You are currently viewing ব্ল্যাক প্লেগ: নারীদের জীবন-সংগ্রাম ও মৃত্যু

ব্ল্যাক প্লেগ: নারীদের জীবন-সংগ্রাম ও মৃত্যু

মানব ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যতগুলো মহামারী হয়েছে তারমধ্যে মধ্যযুগের ইউরোপের প্লেগ মহামারী ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ। এই মহামারীর আরেক নাম ব্ল্যাক ডেথ বা কালো মৃত্যু। শুধুমাত্র ১৩৪৭ সাল থেকে ১৩৫১ সালেই ইউরোপের ৯০ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে প্লেগের ভয়াল আক্রমণে যা তখনকার ইউরোপের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ। ১৩৪৭ সালে ইউরোপে প্লেগের পাদুর্ভাব দেখা দিলেও এটি একেবারের জন্য কখনো হারিয়ে যায় নি; মাঝেমাঝেই এই মহামারীর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ১৮০০ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছোট ছোট প্লেগ পাদুর্ভাব থেকে গিয়েছে।

ইউরোপে প্লেগ মহামারীর ফলে সেখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছিল। সেই সময়ের ইউরোপের নারীদের জীবনেও সেই মহামারীর প্রভাবও পছিল। কেমন ছিলো তখন নারীদের জীবন? কি কি সংকটের মুখোমুখি তারা হয়েছিলেন?  

প্লেগ মহামারীর সময়ে নারীদের জীবন ছিলো একই সাথে জটিল ও কঠিন। কট্টর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের বেশিরভাগই তখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মাধ্যমে তাদের জীবন কাটিয়েছেন। 

প্লেগ মহামারীতে বিশেষত বিবাহিত নারীদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। প্লেগ আক্রান্ত রোগীদের সেবা ও যত্নের দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হতো। অসুস্থদের খাওয়ানো, তাদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, কিংবা অসুস্থ ব্যক্তি মারা গেলে তাদের জন্য শোক পালন সবকিছুর দায়িত্ব এসে পড়তো বিবাহিত নারীদের ওপর। কখনো কখনো প্লেগ আক্রান্ত রোগীর সেবা করতে গিয়ে নারীরা নিজেরাই সংক্রমণের শিকার হয়ে মারা যেতেন।

Photo Courtesy : AEON NEWSLETTER

প্লেগের আক্রমণে কোনো নারীর স্বামী যদি মারা যেতেন। তাহলে সেই পরিবারের প্রধান হতেন সেই সদ্য বিধবা নারী। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানদের দায়িত্ব ও দেখভালের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের সকল দায়িত্ব এসে পড়তো সেই নারী কাধে। তবে সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী সেই সমস্যাগুলো বিভিন্ন রকম হতো। কোনো অভিজাত বা ধনী সম্প্রদায়ের কোনো নারী বিধবা হলে তিনি প্রচুর সম্পদের অধিকারী হতেন আর গরীব নারীদের ক্ষেত্রে সেই চিত্র ছিলো পুরোপুরি উল্টো। 

অনেক বিধবা নারীই স্বামীর মৃত্যুর পর নতুন করে বিয়ের কথা ভাবতেন। নতুন বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের সামাজিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হতো। এছাড়াও কোনো এলাকায় প্লেগের আক্রমণের ফলে সেখানে বিবাহোপযোগী পুরুষ খুঁজে পাওয়া ছিলো অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা। 

যেসব নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে স্বামীর সম্পত্তি ও আর্থিক বিষয়াদি পেতেন, তারা তাদের জীবন বেশ আরামেই কাটিয়ে দিতে পারতেন। তবে সদ্য বিধবা সেই নারীর যদি কেনো পুত্র সন্তান থাকতো, তাহলে সেই পুত্রসন্তান উত্তরাধিকার সূত্রে সেই সম্পত্তির মালিক হতো। 

নারীরা প্লেগ আক্রান্ত হলে পরিবার ও পুরুষদের থেকে তাদের সেবা ও যত্ন পাবার প্রবণতা ও চেষ্টা ছিলো খুবই কম। এমন অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, যে কোনো নারী সংক্রমিত হলে তাকে ছেড়ে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পালিয়ে গিয়েছে। তবে যে নারীদের ক্ষেত্রেও এমনটা হতো তা ভাবা ভুল। প্লেগ এতো দ্রুত সংক্রমিত হতো যে মানুষ প্রচন্ড আতঙ্কিত ছিলো। প্লেগ থেকে বাঁচতে সেসময় অনেকেই নিজেদের পরিবারের প্রিয় সদস্যদের মৃত্যুর কোলে রেখে পালিয়েছে। 

প্লেগ মহামারীর সময় একটা বহুল প্রচলিত কথা ছিলো যে,

“প্লেগের রোগীরা প্রাতরাশ করে পরিবারের লোকদের সঙ্গে আর রাতের খাবার খায় প্রেতলোকে।”

প্লেগ মহামারী যে কেবল নারীদের সংকট আর সমস্যার মধ্যেই ফেলেছে তা ভাবা পুরোপুরি ভুল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের জন্য নতুন পথ খুলে দিয়েছিল। বিশেষ করে প্লেগ মহামারীর ফলে নারীরা অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। নারীদের সবসময়ই অর্থনৈতিকভাবে তখন পুরুষদের উপর নির্ভরশীল ছিলো। কিন্তু প্লেগের মহামারীর ফলে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ঘটায় ইউরোপে তখন  শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। নারীরা তখন বিশেষ করে কৃষি, গৃহস্থালি কাজ, টেক্সটাইল শিল্প সহ বিভিন্ন কাজে নারীরা বেশি বেশি অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। তাছাড়া অনেক নারী তার মৃত স্বামীর ব্যবসার দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন। এতে করে নারীর ক্ষমতায়নের সূত্রপাত ঘটেছিলো।

