এখন হাতে অনেক সময় , হয়তো তোমার হাতে অনেক সময় । কিছুটা সময় যদি থাকে !
বহি বিশ্বে মর্যাদার বিচারে তোমার কাছের লোক তাৎপর্যহীন। হয়তো এটাই জগতের নিয়ম। তোমার দোষ নেই , পৃথিবীর অনেক মহান মনীষী বা মহাপুরুষেরা মানবজাতির কল্যাণে এতটাই মগ্ন থেকে ছিলেন নিজের পরিবারের প্রতি অবিচার করেছিলেন , তুমিও তার দলের একজন।
এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বলতে পারো বীরসিংহ গ্রাম। শ্বশুরালয়ে কলকাতা থেকে অনেক দূরে নিঃসঙ্গ ঘরবন্দি করেছিলে । জানিনা , আমি তোমার কি না— দীনময়ী।
তোমার কোনো ভালোবাসা, আদর কিছুই পাইনি । নিঃসঙ্গ আমি এক বাসিন্দর চাপা যন্ত্রণা কুরে কুরে খেয়েছিল । দাম্পত্য জীবনের প্রথম স্বাদ কি ? বুকেচাপা কষ্টনিয়ে জীবন কেটে গিয়েছিল ।
বীরসিংহের পাশেই ক্ষীরপাই গ্রাম। সেই গ্রামেরই মেয়ে আমি পাঠশালায় পড়েতাম, বয়স মাত্র সাত বছর ছিল ।
যে বয়সে মেয়েরা পুতুল খেলে, বিয়ের মর্মার্থ কিছুই বোঝা না, সে বয়সে আমি লালরঙের শাড়ি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিলাম । স্বামী কী, শ্বশুরবাড়ি কী, সংসার কী, ঘরকন্না কী কিছুই বোঝার বয়স ছিলনা । শ্বশুরবাড়িতে লোকজনের ভিড়ে স্বামী নামক একজন আছেন সে বিষয় অনুভবই হয়নি। বিয়ের পর আমাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে তুমি ফিরে গেলেন কলকাতায়। স্ত্রীর কথা একপ্রকার ভুলেই গেছিলে ! তখন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে পঠনপাঠনে ব্যস্ত। বিয়ের পর অদ্ভুতভাবে লেখাপড়া এবং অন্যান্য কাজে মনোযোগ বাড়িয়ে ছিলে । সবদিক থেকে উন্নতি করেছিলে ।
শুধু তাই নয় ,কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে গ্রামে এসে গ্রামীণ বিভিন্ন কার্যকলাপে আসতে । আর আমি ঘরে অধীর আগ্রহে তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতাম , সেকথা তুমি বেমালুম ভুলে যেতে ।
একদিন হঠাৎ বাড়িতে এসেছিলে । কি বলবো যারপরনাই আনন্দে আত্মহারা ।
তোমার মনে পড়ছিল , সেই রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর পান সেজে তোমাকে দিয়েছিলাম । আর তুমি আমাকে বলেছিলে “পথে আসার সময় মনে হল সীতার বনবাস সম্পর্কে একটা বই লিখলে কেমন হয়।” তখনই কি তুমি বুঝেছিলে আমার অভিমান ? দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তোমাকে বলেছিলাম-
“কী বই?”
জবাবে বলেছিলে , “সীতার বনবাস।”
আমি তার উত্তরে বলেছিলাম , “তুমি সীতাকে বোঝো?”
তুমি বললেন, “কেন বুঝব না!”
দুঃখের বলেছিলাম , “পাড়ার চঞ্চলাকে আমার খুব হিংসে হয়।”
তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন , “সুন্দরী নাকি?”
