বিশ্বসভ্যতায় এক বিস্ময়কর নাম রোমান সভ্যতা। কিন্তু সেই গৌরবময় সভ্যতায় কেবল পুরুষেরই জয়জয়াকার। কিন্তু কেমন ছিল রোমান সভ্যতার নারীরা? কেমন ছিল তাদের জীবন? কীভাবে কাটত তাদের সময়? এসব প্রশ্নের কৌতুহল মিটবে আজকের এই আর্টিকেলে।
তৎকালীন রোমান সমাজটি ছিল পুরুষতান্ত্রিক আর তখনকার দিনে নারীদের ব্যক্তিগত বিবরণ লিখিত হত না। কাজেই, বৃহৎ রোমান সাম্রাজ্যের নারীদের জীবনের তথ্যাদি সুলভ নয়। আর এসব কারণেই প্রাচীন রোমের নারীদের জীবনযাপন ঠিক কেমন ছিল এ বিষয়ে অনুমানের আশ্রয় নিতে হয়।
তৎকালীন রোমান সমাজে শিক্ষার অধিকার ছিল কেবল অভিজাত শ্রেণির পুরুষদের। তারা তাদের অবসর সময়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতাই লিখত। মেয়েদের প্রসঙ্গ এলে আত্মীয়স্বজনের কথা লিখত-যারা ছিল রোমান অভিজাত শ্রেণীর। বলাবাহুল্য অভিজাত নারীরা রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র অংশ এবং অল্পবিস্তর হলেও এদের সম্বন্ধেই তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু দরিদ্র রোমান নারীদের সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া পাওয়ার কথাও না। তবে অভিজাত ও দরিদ্র নারী উভয়ের ভূমিকা আসলে একই। গীরব আর অভিজাত সকলেরই প্রধান ভূমিকা ছিলো অধিক পরিমানে সন্তান জন্মদান।
প্রাচীন রোমের অভিজাত মেয়েদের বিয়ে হত ১২ বছর বয়েসে। কখনও কখনও আর কম বয়েসে। যা বতমানে আধুনিক ইউরোপে কল্পনাও করা যায় যায় না। তৎকালে রোমানদের গড় আয়ূ ছিল খুবই কম, কুড়ি কিংবা বড় জোড় তিরিশ। যদিও সেসময়ে বৃদ্ধ বয়সেও অনেকে মারা যেতো। কিন্তু যুদ্ধ, বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু এছাড়া শিশু মৃত্যুর হার ছিলে ভয়াবহ রকমের। আর এসব কারনেই রোমানদের গড় আয়ু ছিলো খুবই কম।
সেসময় একজন রোমান নারীর জীবনধারা ছিল অনেকটা এরকম: বিয়ে হত কম বয়েসে, মৃত্যু হত সন্তান জন্ম দানের সময় অথবা অধিক সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়। ভেতুরিনা নামে এক নারীর সমাধিলিপিতে লেখা আছে: ভেতুরিনার ১১ বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল; সে ছিল ৬ সন্তানের জননী এবং তার মৃত্যু হয়েছিল ২৭ বছর বয়েসে। আয়ূর স্বল্পতার কারণে ক’জন শিশু বড় হবে বেঁচে থাকবে এটি নিশ্চিত ছিল না বলেই নারীকে গর্ভবতী হয়েই থাকতে হত। কর্লেনিয়া নামে এক অভিজাত রাজমাতার ছিল ১২টি সন্তান । অবশ্য মাত্র দুই ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে ছিল কর্লেনিয়ার।
অভিজাত পরিবারগুলি পুত্রসন্তান আশা করত। কারণ পুত্রসন্তানই বংশের নাম ও ধারা বজায় রাখতে পারে। রোমান পুরুষেরা চাইত তাদের স্ত্রীরা যেন গর্ভধারনে বিরতি না দেয়।
