রেনেসাঁস শব্দিটি ফরাসি শব্দ Renaissance থেকে যার অর্থ পুনর্জন্ম বা নবজাগরণ।
৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন রোমের পতনের পর থেকে ১৪ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয়দের বিজ্ঞান ও শিল্পে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।
“অন্ধকার যুগ” নামেও পরিচিত, যুগটিতে প্রায়শই যুদ্ধ, অজ্ঞতা, দুর্ভিক্ষ এবং ব্ল্যাক ডেথের মতো মহামারী লেগেই থাকতো।
রেনেসাঁস ছিল মধ্যযুগের পরে ইউরোপের সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ‘পুনর্জন্ম’। রেনেসাঁ এর সময়কাল সাধারণত ১৪ শতক থেকে ১৭ শতক পর্যন্তের সময়কাল কে ধরা হয়। যার উৎপত্তিস্থল ছিলো ইউরোপের ইতালি।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, রেনেসাঁস কেনোই বা ইতালিতেই শুরু হয়েছিলো? আজ আলোচনা করবো ইতালিতেই কেনো ইউরোপের রেনেসাঁসের গোড়াপত্তন হয়েছিল? আর এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, আমাদের রেনেসাঁর ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ছিলো ইতালিতে রেনেসাঁস হওয়ার বিশেষ কারণ
রেনেসাঁস সৃষ্টির পেছনে ইতিহাসবিদরা যে বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন সেটি অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান। গ্রীক কে বলা হয় ইউরোপের সংস্কৃতির আদি পিতা। ১৪৫৩ সালে কনস্টানিপল অটোমান শাসক রা দখল করে নিলে গ্রীক পন্ডিতরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে থাকেন। এর আগে থেকেই তারা সেই জায়গা থেকে পালাতে শুরু করেন।
এই পন্ডিত লোকগুলো বিশেষ করে ইউরোপের ইতালিতে আশ্রয় নেন। সেই সাথে তারা তাদের সাথে নিয়ে যান হাজার বছরের পুরনো দার্শনিকদের মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো। আর সেই জ্ঞানী পন্ডিত ও তাদের সাথে থাকা মহামূল্যবান গ্রন্থের প্রভাবেই ইতালি থেকে ইউরোপে বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য ও আবিষ্কারের নবজাগরণ বা নতুন বিপ্লবের শুরু হয়।
ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল, কারণ ইতালি ছিল প্রাচীনত্বের জন্মস্থান
রোমান সাম্রাজ্যের জন্মস্থান ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল। চতুর্থ শতাব্দীতে জগদ্বিখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে এবং পরবর্তীতে রোমানরা অন্ধকার যুগে পতিত হয় সেই সাথে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা রোমান সাম্রাজ্য শিল্প ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছিল। পরে ১২ শতকের দিকে ইতালিতে এগুলি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল, যা তাদের রেনেসাঁর দিকে নিয়ে যায়।
ইতালীয় লেখক দান্তে আলিঘিয়েরি এবং ফ্রান্সেসকো পেত্রার্কের প্রাচীন গ্রন্থের উপর পণ্ডিতপূর্ণ গবেষণা, বিশেষ করে, পুরো ইতালি জুড়ে মানুষদের মধ্যে প্রাচীনকালের প্রতি ক্রমবর্ধমান মুগ্ধতা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তাদের ধারণাগুলি দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত এবং আরও অনেক কিছু সহ সমাজের সমস্ত দিক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যা অবশেষে রেনেসাঁর দিকে নিয়ে যায়।
ইতালিতে রেনেসাঁস শুরু হয়েছিল কারণ তারা একটি ধনী জাতি ছিল
ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হওয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তারা একটি ধনী এবং সমৃদ্ধ জাতি ছিল। ১৪,১৫ এবং ১৬ শতকে ইতালিতে বিশেষত ফ্লোরেন্স শহরের সাথে এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের সাথে সফল বানিজ্যিক চুক্তি হয়েছিলো। আর এর ফলে ইতালি ব্যবসায় ব্যাপক মুনাফা অর্জন করে।
শিল্প সাহিত্যের নবজাগরণের পেছনে ইতালির ধনী পরিবারগুলোর অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে বিখ্যাত মেডিসি পরিবারের কথা উল্লেখ করতে হয়। এই ধনী বনিকরা শিল্পীদের সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা করে নিজেদের শৈল্পিক সৃষ্টিতে সহযোগিতা করেন, যেনো শিল্পীরা নিজেদের শৈল্পিক কাজে স্বাধীনতা খুঁজে পায় এবং নিজের দক্ষতাকে আর বাড়িয়ে তুলতে পারে। আর তাই আজও যখন আমরা পেইন্টিং কিংবা ভাষ্কর্যের মতো জিনিসগুলোর দিকে তাকাই আমরা প্রথম সারিতেই ইতালীয় চিত্রশিল্পী ও ভাষ্করদের দেখতে পাই।
ব্ল্যাক ডেথ ইতালির ধনী হওয়ার অন্যতম কারণ
ইউরোপের সবচেয়ে বড় মহামারী ব্ল্যাক ডেথ বা বুবোনিক প্লেগ ইতালিতে রেনেসাঁস ঘটাতে সাহায্য করেছিলো। ব্ল্যাক ডেথের ফলে পুরো ইউরোপে ২০ মিলিয়নের অধিক মানুষ মারা গিয়েছিল; যা ছিলো সে সময়ের ইউরোপের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। দেশের একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছিলো, বেকারত্ব সমস্যা তখন নেই বললেই চলে। যেহেতু সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা কম ছিলো মানুষের পক্ষে ধনী হওয়া সহজ হয়ে উঠেছিল।
ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল কারণ ভ্যাটিকানে শিল্পের একটি শক্তিশালী এবং ধনী পৃষ্ঠপোষক ছিল
রেনেসাঁর অগ্রগতির সাথে সাথে তা সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্র ফ্লোরেন্স থেকে রোমে স্থানান্তরিত হয়, যার ফলে রেনেসাঁসের আরো উন্নয়ন হয় এবং তা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।
ইতালির রোম শহর থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলো বিখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যর। সেই সময়ে রোম শহরের অন্যতম শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ছিল ভ্যাটিকান। আর তাই পোপ রোমের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও জৌলুশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নজর দেন। তারা চাইছিলো রোমকে আবারো পাওয়ার হাউজ করে তুলতে। আর তাই শিল্পীদের সাধারণ জনগণ কে তাদের আশ্চর্য শিল্প দক্ষতা দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে থাকেন।
আর এর ফলেই রোম থেকে আবির্ভূত হয় মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো, রাফেল ও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো বিখ্যাত শিল্পীদের।