স্রষ্টা যাকে প্রতিভা দান করেন তাকে গড়ে তোলেন একান্ত নীরবে ও নিভৃতে। কত গরীব, বংশ মর্যাদায় ছোট মানুষজনকে টেনে তুলেছেন জনপ্রিয়তার একদম শীর্ষে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কে করেছেন জগৎ শ্রেষ্ঠ নন্দিত নাট্যকার। কাজী নজরুল কে দীনদরিদ্র পরিবার থেকে বের করে এনে গড়ে তুললেন মহা প্রতিভাধর বিপ্লবী কবি হিসেবে। মুচির কুটিরে নিভৃতে গড়ে তুললেন গণিতবিদ পিথাগোরাস কে। উইলিয়াম ব্লেক তাদেরই একজন।
উইলিয়াম ব্লেক সবসময় মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক অনাচার, ধর্মীয় কুসংস্কার, দেহজ বিকার, শিশুশ্রম এর মতো নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে তার কবিতা মাইনের মতো ফেটেছে সমাজের বুকে। যেমনটা বাংলা সাহিত্য কাজী নজরুল ইসলাম করে দেখিয়েছেন।
উইলিয়াম ব্লেকের জন্ম ১৭৫৭ সালের ২৮ নভেম্বর লন্ডন শহরে। ব্লেকের বাবার নাম ছিল জেমন ব্লেক। তিনি ছিলেন জন্মসূত্রে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী। উইলিয়াম ব্লেক ছিলেন বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়।
উইলিয়াম ব্লেক এর বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র হোসিয়ারী ব্যাবসায়ী। সংসারের আর্থিক সমস্যার কারণে ব্লেককে তিনি বেশিদূর পড়ালেখা করাতে পারেন৷ নি। ব্লেক এর বাবার ইচ্ছে ছিল ব্লেক কেও হোসিয়ারী ব্যবসায় কাজে লাগাবেন। কিন্তু যার চোখে সমাজ ও প্রকৃতির শতরূপ খেলা করে তাকে কি আর ওসব কাজে কাজে লাগানো যায়?
১০ বছর বয়সে উইলিয়াম ব্লেক ভর্তি হলেন আর্ট স্কুলে। ছবি আঁকা শিখবেন বলে। এতোদিন তার চোখে রং রূপের খেলা চলছিল তা তিনি ঢেলে দিলেন কাগজের পাতায়। খুব গভীর মনযোগ দিয়ে ছবি আঁকা চিখেছিলেন উইলিয়াম ব্লেক।
মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই উইলিয়াম ব্লেক কবিতা লেখা শুরু করেন। কাগজে রং তুলিতে যেসব ছবি আঁকতেন সেগুলোকে তিনি এবার ঢেলে দিলেন কাব্যের মাধ্যমে।
আর্ট স্কুলে ৪ বছর প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ৪ বছর পর ১৭৭১ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান এক চিত্রশালায়। দীর্ঘ সাত বছর তিনি এই চিত্রশালায় কাজ করেছেন। ৭ বছর পর এখান থেকে বেরিয়ে তিনি ভতি হলেন রয়্যাল একাডেমিতে। কিন্তু রয়েল একাডেমিতে বেশিদিন তিনি থাকতে পারেন নি। অর্থের অভাবে তাকে উপার্জনের পথ ধরতে হলো। শুরু করলেন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা আর সাথে খোদাই শিল্পের কাজ।
১৭৮২ সালে উইলিয়াম ব্লেক বিয়ে করেন ক্যাথরিন নামের এক নিরক্ষর নারীকে। পুরো নাম ছিল ক্যাথরিন বচার।
বিয়ের পরের বছর অর্থাৎ ১৭৮৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘Poetical Sketches’ প্রকাশিত হয়। উইলিয়াম ব্লেক তার ১২ থেকে ২০ বছর বয়সে যেসব কবিতা লিখেছিলেন তার সবগুলোই এই কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল তার বন্ধু রেভারেন্ড হেনরীর উদ্যোগে, তিনিই উইলিয়াম ব্লেক কে বই প্রকাশ করার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।
এর ১ বছর পর ১৭৮৪ সালে উইলিয়াম ব্লেক অংশীদারী কারবারে যোগ দেন, কিন্তু সেখানে তিনি ব্যর্থ হন। তিনি আবার তার নিজের জগতে ফিরে যান। তিনি কাব্য- কবিতা, চিত্রকলা আর প্রকাশনা শিল্প নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। ১৮২৭ সাল পর্যন্ত মানে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এসবেই ডুবে ছিলেন। এর মধ্যে রচনা করেন অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ।
শুধু কাব্যই রচনা করেননি। The marriage of Heaven and Hell নামে একটি গদ্য ও রচনা করেছিলেন।
