আইনের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রচলন শুরু হওয়ার আগে ইংল্যান্ডে মধ্যযুগ ও রাণী ভিক্টোরিয়ান যুগে স্ত্রী কে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা একটি জনপ্রিয় কার্যক্রম ছিল।
স্ত্রী বিক্রির বেশিরভাগই ঘটতো ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলগুলোতে। অনেকে মনে করেন এই প্রথার উৎস অ্যাংলো-স্যাক্সন সময়কাল থেকে।
তবে এটি ১৭ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত বহুল প্রচলিত বিষয় ছিল। এমনকি বিংশ শতাব্দীতে এসেও ইংল্যান্ডে স্ত্রী বিক্রির ঘটনা ঘটেছে।
যে স্বামী তার স্ত্রীকে নিলামে তুলতো তাকে প্রথমে স্ত্রীকে পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করতে হতো। তারপর সেই নারীকে একটি জনসভার মাঝে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো।
নিলামগুলো সাধারণত সরাইখানা, মেলা বা বাজারের মতো সর্বজনীন স্থানে করা হতো। কিছু পুরুষ তাদের স্ত্রীদের গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেতো। এ যেনো ছিলো কোনো কোনো পশুকে বাজারে বিক্রি করার মতো ব্যাপার স্যাপার!
স্ত্রীকে নিলামে তোলার আগে ডাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হতো। নিলামের সভাপতিত্ব করার জন্য একজন নিলামকারীও উপস্থিত থাকতো।
নিলামের সময় সাক্ষীদের উপস্থিতি ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী নিলামের সময় দর্শকদের কাছে তার স্ত্রীর গুণাবলী গুলো জোরে চিৎকার করে ঘোষণা করতো।
অনেক ব্যবসায়ী ও দালাল সেই নিলামে অংশ নিতো। দালালরা নিলামে সেই নারীকে কিনে আবার কোনো ধনী ব্যাবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিত যৌনদাসী হিসেবে।
কখনও কখনও, স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরাও সেই দর্শকদের ভিড়ের অংশ হয়ে যেতো।
একবার অন্য একজন পুরুষ নিলাম করা স্ত্রীকে ক্রয় করতে সফল হলে, তার পূর্বের বিয়ে অবিলম্বে বাতিল হয়ে যেতো। আর নতুন ক্রেতা তখন তার নতুন স্ত্রীর সকল আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণ করতো।
প্রতিটি নিলামের পরে, এটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রাক্তন স্বামী তার স্ত্রীর উপর সমস্ত অধিকার ও দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন।
নীলামে স্ত্রী বিক্রির নির্দিষ্ট কোনো মূল্য নির্ধারিত ছিল না। তাদের মূল্য নিলামে কয়েক পেন্স থেকে ২/১ শত পাউন্ড পর্যন্ত উঠতো।
যেসকল কারনে স্ত্রী কে নীলামে বিক্রি করা হতো
১. অবিশ্বস্ত স্ত্রীকে তার প্রেমিকের কাছে বিক্রি করা
প্রধান কারণগুলোর একটি ছিল স্বামীর সাথে স্ত্রীর প্রতারণা অর্থাৎ অন্য পুরুষের সাথে পরকীয়ায় জড়ানো। পরকীয়ার ফলে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কগুলো হয়ে উঠতো তিক্ত। আর তাই স্ত্রীকে প্রকাশ্যে মানুষের সামনে বিব্রত করতে স্বামীরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করতো। আর সেই নিলামে দেখা যেতো বেশিরভাগ সময়ই সেই মহিলার প্রেমিকা তাকে কিনে নিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ‘মিস্টার হেবব্যান্ড’ নামে একজন ব্যক্তির কথা। তার স্ত্রী তার কাছে বার বার প্রতারণা করে ধরা পড়েছে। একটা সময়ে তিনি বাধ্য হয়ে অর্থের বিনিময়ে সেই প্রেমিকের কাছে নিজের স্ত্রীকে তোলে দেন।
২. সাংসারিক মনমালিন্য ও মতের অমিল
দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়ন ও সংসার অশান্তির থেকে মুক্তি পেতে চাইতো অনেকে। আর তাই তারা নিজেরাই তাদের বিক্রির ব্যাপারে মত দিতো।
