প্রাচীন মিশরের পিরামিডগুলো তৈরি হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৪.৫ হাজার বছর আগে। এতো হাজার বছর আগে কেমন করে এতো সুউচ্চ বিশাল সাইজের পিরামিড তৈরি করা হয়েছিলো! তা এখনো মানব সভ্যতার এক রহস্য। সূক্ষ্ম কারুকাজ, অনন্য ঐতিহ্য ও প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যবস্থাই প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য। ইতিহাসবিদরা মিশরীয় সভ্যতার জাঁকজমক ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বলেন পৃথিবীতে প্রথমে মিশর এসেছে তারপর ইতিহাস এসেছে।
তবে প্রাচীন মিশরে এমন কিছু উদ্ভট প্রথা প্রচলন ছিলো যা আজকের এই আধুনিক যুগে বসে শুনতে আপনার উদ্ভট, অদ্ভুত ও ক্ষেপাটেই মনে হবে।
বহুমুখী বেবুন
মিশরের ফারাউরা প্রায়ই তাদের রাজসভা ও সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের নিয়ে ভোজসভার আয়োজন করতেন। ভোজসভার টেবিল থাকতো রকমারি খাবার আর পানীয়ে ভর্তি। সেই সাথে একদল নর্তকী সেই ভোজসভার মনোরঞ্জনের জন্য সঙ্গীতের সাথে নৃত্য করতো।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সেই ভোজসভায় খাবার করছে একদল বেবুন (বানর-জাতীয় প্রাণী), কোনো মানুষ ওয়েটার নয়! স্বয়ং বেবুন ওয়েটারদের দায়িত্ব পালন করছে।
প্রাচীন মিশরে বেবুন কে পবিত্র প্রাণী হিসেবে মানা হতো। মিশরের ফারাওরা তাদের সেবক হিসেবে কাজ করানোর জন্য বেবুনদের প্রশিক্ষণ দিতো।
বেবুনদের কাজ এখানেই শেষ নয়। বেবুনরা সেসময় মিশরের ধর্মীয় প্রার্থনালয়ের কাজ, অপরাধী ধরা ফলমূল সংগ্রহ করাও তাদের কাজ ছিল। বেবুনরা যখন মন্দিরের কাজ করতো তখন তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিত এবং আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত।
মিশরে বেবুনরা তাদের দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গায় থাকতো। কিন্তু মরুভূমির তীব্র সূর্য এবং তাজা খাবারের অভাব (ফল, বীজ, শিকড় ইত্যাদি) বেবুনদের আয়ু কমিয়ে দেয়। যখন তারা মারা যেতো, তখন এই বেবুনদের মমি করে মন্দিরে সাজিয়ে রাখা হতো। সেসময় অনেক ধনী মিশরীয়রা এই প্রাণীদের পোষা প্রাণী হিসাবে রাখতেন।
ফারাওদের মৃত্যুর নিষ্ঠুর অন্তেষ্টিক্রিয়া
প্রাচীন মিশরে কোনো ফারাও মারা গেলে তার দেহ মমি করে পিরামিডের ভেতর রাখা হতো। মমি করার জন্য মৃতের হৃদপিণ্ড ছাড়া দেহের সকল অভ্যন্তরীন অঙ্গ অপসারণ করে পবিত্র ক্যানোপিক বয়ামে রাখা হতো। তারপর, মৃতদেহটি পানিশূন্য, তেলে ঢেকে, কাপড়ে মুড়িয়ে সমাধিতে রাখা হতো।
ফারাও মারা গেলে ফারাও এর সকল প্রিয় জিনিস ও ব্যবহৃত সম্পত্তি সমাধিতে সীলমোহর করে রাখা হতো। এসব ছাড়াও ফারাও এর মৃত্যুর পর তার সঙ্গী হতো তার একদল দাস।
প্রাচীন মিশরের প্রথম দিকের রাজবংশের সময়, যখন একজন ফারাও মারা যায়, তখন তার দাস এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাধারণত বিষ দিয়ে হত্যা করা হতো এবং তাদের শবদেহ ও ফারাও এর সমাধিতে রাখা হযতো। তখন বিশ্বাস করা হতো মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে এই দাসেরা ফারাও এর সেবা করবে।
প্রাচীণ মিশরের জাদুবিদ্যা
প্রাচীন মিশরে জাদুবিদ্যার খুব প্রচলন ছিলো। মিশরিয়রা বিশ্বাস করতো এই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে যাদুর মাধ্যমে। আর এই পৃথিবী চলছেও যাদুর মাধ্যমে।