আগেই বলেছিলাম উইলিয়াম ব্লেক বিয়ে করেছিলেন ক্যাথরিন বচার কে। তিনি পুরোপুরি নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু জীবন শিল্পী ব্লেক তাকে নিরক্ষর থাকতে দেন নি। তিনি নিজে ক্যাথরিন কে অক্ষর জ্ঞান দিলেন। তাকে গড়ে তুললেন একেবারে নিজের মতো করে। তারপর কাজে লাগালেন তার খোদাই শিল্পের সহযোগী হিসেবে। ক্যাথরিন কে একদম নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন বলেই তাদের দুজনের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখী, যদিও এই দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান।
শুধু কাব্য ও কবিতাই নয়, জল রং খোদাই শিল্প নিয়েও ব্লেক এর একটা ভুবন ছিল। সে জগৎ ও তার কবিতার জগতের মতোই সমুজ্জ্বল। ১৭৯৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন বিরাট বিশাল কালার প্রিন্টগুচ্ছ। আর এই গুচ্ছের অধীনে ছিল ‘Ncbuchadnezzar’, ‘ The Elohim Creating Adam ‘ এবং ‘ Newton ‘ এর মতো বড় বড় কাজ। ঠিল তার মাত্র দু’বছর পর ১৭৯৭ সালে ইয়াং এর ‘ Night Thought ‘ এর জন্য উইলিয়াম ব্লেক ৫৩৭ টি জলরং এর কাজ করেন! যা ছিল অবিশ্বাস্য।
ইতিহাসের পাতায় কোন প্রতিভাই জগতে পুরোপুরি নিষ্কণ্টক জীবন যাপন করতে পারেননি। বরং প্রতিভাধর উজ্জ্বল মানুষেরাই জীবনে বেশি বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের বহু চড়াই উত্রাই এমনকি রাজ রোষেও পতিত হতে হয় তাঁদের। গ্রিক মহাকবি হোমারের চক্ষু উৎপাটন করে ফেলা হয়েছিল। সক্রেটিসকে হেমলগের বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হলো। কিংবা শাহানামা’র রচয়িতা ফেরদৌসীকে বনে বনে পালিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। বিজ্ঞানী ব্রুনোকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নজরুলকে বার বার জেল জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। উইলিয়াম ব্লেক এর বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ব্লেক জীবনে কখনো সচ্ছল আর্থিক অবস্থায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পেরেছেন কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু এই আর্থিক টানাপোড়নে দিনাতিপাতকারী অথচ সৌন্দর্য পিপাসু এই মানুষটির বিরুদ্ধেও একসময় নিক্ষিপ্ত হলো রোষানল, রাষ্ট্রের শীর্ষচূড়া থেকে।
১৮০০ সালে উইলিয়াম হেইলির কাওপারের জীবনী গ্রন্থের জন্য ইলাসট্রেটরের দায়িত্ব পান উইলিয়াম ব্লেক। আর এ দায়িত্ব নিয়ে তিনি চলে যান সপরিবারে সাসোক্স এর ফেলফামে। ফেলফামে তিনি তাঁর কাজে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু এ কাজে থাকাকালীন সময়েই তাঁর বিরুদ্ধে রাজ দ্রোহের অভিযোগ উঠে। ১৮০৪ সালে এ অভিযোগ আদালতে উত্থাপিত হয়। অনেক ভোগান্তির পর আদালতে ব্লেক নির্দোষ বলে প্রমাণিত হন। আইন-আদালতের অভিযোগ খণ্ডন করে ব্লেক ফিরে আসেন লন্ডনে। তিনি তার চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন ১৮০৯ সালে। প্রদর্শনীতে স্থান পায় মোট ১৬ টি চিত্রকর্ম যার মধ্যে চসারের ক্যান্টারবারির তীর্থযাত্রীদের চিত্রও ছিল। ব্লেকের আলোকিত ও আলোচিত শিল্পকর্ম হচ্ছে ‘ Illustrations of The Book of Job’ আর এ কাজটি শেষ করেন তিনি ১৮২১ সালে।
তারপর ১৮৯৫ সালে তিনি দায়িত্ব পান দান্তের ডিভাইন কমেডিয় ইলাসট্রেশন এবং সেগুলো খোদাই করার। তিনি এ কাজটি হাতে নিয়ে ১০০ টি জলরং এবং এর মধ্যে মাত্র ৭ টি খোদাই এর কাজ সম্পন্ন করেন। বাকি কাজ আর করে যেতে পারেননি। উল্লেখ্য যে, উইলিয়াম ব্রেক যে কটা বই নিজের হাতে মুদ্রণ করেছেন সব কটিতে তাঁর নিজের আঁকা ছবি রয়েছে। তবে আজকের দিনে আমরা যে মুদ্রণ পাচ্ছি তাতে সেই ছবিগুলো নেই। এটা খুবই দুঃখজনক।
আবিষ্কারক উইলিয়াম ব্লেক
