটা হয়তো বড়ো কথা নয়, বোঝবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। বুঝতে চাইলে একদিন নিশ্চয়ই বুঝবে।
৩০#
সব অভাব কেউই পূরণ করতে পারে না কারও। কিছু হয়তো পারে, যেখানে ঘাটতি থাকে।
৩১#
বাবা, মা, বংশ পরিচয় এসব কিছুই নয়। প্রত্যেক মানুষকে, মানুষ হয়ে উঠতে হলে, তার পরিচয় তৈরি করে নিতে হয়। তার জন্য দাম যা লাগে লাগুক, বিনামূল্যে এ জীবনে কি আর মেলে বল?
৩২#
কার ভালোবাসার প্রকাশ যে কেমন, তা ভালোবাসার প্রকাশের সময় না এলে বোঝা যায় না বোধহয়।
৩৩#
জীবনে, কটা কথাই বা রাখা যায়? মিথ্যার বেসাতির আর এক নামই তো জীবন। তবু আশ্চর্য। কথা দিতে হয় কতজনকেই কতবার। আর কথা দিলেই যদি কেউ খুশী হয়, তাহলে না দিয়েই বা কি করা যায়? ভবিষ্যতের দুঃখের কথা ভেবে আজকের খুশী নষ্ট করার তো মানে নেই কোনও।
৩৪#
দেখাশোনা তো দিনভরই চলে, জীবনভর, জন্ম থেকে মৃত্যু, কিন্তু সেই ভীড়ের মধ্যে মনের মানুষ থাকে কজন? চোখ তো কতই দেখে। সকলকেই কি মনে ধরে? সারাজীবনে হয়তো একজন কি দুজনকেই তেমন করে চায় মানুষ। আর যাকে বা যাদের সে চোখে চাওয়া হয়, মনের চাওয়া চায়, তারাই তো হচ্ছে মনের মানুষ।
৩৫#
এই পৃথিবীতে বড় বেশি অপ্রয়োজনীয় কথা হয়। চিরদিনই হয়ে এসেছে। যে যতক্ষণ পারে চুপ করে থাকাই তো ভালো। মুখ চুপ করলে তো আর মস্তিষ্ক চুপ করে থাকে না। আগুন জ্বালায় শরীরকে, আর চিন্তা মনকে।
৩৬#
একজন স্বামীর, একজন বাবার, তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে ছাড়া কোনও অস্তিত্ব নেই।সে যত তালেবর পুরুষই হোক না কেন?… ছেড়ে যাওয়া যায়, যে কোনো সময়ই, দম্ভ ভরে, কিন্তু সময়ের মধ্যে না ফিরলে ঘর আর ঘর থাকে না। সব পাওয়াই তখন মিথ্যে হয়ে যায়।
৩৭#
সময় বড় সাংঘাতিক। সময়ে সময় না রাখলে, সময় পায়ে দলে চলে যায়।
৩৮#
এই ছোট্ট জীবনে যদি সুখী হতে চাও নিজের চেনা জানা বন্ধুত্বের জগতেও ছোট করে রেখো। যারা তোমার কাছের মানুষ হবে, তাদের সাথে সম্পর্ক গভীর করো। পাঁচশো জন পরিচিত মানুষের চেয়ে পাঁচ জন কাছের মানুষ অনেকই বেশী দামী।…একসটেনসিভ রিলেশানশিপের চেয়ে ইনটেনসিভ রিলেশানশিপ অনেক জরুরী।
৩৯#
মন যখন মন থেকে সরে যায় তখন আদালতে গিয়ে সরে যাওয়া মনকে ফিরিয়ে আনার দরবার করা, কি আইনের চোখে অন্যকে শিক্ষা দেওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না।
৪০#
যারা কাউকেই ঠকায় না কখনও, তারাই সবচেয়ে বেশি ঠকে যায় এখানে। আশ্চর্য নিয়ম, তাই না?