সেসময় বন্ধ্যাত্ব ছিল বিবাহবিচ্ছেদের অনিবার্য কারণ। তবে সে রকম ঘটনা ঘটলে মেয়েরাই বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাব করত যাতে তাদের স্বামী অন্য কারও মাধ্যমে পিতৃত্বের অধিকার অর্জন করতে পারে। অবশ্য অভাবের কারণে দরিদ্রশ্রেণির নারীর অধিক সন্তান কাম্য ছিল না । পরিবারের ভরণপোষন করতে গিয়ে অধিক আয় করতে হত। এ কারণে দরিদ্রশ্রেণির রোমান মেয়েদের বাইরে কাজ করতে হত। বংশের বাতি জ্বালানোর জন্য তাদেরও স্বামীরা চাইত পুত্রসন্তান। পরিবারটির বাস গ্রামে হলে চাষাবাদের সাহায্যের জন্য পুত্রসন্তানই ছিল কাম্য, মেয়েরা তো ঐ কাজে দূর্বল! এরপরও রোমান সমাজের অভিজাত সমাজের সঙ্গে নিম্নবর্গের নারীদের তফাৎ ছিল। অভিজাত সমাজের নারীদের বাচ্চাকাচ্চা ছিল বেশি।
বন্ধ্যাত্ব ছিল বিবাহবিচ্ছেদের অনিবার্য কারণ
সন্তানের জন্ম দেবে কি দেবে না এ বিষয়ে রোমান অভিজাত নারীদের কোনও ভূমিকা ছিল না। স্বামী নবজাতককে (এই ক্ষেত্রে যদি নবজাতকটি কন্যাশিশু হয়) লালনপালন করতে না চাইলে স্ত্রীর সে বিষয়ে বলার কিছু ছিল না। কারণ, তৎকালে সন্তানের ওপর রোমান নারীর আইনগত অধিকার ছিল না। বিয়ের সময় যৌতুক দিতে হবে আবার বংশও রক্ষা করবে না এই অজুহাতে মেয়েশিশুকে হত্যা করা হত। এ কারণে রোমের জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল। এই রকম পরিস্থিতিকে রোমান সম্রাট অগাস্টাস উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। আইন করে অবিবাহিত থাকাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গন্য করলেন। সেই সঙ্গে বিবাহ ও অধিক সন্তানের জন্মদানকে উৎসাহ দেওয়া হল।
মেয়েদের পুরুষের অধীন বন্দি করে রাখার নানান প্রথা ছিল রোমান সমাজে। রোমান মেয়েদের নিজস্ব নাম থাকত না। তারা বাবার নামের মধ্যাংশ ব্যবহার করত। তবে সেটিকে স্ত্রীবাচক করে নিতে হত। মেয়েদের নাম শুনেই বোঝা যেত মেয়েটির বাবা কে এবং কী তার সামাজিক মর্যাদা। মেয়েরা পরিবারেই ভিতরেই থাকত এবং তার আলাদ কোনও পরিচয় ছিল না।
মেয়ের ওপর বাবার ছিল নিরুঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, বাবা ইচ্ছে করলে এমন কী মেয়েকে দাস হিসেবে বিক্রি করতে পারত কিংবা মেয়ের বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করতে পারত। সন্তান থাকলেও সেই সন্তানকে ফেলে আসতে হত। সন্তানের ওপর রোমান নারীর বৈধ অধিকার ছিল না কখনও ওদের দেখতেও পেত না। বিয়ের সময় মেয়ের সম্পদের ওপর অধিকার ছিল বাবার, মানে মেয়েরা পৈত্রিক সম্পত্তি শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যেতে পারত না।
যা হোক। সেকালে অভিজাত রোমান নারীরা কেবল সন্তান ধারনের ‘যন্ত্র’ ছিল না। সন্তানের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করত। শিশুদের রোমানসংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়ার জন্য নারীদের উৎসাহ দেওয়া হত । মেয়েশিশুদেরও শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল; কেননা তারাও পরবর্তীকালে সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবে। পুত্রসন্তান বড় হলে রাজনীতে অবতীর্ণ হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। এ জন্য মায়েরা তাদের ছেলেদের পিছনে অর্থসম্পদ ব্যয় করত। তবে ‘ওপিয়ান ল’ নামে একটি আইন হয়েছিল। যে আইন অনুযায়অ মেয়েরা ভোগ্যপন্য -যেমন অলঙ্ককার কিনতে পারত না। এর কারণ ছিল যুদ্ধের ব্যয় মেটানো। অবশ্য ১৯৫ খ্রিস্টপূর্বে অর্থাৎ আইনটি প্রনয়নের ২০ বছর পর তা বাতিল হয়ে যায়।
