প্রতিদিন কতো নতুন প্রাণের আগমন ঘটছে, আর সেই সাথে পৃথিবী ছেড়ে অসীম মহাকালের দিকে ছুটছে কতো হাজার, লক্ষ মানুষ তার হিসেব নেই।
জন্ম নিয়ে মানুষের যতটা না কৌতূহল রয়েছে, মৃত্যু নিয়ে রয়েছে তার চেয়ে বেশি, সাথে আছে একটু ভয়ও। অধিকাংশই মