জেফ্রি চসারের মৃত্যুর পর ইংরেজি সাহিত্যের জগতে আঁধার নেমে এসেছিলো। চসারের মৃত্যুর প্রায় ১৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও; ইংরেজি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেনি। আর সেই সংকট সময়ে আলোর মশাল হাতে ইংরেজি সাহিত্যে আগমন ঘটে কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল স্ট্রাটফোর্ড অন অ্যাভোন শহরের এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। শেক্সপিয়ারের বাবার নাম জন শেক্সপিয়ার আর মা মেরি শেক্সপিয়ার। শেক্সপিয়ারের বাবা জন শেক্সপিয়ার ছিলেন সেই শহরের পৌরসভার প্রধানদের মধ্যে একজন।
জন শেক্সপিয়রের লেখাপড়া তেমন ছিলো না; তাকে একপ্রকার অশিক্ষিত মানুষই বলা চলে। তবে উলের ব্যবসা ও নিজের জমিসহ বিয়ের সময় শ্বশুর থেকে পাওয়া যৌতুকে তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিলো অনেক। একসময় শেক্সপিয়ারের বাবার ব্যাবসায় মন্দা শুরু হয়। ফলে শেক্সপিয়র সহ তার ভাইবোনরা বাবার ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করতে কাজে লেগে পড়েন। শেক্সপিয়রের মোট ভাইবোন ছিলো ৮ জন, ৪ ভাই ও ৪ বোন। তার মধ্যে ২ বোন ছোটবেলাতেই মারা যায়।
শেক্সপিয়ারের সমসাময়িক সময়ে যেসকল সাহিত্যিক ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা জ্ঞানী গুণী মানুষজন। তাদের তুলনায় শেক্সপিয়রের শিক্ষাজীবন নগন্যই বলা চলে।
শেক্সপিয়ার তার পড়াশোনার যাত্রা শুরু করেন নিজ শহর স্ট্রাটফোর্ড শহরেরই একটি গ্রামার স্কুলে। স্কুলের নাম ছিলো স্টাটফোর্ড গ্রামার স্কুল। আসলে শেক্সপিয়ারের সেই শহরে স্কুল বলতে এটিই একমাত্র স্কুল ছিল। এই স্কুলেই শেক্সপিয়ার লিখতে পড়তে শিখেছেন। বিশেষ করে ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষা। তবে পড়াশোনা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি শেক্সপিয়রের। বাবার ব্যবসায় মন্দার ফলে লেখাপড়ার পাঠ একেবারে চুকিয়ে বাবার ব্যবসায় মনযোগ দেন। অবশ্য স্কুলের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফেললেও শেক্সপিয়ার নিজস্বভাবে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। তিনি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে জানতে ব্যক্তিগতভাবে পড়াশোনা করতে থাকেন।
বাবার ব্যবসা পরিচালনা করার সময়ে ব্যবসায়িক কাজেই শেক্সপিয়রের সাথে ইতালিয়ান এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। লোকটি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সেই সাথে প্রচন্ড জ্ঞানী একজন মানুষ। আর তার সাহায্যেই শেক্সপিয়ার গ্রীক, ল্যাটিন ও ইতালিয়ান ভাষার প্রায় সকল বিখ্যাত বইপত্র পড়ে শেষ করে ফেলেন।
শেক্সপিয়ারের সময়ে কবিতা রচনার জোয়ার চলছিলো। বিশেষত ইতালিতে আবিষ্কার হওয়া মাত্র ১৪ লাইনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় লেখা কবিতার। শেক্সপিয়ারও তাতে ব্যতিক্রম ছিলেন না। শেক্সপিয়ার ও সনেট লিখতে শুরু করেছিলেন। তার সনেট লেখার প্রেরণা দিতেন তরুণী অ্যান হ্যাথাওয়ে।
অ্যান হ্যাথওয়ে ছিলেন এক গরীব কৃষক কণ্যা। এছাড়াও কুটির শিল্পের কাজও তারা করতেন। বয়সে অ্যান ছিলেন শেক্সপিয়ার থেকে ৮ বছরের বড়। মূলত ব্যবসায়িক কাজেই তাদের পরিচয় ঘটে। সেই পরিচয় একসময় প্রণয়ে পরিণত হয় তারপর বিয়ে। তাদের প্রেমে তাদের বয়সের ব্যবধান কখনো বাধা হয়ে দাড়ায়নি।
তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই কাটছিলো। এরমধ্যেই দাম্পত্যের ৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে, সেই সাথে শেক্সপিয়ার ৩ সন্তানের বাবা হয়েছেন তাদের মধ্যে ২ জন আবার যমজ। সংসারে খরচও তখন অনেক বেড়ে গেছে। তখন নিজের শৈশবের স্কুল থেকে শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য প্রস্তাব আসে। কিন্তু বেতন এতোই কম যে তাতে সংসার চলে না। বাধ্য হয়েই সেই প্রস্তাব নাকোচ করেন শেক্সপিয়ার।
আর এই সময়টাতেই শেক্সপিয়ারসহ ইংল্যান্ডের প্রায় সকল কৃষক ও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের উপর দুদর্শা নেমে আসে। সেসময় ভূমিস্বামীরা তাদের কৃষি ব্যবসাকে লাভজনক করতে সকল গরীর কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করতে থাকে।
শেক্সপিয়রের ও তেমন এক ভূমিশত্রু ছিলো। শেক্সপিয়ারের বললে ভুল হবে সে ছিলো শেক্সপিয়রের বাবার শত্রু। শেক্সপিয়রের বাবাকে নিঃশ্ব করার পর তার নজর পড়েছে শেক্সপিয়ার ও শেক্সপিয়রের ভাইদের উপর। এই লোকটার নাম টমাস লুসি। টমাস লুসি ছিলেন পিউরিটান মতবাদে বিশ্বাসী। আর তাই শহরে নাচ-গান কিংবা নাএক ছিলো তার কাছে দুচোখের বিষ। শেক্সপিয়রের বাবা নিজের ছেলেদের নাটক অভিনয় গান কিংবা নাচে উৎসাহ দিতেন। আর জন শেক্সপিয়রের নিজের ছেলেই তো ছিলেন তখন শহরের নাট্যকার। টমাস লুসি মনে করতেন অভিনেতাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় কিংবা ঘনিষ্ঠ হওয়া মানে হলো অসৎ পথে পা বাড়ানো।
তবে টমাস লুসির সাথে সমস্যার সূত্রপাত হয় যখন ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে রাজা সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডের রাজা হন। রাজা হেনরি ক্ষমতায় আসার পর যেসকল মানুষ তাকে সাহায্য করেছিলো তাদেরকে সামন্তদের সম্পত্তি ভাগ করে সেইসব লোকেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন। রাজা হেনরি টমাস লুসির পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি ভাগ করে শেক্সপিয়রের পূর্বপুরুষদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আর তাই লুসি ছিলেন শেক্সপিয়ার পরিবারের উপর ক্ষ্যাপা।
১৫৮৪ সালে দিকে টমাস লুসি ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য হন। লুসি তার সহযোগীদের নিয়ে তখন নতুন আইন পাস করান। নতুন আইনটি ছিলো সপ্তম হেনরি যাদের সম্পত্তি ভাগ করে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাদেরকে সেই সম্পত্তি ফেরৎ দেওয়া হোক। আইন পাস হলো শেক্সপিয়রের বাবার মতো অসংখ্য পরিবার এই নতুন আইনে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়লো।
জন শেক্সপিয়ার কে নিঃস্ব করার পর লুসির প্রতিশোধের আগুন তখনো নেভেনি। তার চোখ পড়েছে এবার শেক্সপিয়রের উপর। একেতো শেক্সপিয়ার অভিনেতা সেই সাথে নাট্যকার আর তার চীরশত্রুর ছেলে। শেক্সপিয়ার কে শহর থেকে বিতাড়িত করতে নতুন এক চক্রান্ত করেন। সে সময়ে হরিণ শিকার করা ছিলো বেআইনি। লুসি তখন অভিযোগ করেন শেক্সপিয়ার হরিণ করার চেষ্টা করেছে। এই অভিযোগে শেক্সপিয়ার কে গ্রেফতার করে চাবুক দিয়ে আঘাত করে শেক্সপিয়রের শরীর ক্ষতবিক্ষত করেন। মুক্তি পেয়ে শেক্সপিয়ার লুসির বাড়ির সামনে একটি ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা লিখে ঝুলিয়ে দেন।
লুসির যন্ত্রণায় শেক্সপিয়ার নিজের আপন শহর ছাড়তে বাধ্য হন। পারি জমান লন্ডন শহরে। সিদ্ধান্ত নিলেন নাটক লিখে অর্থউপার্জন করবেন। লন্ডনে তার শুরুর দিককার জীবন ছিলো খুবই যন্ত্রণার। লন্ডনে তখন প্রচুর নাট্যমঞ্চ। অনেক ঘুরাঘুরি করে কাজ পেয়ে গেলেন ব্লাকফিয়ার প্লে হাউসে। এই দলে সুযোগ পাওয়ার মূল কারণ ছিলো এরা এর আগে বহু বার শেক্সপিয়ারের শহর স্ট্রাটফোর্ডে নাটক করতে গিয়েছিলো। নাট্যদলের সবাই ছিলো শেক্সপিয়ারের পূর্বপরিচিত। তারা সহজেই শেক্সপিয়ারকে আপন করে নিয়েছিল।