প্রাচীন মিশরীয়দের নিকট জাদুবিদ্যা চিকিৎসা পদ্ধতিরও একটি অংশ ছিল। তাদের চারপাশের শুষ্ক ও ধূলাময় পরিবেশে কারণে শ্বাসকষ্টের মতো বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই ও শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকতো। এসব শারীরিক সমস্যার কারণ হিসেবে তারা দায়ী করতো কোনো দেবতার অভিশাপ বা কোনো খারাপ জাদুর প্রভাবকে আর সমাধানের জন্য শরণাপন্ন হতো জাদুবিদ্যার।
এছাড়াও যাদুবিদ্যা ছিলো প্রাচীন মিশরে ন্যায় বিচার করার আইনি মাধ্যম। প্রাচীন মিশের বেশ কিছু নথিপত্র ঘেটে তেমন কিছু বিচারের ঘটনাও পাওয়া গেছে। তবে সেইসব নথিগুলো প্রায়ই ফারাও এর হারেম ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত। সেই নথিগুলোতে মিশরের ফারাউ তৃতীয় রামেসিসের স্ত্রী ফারাউ কে হত্যার ষড়যন্ত্রের ঘটনা ও বিচারের কথা উল্লেখ আছে। ফারাউ এর স্ত্রী তাকে হত্যা করে নিজের ছেলেকে সিংহাসনে বসাতে চাইছিলেন আর তাই তিনি একজন জাদুকরের সাহায্য নিতে গিয়েছিলেন।
ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়, এবং অপরাধীদের শূলে চড়ানোর শাস্তি দেওয়া হয়। আর ফেরাউনের স্ত্রীকে তার নিজের জীবন নিজে নিতে অর্থাৎ আত্মঘাতীনি হতে বলা হয়।
বিড়াল কাহন
প্রাচীন মিশরে বিড়াল ছিলো অতি সম্মানিত প্রাণী। মিশরীয়রা বিড়ালের পূজো করতো। বাস্টেড নামে তো মিশরীয় পুরাণের এক দেবীও রয়েছেন। মিশরীয়রা নিয়মিত সেই দেবীর আরাধনা করতেন।
বিড়াল নিয়ে মিশরীয়রা একটু বেশিই সিরিয়াস ছিলেন। প্রাচীন ইতালির ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সিকুলাসের (৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) গল্প অনুসারে, রোমের একজন মানুষ মিশর ভ্রমণের সময় একটি বিড়াল হত্যা করেছিলেন। আর এই অপরাধের জন্য তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। তখন মিশরে বিড়াল হত্যা করা একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হত।
মিশরের সম্রাটের (ফারাউ) এর প্রাসাদের বিড়ালগুলোকে রাজার মতো সম্মান করা হতো। প্রাসাদের কোনো বিড়াল মারা গেলে রাজ্যে ৭০ দিনের শোক পালন করতো। আর বিড়াল মারা গেলে মিশরের ফারাউ কে ঐতিহ্য পালনের রক্ষাত্রে বিড়াল কে উৎসর্গ করে নিজের চোখের ভ্রু দুটো কেটে ফেলতেন।
প্রাচীন মিশরে বিড়াল ছিলো একই সাথে সম্মানিত ও শোষিত। যেহেতু বিড়াল ছিলো অতি সম্মানিত ও পূজনীয় প্রাণী তাই সে-সময় বিড়ালের মমি তীর্থযাত্রীদের কাছে স্যুভেনির (স্মারকচিহ্ন) হিসাবে বিক্রি করা হতো।
প্রাচীন মিশরে লক্ষ লক্ষ বিড়ালকে মন্দিরে হত্যা করা হয়েছিল এবং সেই বিড়ালের মৃতদেহকে মমি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিলো একটাই সেই মমি চড়া দামে দর্শনার্থী/ তীর্থযাত্রীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিড়ালই এই ধরনের নিষ্ঠুরতার শিকার একমাত্র প্রাণী ছিল না। তখন বেবুন, কুকুর, অ্যালিগেটর এবং পাখি সবই মমি করা হত এবং তা স্যুভেনির (স্মারক) হিসাবে বিক্রি হত। সেই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের প্রমাণ আজো রয়ে গেছে। মিশরের সাক্কা গ্রামেই পাওয়া গেছে প্রায় ৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ৭০ লক্ষ কুকুরের মমি।