৪০#
ফুলের গন্ধর মতোই ভালো মানুষের মনের গন্ধও আপনিই ছড়িয়ে যায় অন্য মানুষের মনে।
৪১#
যে কোন মানুষেরই বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা তার নিজেকে। নিজেকে নিজে একটু সময় না দিলে, ভালো না বাসলে, দিনান্তে আয়নার সামনে একবারও না দাঁড়িয়ে ভালোবেসে নিজের মুখের দিকে না চাইলে তার অন্যর বা অন্যদের জন্যে প্রাণাতিপাত পরিশ্রম করার মানে হয়না কোনও। আসলে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধহয় সে নিজেই কেন্দ্রবিন্দু। সে আছে, তাইই তার চারধার ঘিরে অন্যান্য সব সম্পর্ক আছে।
৪২#
সুখ মনে করলেই সুখ। সুখকে তো আর হাত দিয়ে ছোঁওয়া যায় না। মনেরই একটা অবস্থামাত্র তা। মনকে সুখী সুখী ভাব করতে বললেই মন সুখী হয়।
৪৩#
সব হওয়ারই সময় থাকে, সময় পেরিয়ে গেলে, হয় না আর কিছুই।
৪৪#
জীবনে যা কিছুই ঘটে, সব কিছুর পেছনেই মানে থাকে, তাৎপর্য থাকে। আমরা অন্ধ, তাই দেখতে পাই না।
৪৫#
পরিবর্তন, সবসময়েই যে বেশি সুখের তা নয়। কিন্তু পরিবর্তনের একটি নিজস্ব মূল্য আছে। পুরনোকে সে নতুন করে তোলে।
৪৬#
দুঃখ যা পাবার তা আমরা নিজেরাই নিজেদের দিই, অন্যকে দায়ী করি মিছিমিছি, নিজেরা ভীরু ও অসৎ বলে। ভণ্ড বলে।
৪৭#
চুরি করে ভালো না বাসলে বোধহয় ভালোবাসাটা আর ভালোবাসা থাকে না। পরকীয়া প্রেম বা অনাঘ্রাত প্রেম হচ্ছে চাঁদের আলো, আর বিবাহিত প্রেম বা খোলামেলা বাধাহীন শরীরী সম্পর্ক বোধহয় সূর্যালোক। প্রখর সূর্যতাপে, ধূলোয়, আওয়াজে ভালোবাসার ফুল বোধহয় শুকিয়েই যায়।
৪৮#
যে ধরে রাখতে না জানে, তার কিছুমাত্রই পাওয়ার অধিকার নেই এ সংসারে।
৪৯#
মানুষের জীবনের প্রকৃতিও হয়তো হাওয়ারই মতো, জলেরই মতো সীমানা মধ্যবর্তী কোনও এলাকায় শূণ্যতার সৃষ্টি হলে স্বাভাবিক নিয়মে পারিপার্শ্ব থেকে সেই শূণ্যতা পূরণ করতে ছুটে আসে। আশেপাশের চেনাজানা মানুষও তেমনই আসে ছুটে।
৫০#
একটাই জীবন। সকলেরই নিজের নিজের মতো করে সুখী হবার অধিকার আছে। যে না হতে পারল, সে অভাগা।
৫১#
সাংঘাতিক রাস্তা দিয়ে একদম একা একাই যেতে হয় সকলকে।…পথ না পেরোলে তো গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। জীবনের কোনো গন্তব্যেই।
৫২#
মানুষের পয়সা যে অনুপাতে বাড়তে থাকে ঠিক সেই অনুপাতেই তার জীবনের মায়াও বাড়তে থাকে। যাদের পয়সা কম তাদের জীবনের মায়াও কম।
৫৩#
মানুষ যারা ভাল, সৎ, তারা আন্যের চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলতে পারে না।… ভালোমানুষদের বড়ই কষ্ট, এই খারাপ মানুষে ভরা পৃথিবীতে।
৫৪#
ইচ্ছা পূরণের আনন্দের তীব্রতার চেয়েও অনেক সময় অপূর্ণ ইচ্ছার নিবিড় আনন্দ তীব্রতর হয়।
৫৫#
নিজের সন্তানের গায়ের গন্ধর মতো মিষ্টি গন্ধ পৃথিবীর কোনও মহার্ঘতম পারফ্যুমেও নেই। শুধুমাত্র বাবা মায়েরাই সে গন্ধর কথা জানেন।
৫৬#
প্রত্যেক সাধারণ পুরুষ ও নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশুর হৃদয়ের এবং শরীরের দোরে দোরে হাত পেতে, ঘুরে ঘুরেই বেঁচে থাকতে হয়। প্রীতি, প্রেম, কাম, অপত্য, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, বৈরিতা, ক্রোধ, সমবেদনা এবং এমনকি ঔদাসীন্যরও বোধগুলিকে দেওয়ালির রাতের অসংখ্য প্রদীপের কম্পমান শিখারই মতো অনুভূতির দ্বিধাগ্ৰস্ত আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জীবনকে পরিক্রম করে যেতে হয়। এই পরিক্রমারই আরেক নামই কি মাধুকরী?