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি একাধারে চিত্রশিল্পী এবং বিজ্ঞানী। লিওনার্দোর সেই বিজ্ঞান মানসিকতার সন্ধান পাওয়া যায় কবি ও শিল্পী উইলিয়াম ব্রেকের মধ্যেও। আবিষ্কারের নেশা তাঁর মধ্যেও সুপ্ত ছিল। ১৭৮৮ সালের দিকে ব্লেক মুদ্রণ যন্ত্রের আবির্ভার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন কিভাবে তামার পাতকে কাজে লাগিয়ে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করা যায়। এতে সফলও হয়েছিলেন। তামার পাতের গায়ে অম্লরোধী মোম ঢেলে সে মোনের উপর তিনি লেখা এবং ছবি উল্টো করে খোদাই করে দেন। এবার মোমের উপর ঢেলে দেন এসিড। খোদাইয়ের ফলে পাতের খালি জায়গাগুলো অর্থাৎ খাঁজগুলো এসিডে ভরে গেলে লেখা এবং ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। তারপর খোদাই করা পাতের স্থাপ কাগছে তুলে নেয়া হয়। প্রয়োজনমতো তাতে হাতে রং করে আকর্ষণীয় লেখা ও ছবি তৈরি করেন। এভাবে ব্লেক তাঁর নিজের হাতে বই মুদ্রণ ও ছবি সেট করতেন।
তবে তাঁর স্বমুদ্রিত ছবিযুক্ত বই এখন আর বেশি পাওয়া যায় না। Songs of Innocence বর্তমানে পাওয়া যায় ২৭ কপি। The Book of the thill পাওয়া যায় ১৫ কপি। The marriage of Hell and Heaven ৯ কপি এবং Jerusalem এর ৫ কপি। অর্থাৎ সব মিলে মাত্র ৫৬ কপি বই এর সন্ধান পাওয়া যায়।
ইংরেজী রোমান্টিক যুগের করি সাহিত্যিকরা হচ্ছেন শেলী , কীটস , বায়রন , ওয়ার্ডসওয়ার্থ , কোলরীজ টমান নূর , টমাস হুড , রবাট সাদি , স্যার ওয়াল্টার স্কট , চার্লস ল্যাছ , হেনরী লে হান্ট , উইলিয়াম হ্যাজলিট , টমাস ডি কুইলি , লাভ পিকক , স্যান্ডেজ ল্যান্ডার প্রমুখ। এদের মধ্যে শেলী, কীটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোলরীজ সুপরিচিত, সুপ্রসিদ্ধ।
ইংরেজি সাহিত্যের জগতে উইলিয়াম ব্রেককে রোমান্টিকতার পূর্বসূরি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় এবং তাকে শেলী , কীটস বায়রন , কোলরীজ, ওয়ার্ডওয়ার্থ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কোলব্রীজ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের যৌথ কর্ম রক্যাল ব্যালাস যা ছিল এটা জাগানো কাব্য। অথচ তার অনেক পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছে উইলিয়াম ব্লেকের বেশ কিছু লেখা যেগুলোতে রোমান্টিক সাহিত্যের অনেক উপাদান, অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ব্লেক রোমান্টিক কবিদের মতোই কল্পনার জগতকে বড় করে দেখেছেন। তিনি মনে করতেন যে , কল্পচর্চার ই আহরণ করা যায়। রোমান্টিক কবিদের মতোই তিনি প্রকৃতিকে বিশেষ করে পল্লী প্রকৃতিকে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন অবলীলাক্রমে সবুজ মাঠ , শিশির , বুনো পাখি , বুনো ফুল, চোর, বসন্ত, গিরি পর্বত, সবুজ উপত্যকা, মেধ ; মেষ চারক , বাঘ , নেকড়ে , ঈগল, চাদের আলো, গোলাপ, বৃক্ষ- শাখ, পল্লী প্রকৃতির দৃশ্য পরিদৃষ্ট হয়।
উইলিয়াম ব্লেক এর কবিতায় অনুকরণের আভাস লক্ষ করা যায়। তিনও শেক্সপিয়ার, মিল্টন ও স্পেন্সাররের কাব্যরীতি অনুসরণ করতেন।
অন্যান্য কবিদের মতো বড় আঙ্গিকের কবিতা ব্লেকের নেই। তার সকল কবিতাই ছড়ার আঙ্গিকে লেখা। তার কবিতা যতোই ছোট হেক, কোনো কবিতাই অপূর্ণাঙ্গ নয়। সবগুলোই পূর্ণাঙ্গ ভাব প্রকাশে সক্ষম। কবি যা বলতে চেয়েছেন তা বলেছেন অল্পকথায়। অনেক বড় কবিতাও যা দিতে পারে না, ব্লেকের ছোট ছোট কবিতা তা দিতে সক্ষম।
উইলিয়াম ব্লেক মরমি কবি,ধর্মের কবি,বাইবেলের কবি,ওল্ড টেস্টামেন্টের কবি। তার কবিতায় বাইবেলের চরিত্র গুলোর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
১৮২৭ সালের ১২ আগস্ট এই মরমী কবি ও চিত্রশিল্পী পরলোকগমন করেন।
তথ্যসূত্র: উইকিপিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া