রোমান মেয়েদের ব্যাক্তিস্বাধীনতা ছিল না। তাদের গতিবিধির ওপর বাবা কিংবা পুরুষ আত্মীয় কিংবা স্বামী নজর রাখত। মাঝে-মাঝে মেয়েদের মুখের গন্ধ শুঁকত। দেখত মদ খেয়েছে কিনা । রোমান সমাজে মেয়েদের মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিল। মদ্যপানের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। রোমান পুরুষরা মনে করত মদ মেয়েদের পরকীয়ায় উৎসাহিত করবে। তবে রোমান সমাজের অভিজাত স্তরে পরকীয়ার ঘটনা ঘটত। কেননা, বিয়েগুলি হত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশে, সেখানে প্রেম বলে কিছু ছিল না। রোমান মেয়েদের কখনও মেয়েদের বেশি বয়েসের লোকের সঙ্গে বিয়ে হত। আসলে যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা হত একজন রোমান মেয়েকে বিয়ে তাকেই করতে হত।
পরকীয়া জানাজানি হলে পুরুষকে কিছু না বললেও মেয়েটিকে মেরে ফেলা হত!
রোমান পাবলিক বাথ
রোমান সমাজের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র। রোমান পাবলিক বাথ-এ মেয়েরাও স্নান করত। কেননা, রোমান জনস্নানাগারটি সব বয়েসের সামাজিক শ্রেণি ও লিঙ্গে জন্য ছিল উন্মুক্ত। কখনও কখনও মেয়েদের আলাদা স্নানাগার ছিল । তা না হলে মেয়েরা সকালে ছেলেরা বিকালে স্নান করতে যেত।
নাগরিক স্নান ও সামাজিক ডিনার পাটি ছিল উচ্চবিত্ত রোমানদের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ডিনার পার্টিতে মেয়েরা স্বামীদের সঙ্গে থাকত। মেয়েরা এম্পিথিয়েটারেও যেত। সেখানে গ্লাডিয়েটরএর যুদ্ধ ও সার্কাস অনুষ্টিত হত। এমন কী নারী গ্লাডিয়েটর সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তবে নাট্যমঞ্চে তাদের দেখা যেত না।
সার্বিক বিচারে রোমান সভ্যতায় রোমান নারীদের ভূমিকা ছিল বহুমূখী। একাধারে সন্তান ধারণ, মা, কন্যা ও স্ত্রীর ভূমিকা। নারীদের রোমান নাগরিক মনে করা হত ঠিকই তবে ভোটাধিকার ছিল না। রাজনীতিতেও অংশ নিতে দেওয়া হত না। অবশ্য কোনও কোনও রোমান নারী অন্যদের চেয়ে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর ছিল, তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও ছিল বেশি। দরিদ্র রোমান মেয়েরা সংসার টিকিয়ে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করত, অপরদিকে উচ্চবিত্ত মেয়েরা পরিবারের পুরুষ সদস্যের ইচ্ছে পূরণ করত। মনে থাকার কথা … রোমান মেয়েদের কখনও মেয়েদের বেশি বয়েসের লোকের সঙ্গে বিয়ে হত। আসলে যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা হত একজন রোমান মেয়েকে বিয়ে তাকেই করতে হত। রোমান মেয়েদের নিজস্ব স্বাত্যন্ত্রটুকু ছিল না। এমন কী পছন্দসই নামও নিতে পারত না।
সেসময় সর্বদা যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। ফলে মানুষের জীবন খুব একটা সুখকর ছিলো না। তবে এতো এতোকিছুর মাঝে প্রাচীন রোমের নারীদের জীবন যে মোটেও সুখকর ছিলো না তা হলফ করে বলে দেওয়া যায়।
তথ্যসূত্র: Moya K. Mason এর Ancient Roman Women: A Look at Their Lives