রোমান সাম্রাজ্য মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য; যার স্থায়ীত্ব ছিলো প্রায় ২ হাজার বছর। ভাষা,সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞানে এই সাম্রাজ্যের জুরি মেলা ভার। এখনো পৃথিবীর প্রায় সিংহ ভাগ স্বাধীন দেশ তাদের সামাজিক আইনকানুন অনেকাংশেই প্রাচীন রোমের পদ্ধতির অনুরূপ।
যখন এমন একটি সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্যের কথা চিন্তা করি, তখন প্রাচীন রোমের সাধারণ মানুষের জীবনের কথা ভাবতেই বিস্ময় জাগে।
আজকের এই আর্টিকেলে রোমের সাধারণ মানুষের কোনো জীবন নয়, রোমের সম্রাটদের নিয়ে কথা বলবো। কেমন ছিলো তাদের জীবন আর অবসর সময়ে তার কি করতেন?
এই পোস্টে যেসব বিষয়ে কথা বলা হবে তার সবকিছু সকল সম্রাটের সাথে প্রযোজ্য নাও হতে পারে, কারণ রোমান সাম্রাজ্য একটি উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। ধরুন যে কথাগুলো ২০ খ্রিস্টাব্দের সম্রাটদের জন্য স্বাভাবিক বিষয় ছিলো তা ৮’শ শতাব্দীর সম্রাটের ক্ষেত্রে হয়তো না ও হতে পারে।
চলুন আজ রোমান সম্রাটদের কিছু ক্রিয়াকলাপের দিকে নজর দেয়া যাক।
১. থিয়েটার
রোমান সম্রাটের কিছু বিনোদন সাধারণ রোমান জনগণের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল। এরকম একটি উদাহারণ হচ্ছে থিয়েটার এবং পারফরম্যান্স আর্ট।
রোমের অভীজাতদের অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিলো ব্যঙ্গ করা। এই ব্যঙ্গ বিষয়টাকে তারা থিয়েটারে নিয়ে এসেছিলো। সেসময় ব্যঙ্গাত্বক বিষয়ক নাটক তৈরি করে তা মঞ্চে অভিনয় করানো হতো।
অনেক রোম সম্রাট এইসব নাটক উপভোগ করার পাশাপাশি নিজেও অভিনয় করতেন। সেসব সম্রাটের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্রাট নিরো, যিনি ছিলেন নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত।
সেসময় সকল শ্রেণীর রোমান মানুষরা থিয়েটার পছন্দ করলেও সেই সকল থিয়েটারের অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের তারা পতিতাদের চেয়েও খারাপ দৃষ্টিতে দেখতো। পেশাটিকে তখন নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করা হতো এবং অভিনয়কে সাধারণত একটি নিম্ন পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
২. গ্ল্যাডিয়েটর গেমস ও রেস
গ্ল্যাডিয়েটর গেম কেলার জন্য ক্যালোসিয়ামের মতোই কিছু বিল্ডিং ছিলো, যেখানে মারামারি খেলা হতো কিংবা ঘোড়ার রেস খেলা হতো।
সেই যুগে সাধারণ মানুষের মাঝে গ্লাডিয়েরটরদের বিপুল খ্যাতি ছিল, কিন্তু অভিজাত রোমানরা গ্লাডিয়েরটরদের যুদ্ধ উপভোগ করতেন বিনোদনের উপলক্ষ হিসেবে, যে যুদ্ধে নিম্নশ্রেণির দাস ও সৈনিকরাই শুধু অংশগ্রহণ করতো। গ্লাডিয়েটরদের সঙ্গে সম্রাট কমোডাসের প্রকাশ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘটনা রোমান জনগণের একটি অংশকে ক্ষুব্ধ করে। বিশেষ করে তার যুদ্ধ কখনো সমান্তরাল ও ন্যায্য ছিল না। নিজের দক্ষতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য তিনি সাধারণত আহত গ্লাডিয়েটর ও দুর্বল হয়ে পড়া প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন।
আরেক সম্রাট ছিলেন ক্যালিগুলা তিনি ঘোড়ার রেসে বাজি ধরতেন যদি তার বাজি ধরা ঘোড়া হেরে যেতো তাহলে তিনি খেলা শেষে নিজের বাজি ধরা ঘোড়া ও চালক কে হত্যা করে সেই জায়গা ত্যাগ করতেন।
৩. অত্যাধিক যৌণতা
নগ্নতা ও অশ্লীলতা খুবই সাধারণ বিষয় ছিলো প্রাচীন রোমে। রোমান সম্রাটের মধ্যে যৌনতা ও অশ্লীলতা ছিলো শোচনীয় ভাবে।
তাদের মধ্যে রোম সম্রাট ক্যালিগুলা ছিলেন সবার উপরে তিনি সবসময় নারী সঙ্গে উন্মত্ত হয়ে থাকতেন। তার শয্যাসঙ্গের জন্য তিনি হাজার হাজার নারী দাসী প্রাসাদে আনতেন। এতেও তার স্বাদ মেটেনি তার চোখ পড়ে শহরের সিনেটরদের স্ত্রী ও মেয়েদের প্রতি। জোড় করে সম্রাট শহরের সিনেটরদের স্ত্রী ও মেয়েদের নিজের যৌনদাসী বানান।
তার যৌন ক্ষুধা এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে তিনি তার বোনদের সাথেও যৌনাচার চালিয়েছেন বলে কথিত আছে। তবে, ইতিহাসবিদরা এখনও বিশ্বাস করেন যে এই দাবিগুলি অতিরঞ্জিত।
এছাড়াও সম্রাট টাইবেরিয়াস একজন পেডোফাইল ছিলেন এবং তার ভাগ্নে ক্যালিগুলাকে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পতিতার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্য করেছিলেন!