শেক্সপিয়রের তখন কাজ ছিলো সেই নাট্য দলের নতুন অভিনেতাদের শিক্ষা দেওয়া কিভাবে কি করতে হবে। সেই সাথে নিজেও অনেক চরিত্রে অভিনয় করতেন। অভিনেতা হিসেবেও তার ভালো সুনাম ছিলো।
নাট্য দলে কাজ করতে করতেই শেক্সপিয়ার সেই দলের নাটক রচনার দায়িত্ব নেন। শেক্সপিয়রের সময়ে যারা নাটক রচনা করতেন তাদের সকলেই ছিলেন অক্সফোর্ড কিংবা ক্যাম্রিজে পড়াশোনা করা জ্ঞানী গুণী মানুষ। সেখানে শেক্সপিয়ার ছিলেন একেবারেই নগন্য। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ ও তিনি পার হননি।
আর তাইতো শেক্সপিয়ারের নাট্য রচনা দেখে গ্রীন মন্তব্য করেছিলেন:
ময়ূরের পাখনা লাগিয়ে এই দাঁড়কাক ইংল্যান্ডের নাট্যমঞ্চে উপস্থিত হয়েছে।
১৫৯২ সালের দিকে ক্রিস্টোফার মার্লো অপঘাতে মারা পড়লেন। বিখ্যাত নাটক স্পেনিশ ট্রাজেডির স্রস্টা টমাস কিড ও মারা গেলেন। ইংল্যান্ডের নাট্যমঞ্চ তখন প্রায় ফাঁকা। শেক্সপিয়ারকে ধরা ছোঁয়ার মতো কোনো ব্যক্তি নাট্যমঞ্চে নেই। তৈরি করতে লাগলেন কিং লেয়ার, রমিও জুলিয়েট, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস, হেমলেট, ম্যাকবেথ সহ অসংখ্য বিখ্যাত সব রচনা।
শুধু নাটক নয় অসংখ্য সনেট রচনা করে কাব্যে নিজের দক্ষতা দেখিয়েছেন। শেক্সপিয়ার তার প্রায় সবগুলো সনেট রচবা করেছে তার এক পুরুষ বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে। শেক্সপিয়ারের এই পুরুষ বন্ধুটি সম্পর্কে মানুষের অনেক কৌতুহল রয়েছে। শত শত বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কোনো গবেষক সেই পুরুষটির পরিচয় উৎঘাটন করতে পারেন নি।
শেক্সপিয়ার ইংরেজি ডিকশনারির শব্দভাণ্ডারকেও সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি তার জীবদ্দশায় প্রায় ১৭০০ টি শব্দ সংযোজন করেছেন। এছাড়াও যেখানে গড়পড়তা একজন মানুষ যেখানে ২০০০ শব্দ লেখালেখি কিংবা কথা বলতে ব্যবহার করেন; সেখানে শেক্সপিয়ার তার লেখালেখিতে প্রায় ২৫০০০ এর অধিক শব্দ ব্যবহার করেছেন।
শেক্সপিয়ার তার মৃত্যুর কয়েকবছর আগে নাট্যজগৎ থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে নিজের জন্মশহর স্ট্রাটফোর্ডে চলে আসেন। তবে মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত প্রয়োজন কিংবা আইনগত কারনে তিনি পরবর্তীকালে লন্ডন শহরে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন। তবে লন্ডন শহর পুরোপুরি ত্যাগ করার পর শেক্সপিয়ার কোনো নতুন রচনার সৃষ্টি করেন নি।
১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল ৫২ বছর বয়সে শেকসপিয়র প্রয়াত হন (এই দিনটিই তাঁর আনুমানিক জন্মতারিখ)। কীভাবে ও কেন তার মৃত্যু ঘটেছিল তার ব্যাখ্যা কোনও প্রাপ্ত সমসাময়িক সূত্রে পাওয়া যায়নি।
মৃত্যুর পর তার সামাধিফলকে লেখা হয়;
‘যে আমার হাড়গোড় সরাবে সে অভিশপ্ত হবে।’
বোধহয কবর থেকে শেক্সপিয়ারের হাড়গোড় চুরি কারা হাত থেকে ঠেকানোর জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
মৃত্যুর সময় শেক্সপিয়ার রেখে যান তার পত্নী অ্যানি হ্যাথাওয়ে এবং দুই কন্যা সুজানা ও জুডিথকে। তার পুত্র হ্যামনেট ১৫৯৬ সালে মারা গিয়েছিল। শেকসপিয়রের শেষ বংশধর ছিলেন তার নাতনি এলিজাবেথ হল (সুজানা ও জন হলের কন্যা)। বর্তমানে শেকসপিয়রের আর কোনও বংশধর জীবিত নেই।