বিবাহিত নারীদের মতো অবিবাহিত নারীদের জীবনও ছিলো সংকট, সংশ ও জটিলতার মধ্যে। বিবাহিত নারীদের মতো তাদের স্বামীর সুরক্ষা ছিলো না। অবিবাহিত নারীরা অর্থনৈতিক ভাবে পুরোপুরি তাদের পরিবারের উপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। আর তাই তাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষ সঙ্গী না জুটলে অর্থাৎ বিবাহ না হলে তাদের পরিবার ও সমাজের মানুষের কটুক্তি ও অবজ্ঞার শিকার হতে হতো।

তবে মহামারির পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় এলে অবিবাহিত নারীদের বিবাহ প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হয়ে উঠে। কারণ ইতিমধ্যে যেসব পুরুষ মহামারিতে তাদের স্ত্রীকে হারিয়েছেন, তাদের নতুন স্ত্রীর প্রয়েজন পরতো।

এছাড়াও অবিবাহিত নারীদের জীবনেও প্লেগ মহামারি অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। পুরুষ শ্রমিকদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ অবিবাহিত নারীই পুরুষদের পেশায় নিয়োজিত হতে শুরু করে। বিশেষত নার্সিং পেশায় অবিবাহিত নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো প্রচুর।

প্লেগ মহামারীর সময়ে তখনকার ইউরোপের নারী যৌনকর্মীদের জীবনেও পরিবর্তন এসেছিলো। এইসব নারীরা যদিও সমাজে সবসময় নিন্দা, অবহেলা ও ঘৃণিত হয়ে আসছে সবসময়। তবে কিছু কিছু মানুষ তাদের বলেন  ‘নেসেসারি এভিল’ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় পাপ। যখন প্লেগের বিস্তার ঘটে তখন প্লেগ রোগ বন্ধ করতে সকল যৌন পল্লী বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। ফলে যৌনকর্মীরা গ্রাহকের অভাবে অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায়। 

এছাড়াও এসকল নারীদের প্লেগ আক্রান্ত হবার ঝুঁকি ছিলো খুবই বেশি। যেহেতু তারা প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসতেন। ফলে বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগের পাশাপাশি তারা প্লেগ রোগেও সংক্রমিত হতেন।

প্লেগ মহামারীর ফলে ইউরোপে অদ্ভুত এক রীতির সৃষ্টি হয়। ইউরোপের চার্চের আদালত বিভিন্ন নারীদের ডাইনি অপবাদ দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করতে শুরু করে। মূলত ভয় ও কুসংস্কারের সংমিশ্রণে ইউরোপে এই নারকীয় কার্যকলাপের উদ্ভব ঘটেছিল।

ইউরোপে তখন প্লেগ মহামারী কে  ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হতো। ঈশ্বর শাস্তি দেওয়ার জন্য এই মহামারীর সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই পাপের দোষারোপের সহজ লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিলো নারীদের। যেসব নারীদের ডাইনি বলে অভিযুক্ত করা হতো তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো যে তারা যাদুবিদ্যা চর্চা করে এবং যাদুবিদ্যার মাধ্যমে তারা প্লেগ রোগ ছড়াচ্ছে। 

প্লেগের ভয়াবহতা দেখে ইউরোপের সাধারণ মানুষজন ধর্মীয় উম্মাদনায় ডুবে গিয়েছিলো। তাই চার্চের কথা তারা বিশ্বাস করে ডাইনি হত্যা কে তারা সমর্থন যোগাতো। 

নারীদের ডাইনি অপবাদ দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হতো। Image Courtesy : Reddit

যেসব নারীরা ডাইনি অভিযোগে হত্যার সম্মুখীন হতেন তাদের মধ্যে বয়সস্ক, নিঃসন্তান কিংবা একাকি বাস করা নারীরা বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে ছিলেন। এছাড়াও অনেক সম্পত্তির মালিক হওয়া নারীদের সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে তাদের বিরুদ্ধে ডাইনি অভিযোগ আনা হতো।

ডাইনি বলে যেসব নারীদের অভিযুক্ত করা হতো তাদের মধ্যে অনেক নারীই ভেষজ ঔষধি চিকিৎসায় পারদর্শী ছিলেন। আর এই বিষয়টিকে সেসময়কার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ভুলভাবে ব্যখা করে যাদুবিদ্যা চর্চা বলে প্রচার করো তাদেরকে হত্যা করেছিল। কাউকে জীবন্ত পুড়িয়ে, আবার কাউকে পানিতে ডুবিয়ে আবার কখনো গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হতো।

প্লেগ মহামারীর ফলে নারীরা যেমন বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলো। সেরকমভাবে কিছু সুবিধা ও পেয়েছিলো। তারমধ্যে নারীদের অর্থনৈতিক সংকটের মুক্তি। তবে প্লেগ মহামারী কমে গিয়ে জনসংখ্যা ধীর ধীরে পুনরুদ্ধার হতে শুরু করলে নারীদের অর্জিত সেসব সুযোগ সুবিধা আবারো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তা হ্রাস পেতে শুরু করে।

Featured Photo Credit: AEON NEWSLETTER

Leave a Reply