আর সম্রাট জুলিয়াস সিজার, যিনি প্রায়শই রোমান প্রজাতন্ত্রের মৃত্যুর সূচনাকারী ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হন, তিনিও মানব রূপের একজন ভক্ত ছিলেন।
সম্রাট জুলিয়াস সিজার একজন উভকামী ছিলেন এবং তার দীর্ঘ সামরিক অভিযানের সময় পুরুষদের সাথে সম্পর্ক অস্বাভাবিক ছিল না। এমনকি তিনি বিথিনিয়া (বর্তমান তুরস্ক) এর রাজা নিকোমেডিসের সাথেও তিনি যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন।
৪. মদ পান ও ভোজনবিলাস
রোমান সম্রাটদের মদ পান ও ভোজনবিলাসের প্রতি বেশি মত্ত ছিলেন। সম্রাটরা প্রায়ই নৈশভোজের আয়োজন করতেন। নৈশভোজের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলো বিভিন্ন পদের খাবারের সাথে পানীয়।
সেসময় দুটি বিশেষ ধরনের মদ ছিলো যেগুলো মূলত অভিজাতরাই পান করতো, একটির নাম ‘ক্যালডা’ আর আরেকটি ‘মুলসুম’।
‘ক্যালডা’ পানীয়টি ছিলো শীতের রাতের নৈশভোজের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পানীয়। এই পানীয়টি অতিথিদের মাঝে গরম গরম পরিবেষণ করা হতো, এই মদটি বিভিন্ন মশলার সংমিশ্রণে তৈরি করা হতে।
‘মুলসুম’ পানীয় টি ছিল মিষ্টি মধু মিশ্রণে তৈীি। এই মদটি রোমান সংস্কৃতি জুড়ে খুব জনপ্রিয় ছিল।
এছাড়াও পার্টি শুরু হওয়ার আগে গরম জলের সাথে ওয়াইন মেশানোর একটি ঐতিহ্য ছিল। এটি করা হয়েছিল কারণ বিশুদ্ধ ওয়াইন পরিবেশন করা তাদের সংস্কৃতিতে অসভ্যতা হিসাবে বিবেচিত হতো। আর তাই পানীয়তে রেমানরা জল মেশাতেন।
সম্রাটের আয়োজিত নৈশভোজগুলোর খাবারের বৈচিত্র্য ছিল অবিশ্বাস্য, ময়ূরের জিভ থেকে শুরু করে ভাজা ডরমাইস সহ কয়েক ডজন পদ। এতো খাবারের আয়োজন হতো যে অতিথিরা অনেক সময়ই না খেয়ে চলে যেত! রোমান সম্রাটরা শুয়োরের মাংস পছন্দ করতেন, যা তারা মধু এবং জলের সাথে মিশ্রিত ওয়াইন দ্বারা তাড়া করে ভাজা সসেজের আকারে খেতেন।
তাদের বাড়াবাড়ি এখানেই শেষ হয়নি।
রোমান সাম্রাজ্যের বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা বিদেশী মশলার ব্যবসা শুরু করে এবং একটি রন্ধনসম্পর্কীয় বিপ্লব সৃষ্টি করে।
একজন রোমান সম্রাটের জীবন আসলে বলতে গেলে সাধারণ রোমের নাগরীক জীবনের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলো। তারা যেসব শখ পালন করতো তা সাধারণ মানুষের কাছে ছিলো কল্পনারো অতিত। তাছাড়া চরম অপ্রীতিকরতা, জমকালো ভোজ, এবং থিয়েটারে ঘন ঘন পরিদর্শন বেশিরভাগের জন্যই অসম্ভাব্য ছিল।