৫৭#
প্রকৃতির মধ্যেই বোধ হয় সমস্ত প্রাণীর প্রকৃত মুক্তি নিহিত আছে।
৫৮#
চোখ কান খুলে রাখলেই কত কী শেখে মানুষ। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি প্রত্যেকটি মানুষই শেখে। প্রতি মুহূর্ত। এই শিক্ষা মানে, কোনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নয়; ভেতরের শিক্ষা। বাইরে থেকে আমরা কিছু নিই, আর বেশিটাই বোধ হয় নিই তৈরি করে, নিজেদেরই ভেতর থেকে।
৫৯#
পুবে সবে আলো ফুটেছে। পূবের পাহাড়টার জন্যে আলো পৌঁছতে একটু দেরি হয় উপত্যকাতে। আলো এসে পৌঁছতেই ভোঁর ঘাসের মাঠের উপর রাতভর জমা শিশিরে লক্ষ লক্ষ হীরে ঝিকমিক করে। লাল সাদা ফুল এসেছে ঘাসগুলোতে। ঘাসের মাঠের আঁচল ঘিরে ধরা বা চোরকাঁটার বর্ডার। তারপরই গহীন জঙ্গল।
চারদিকে সাজা, শাল, ধাওয়া, বহে, কাসসী কুহমী, বেল, চাঁর, জামুন, পলাশ ইত্যাদি নানা গাছগাছালি। শালই বেশি। সোজা, সবুজের পতাকার মতো উঠে গেছে নীল অকলঙ্ক আকাশে। সাজা গাছের আর এক নাম সাজ। গোঁদ-বায়গারা পুজো করে ওই গাছ। শালকে, যেমন করে ওঁরাও-সাঁওতালরা। ধাওয়া হচ্ছে গদ-এর গাছ। আঠা হয় এ গাছ থেকে। বহেড়া গাছগুলো বিরাট বিরাট। শখ করে খায় হরিণ ওদের ফল। কাসসী গাছের কদর গরুর গাড়ির চাকা বানাতে। বড় শক্ত কাঠ এ। কুহমি অনেকটা বেলের মতো। চাঁর গাছও মস্ত মস্ত হয়। চমৎকার ছায়া দেয় এ গাছ। চিরাঞ্জীদানাও বলে, অনেকে এর ফলকে। ফুল ফোটে সাদা সাদা মিষ্টি গন্ধর, ফাল্গুন চৈত্রে। চার-এর ফল ধরে বৈশাখের শেষে বা জ্যৈষ্ঠেতে। মিষ্টি ফল। জামুনও, বড় ও ছোট অনেক আছে হাটচান্দ্রার আশে পাশের জঙ্গলে। গরমের শেষে আষাঢ় শ্রাবণে পাকে। পলাশ। পলাশ গাছে গাছে গরমের শুরুতে ফুল যেমন লালে লাল করে দেয় দিগন্ত, তেমন সে গাছের গুটি পোকা থেকেই লাক্ষা সংগ্রহ করে আদিবাসী ছেলেমেয়েরা। কারখানায় নিয়ে যায়। মেটিরিয়াল ম্যানেজার শর্মা পা ছড়িয়ে বসে সওদা করতে করতে অনেক কিছু দেখে। কোকিলের মতো কালো ও মধুরকণ্ঠী মেয়েগুলো জানে যে, শমার চোখ দুটি অসভ্য। ওরা এও জানে যে, বেশির ভাগ পুরুষের চোখই অসভ্য।
৬০#
মাটি যখন অভিমান করে, তখন সে নারীর চেয়েও তখ অনেক বেশি অভিমানী।
৬১#
আসলে যে-কোনো মানুষেরই, বেঁচে থাকার জন্যে সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা তার নিজেকে। নিজেকে নিজে একটু সময় না দিলে, ভাল না বাসলে, দিনান্তে আয়নার সামনে একবারও না দাঁড়িয়ে ভালবেসে নিজের মুখের দিকে না চাইলে তার অন্যর বা অন্যদের জন্যে প্রাণাতিপাত পরিশ্রম করার মানে হয় না কোন। আসলে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধ হয় সে নিজেই কেন্দ্রবিন্দু। সে আছে, তাইই তার চারধার ঘিরে অন্যান্য সব সম্পর্ক আছে।
৬২#
জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতাতে একবার নেমে পড়লে নিজের আলাদা সত্তা, স্বকীয়তা একেবারেই মুছে দেবে।
৬৩#
পৃথু ঘোষ চেয়েছিল, বড় বাঘের মতো বাচঁবে। বড় বাঘের যেমন হতে হয় না কারও উপর নির্ভরশীল না নারী, না সংসার, না গৃহ, না সমাজ সেভাবেই বাচঁবে সে, স্বরাট, স্বয়ম্ভর হয়ে। তার বন্ধু ছিল তথাকথিত সমাজের অপাংতেয়রা। পৃথু ঘোষ বিশ্বাস করত, এই পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মের দিন সমাসন্ন। সে ধর্মে সমান মান-মর্যাদা এবং সুখ-স্বাধীনতা পাবে প্রতিটি নারী-পুরুষ।