আমি বলেছিলাম – “সুন্দরী নয় ঠিক তবে তার ভাগ্য ভালো। তার স্বামী তোমার মত বিখ্যাত নয়।” আমি বাধ্য হয়ে নিজেকে সীতার সঙ্গে একাত্ম করেছিলেন।
একটা কথা না বললেই নয় ,আমার বাবা (শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য) তোমার বাবাকে (ঠাকুরদাস মহাশয় )কে বিনীতভাবে বলেছিলেন— “বন্দ্যোপাধ্যায়! আপনার ধন দৌলত নেই, কেবল পুত্র বিদ্বান , এই কারণে আমার প্রাণসখা তনয়া দিনময়ীকে তোমার পুত্র-করে সমর্পণ করিলাম”।
ভেবে অবাক লেগেছিল ,কথায় আছে না ঘরামির ঘর ফুটো । দেখো নিজের স্ত্রীর প্রতি তুমি কেমন উদাসীন ছিলে ।
বিদ্যাসাগর – “ভুল বলছো , পড়াশোনার প্রতি অনীহা ছিল তোমার ।
আমি বলেছিলে -“এই বয়সে আর হবে না। অবশ্য মেয়েরাও লেখাপড়া এখন অবশ্য শিখছে।” ছোট বয়সে তোমার মতোন বিদ্যাসাগর থাকলে আমরাও পড়ার ইচ্ছে জন্মতো । “
তাইতো তুমি বলেছিলাম , “তুমিও শিখতে পারো। আমি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করছি বেশ কয়েকটি । তুমি পড়তে চাইলে ব্যবস্থা করে দেব।”
যাই হোক দীর্ঘ ১৫ বছর সংসার নামে এক অন্দরমহলে , কষ্টের দিন গুনেছি ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে । কপালে জুটে ছিল তুকতাক বুজরুকি অনেক কিছু —–। বিষন্ন চিত্তে খাদি ভেবেছি মা হবো কিনা। হঠাৎ প্রথম সন্তানের এলো ১৮৪৯ তে। নারায়ণের জন্মের পরেও আমাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক গাঢ় করার চেষ্টাও করনি । এমনকি হেমলতা, কুমুদিনী, বিনোদিনী ও শরৎকুমারী—এই চার কন্যার জন্মের পরেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছিলে ।
ইতিমধ্যে ছেলে যখন বড় হয়েছিল সালটা ১৮৭০ আগস্ট মাসের ১১ হবে । ষোলো বছরের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর সঙ্গে আমার পুত্রের (নারায়ণের) দিয়ে দিয়েছিলে ।একমাত্র পুত্রের বিবাহ শুভ সংবাদ জানার তো দূরের কথা ।অধিকার থেকে বঞ্চিত বঞ্চিত করেছিলে । তিন দিন পর দেওর শম্ভুচন্দ্রকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে ছিলে আমার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করোনি । হ্যাঁ আমি উপেক্ষিত দলেই ছিলাম ।
স্বীকার তো করতেই হবে, দেওর, শম্ভু চন্দ্র একটি চিঠিতে তুমি উল্লেখ করেছিলেন , “বিধবা বিবাহের উদ্যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছিলাম। এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারী-বিবাহ করলে আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারতাম না… নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই বিবাহ করে আমার মুখ উজ্জ্বল করে এবং লোকের কাছে আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবো তাহার পথ করিয়াছে।” নিন্দুকেরা যা-ই বলুক , বিধবা বিবাহ করে, বিধবা বিবাহের প্রবর্তক বলে পরিচিত তোমার মুখ উজ্জ্বল করেছিল । তুমি যাই বলো কু- পথগামী হলেও।
খানাকুল কৃষ্ণনগরের শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ১৪ বছর বয়সি বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর প্রেমেনাকি পড়েছিলেন ।
যুগের বিচারে বয়সের প্রথম সন্তানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন আপ্রাণ। সকল মাতাই কাতর থাকে, ছেলের জন্য অকাতরে দানের জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকেন। গোপনে পুত্রকে অর্থ সাহায্য করেছিলাম । এমনকি অলঙ্কার পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছিলাম । অতিরিক্ত স্নেহ তাই বোধহয় তোমার সঙ্গে পুত্রের দূরত্ব বাড়েছিল।
অবশ্য বিয়ের ৩৫ বছর পর তুমি অনুভব করেছিলেন যে, স্ত্রীর প্রাপ্য সঠিক মর্যাদা তুমি দাওনি । তার প্রমান আমাকে লেখা একটি চিঠিতে সে কথাই উল্লেখ করেছিলে । সেটা এইরকম – “আমার সাংসারিক সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হয়েছে… এক্ষণ তোমার কাছে এ জন্মের মতো বিদায় নিলাম … দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবে… তোমাদের ব্যয় নির্ব্বাহের যে ব্যবস্থা করে দিয়েছি, বিবেচনা করে চলেলে, তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে যাবতীয় বিষয় সম্পন্ন হতে পারবে।” “এক্ষণ তোমার কাছে এ জন্মের মতো বিদায় নিচ্ছি এবং বিনয়বাক্যে প্রার্থনা পড়ছি যদি কখনও কোনো দোষ বা অসন্তোষের কাজ করে থাকি, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবে।”
১৮৮৮ সাল, তোমার মনে আছে আমি অত্যন্ত অসুস্থ ,রোগশয্যায়। পুত্রকে দেখতে চেয়েছিলাম।শেষ অনুরোধ জানিয়ে ছিলাম পুত্রকে ক্ষমা করার জন্য। তুমি অনুমতি দাওনি শেষে একবার দেখার ।বড়ো অভিমানে অবিরাম বৃষ্টি রাতে আমি চলে গেলাম পরলোকে । বাড়িতে পাশে শেষে তোমায় পেয়েছিলাম।
দেশের কল্যাণে তোমার কাজকর্ম অনস্বীকার্য । নারী শিক্ষা প্রসারে, বাল্যবিবাহ বিরোধিতা , বিধবা বিবাহ আইন যুগান্তকারী রূপকার তুমি । তোমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখাছিল লেখা থাকবে। এই বঙ্গের নারী আজীবন তোমার কাছে ঋণী থাকবে । নারী যে মানুষের চেতনাময়ী, শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । সত্যি সত্যি শিক্ষারআলোয় নারীরা ভালোমন্দ বুঝে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল তোমারই জন্য । বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করে আমাদের মতন অভাগিনীর ঠাকুর ঘরে এবং মনেরও মন্দিরে এক নতুন ঈশ্বর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সেই অনির্বাণ শিখা দেখো আজও জ্বলছে ।
সমাপ্ত