নিলামে যারা সর্বোচ্চ দাম দিতো তারাই সেই নারীকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেতো। এইসব অধিকাংশ নারীদের কোনো প্রেমিক পুরুষ ছিলো না, যারা তাকে নিলামে কিনে নেবে। তাদের কোনো ধারণা ছিলো না তাদের পরবর্তী ভবিষ্যৎ কোথায়।
আর যেহেতু সে সময় তারা স্বামীর সম্পত্তির কোনো ভাগও পেতো না, বিক্রির মাধ্যমে সাংসারিক টানাপোড়েনের হাত থেকে বাঁচার জন্য এটাই ভালো পন্থা মনে করতো।
তবে কিছু ব্যতিক্রম ঘটনাও রয়েছে, অনেক স্ত্রী নিজের অর্থ দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতেন। ১৮২২ সালে ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথের এক নারী নিজেই নিজেকে বিক্রির ব্যবস্থা করে ছিলেন। এবং সেই নিলামে ৩ পাউন্ডের বিনিময়ে স্বামীর থেকে নিজেকে কিনে মুক্তি দেন। অনেকে মনে করেন তার অন্য পুরুষের সাথেও সম্পর্ক ছিলো এবং এই অর্থ সেই পুরুষই দিয়েছিল।
এমন কিছু মহিলা ছিলো যারা জানতোই না তাদের স্বামী তাদেরকে অন্য এক পুরুষের কাছে বিক্রি করে দেবে নিলামের মাধ্যমে। বিক্রির পূর্বে তাদের জানানোও হতো না। তাদেরকে হঠাৎই বেধে নিয়ে জনসম্মুখে নিলামে বসিয়ে দিতো। এই সকল স্বামীরা বেশিরভাগই ছিলো নেশাখোর। নেশা করে ধারধেনা করা সেই অর্থ শোধ করতে তারা তাদের স্ত্রীকে বিক্রি করতো।
উদারহরণস্বরূপ বলা যায় ১৮০০ সালে ইংল্যান্ডের স্টাফোর্ডের ‘কিউপিড হাডসন’ নামের এক ব্যাক্তির কথা। নেশার অর্থ জোগাতে তিনি তার স্ত্রীকে ৫ শিলিং ৬ পেন্সের বিনিময়ে বিক্রি করেছিলেন।
স্ত্রী বিক্রি বৈধ নাকি অবৈধ?
সেই সময়ে, যদি কেউ একটি বিবাহের সমাপ্তি টানতে চাইতো তখন তাকে পার্লামেন্টের বিশেষ আইনের শরনাপন্ন হতে হতো। বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি এই পক্রিয়াটি ছিলো অত্যাধিক ব্যায়বহূল ও সময়সাপেক্ষ। সে তুলনায় স্ত্রী বিক্রির মাধ্যমে বিচ্ছেদ হওয়া ছিলো ঝামেলা বিহীন সহজ ও সস্তা পদ্ধতি। আর এ কারনেই স্তী বিক্রি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যদিও তখনো এর বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে সমাজে বিভিন্ন মতবাদ ছিল।
একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক, এরিন ব্লেকমোর স্বীকার করেছেন যে:
স্ত্রীকে বিক্রি আইনগতভাবে তখন বেআইনী ছিল না, তবে যেভাবে এটি জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল তা অনেকের চোখেই বৈধ করে তুলেছে।
সেসময়ে অনেকে এই পদ্ধতিটিকে অসুখী দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য এটিকে একটি ভালো উপায় হিসেবে দেখতো। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে বিবাহ বিচ্ছেদের থেকে মুক্তির পাশাপাশি তারা অর্থ লাভ করতে পারতো।
আর তাই প্রক্রিয়া চলেছে কয়েক শতাব্দী জুড়ে! অবশ্য যদিও সেসময় এটির জন্য কোনও আইনি সমর্থন ছিল না, এমনকি এটিকে বেআইনি হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি।
তবে অনেকক্ষেত্রেই কিন্তু এই স্ত্রী বিক্রির লেনদেন টা খুব একটা খারাপভাবে শেষ হতো না। দেখা যেতো বিক্রির পর পুরনো স্বামী নতুন স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের সাথে কৌতুক বিনিময় করছে কিংবা একসাথে বসে বিয়ার পান করে সেই সম্পর্কের সমাপ্তি করছে।
বর্বর প্রথার পরিবর্তন
ইংরেজ সরকার বুঝতে পেরেছিল যে স্ত্রী বিক্রি করা সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে এবং এটি সম্পূর্ণ নিতী-নৈতিকতা বিরোধী কাজ। আর এসব ব্যভিচার দূর করতে তিনি নতুন আাইন পাস করেন।
সংসার জীবনে টানাপোড়েনে থাকা স্বামী স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারগুলো ইংরেজ সরকার সহজলভ্য ও ঝামেলাহীন করে তুলেন। ফলে ১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই ঘৃণ্য প্রথার পতন ঘটতে শুরু করে।
Featured Image Credit: Geri Walton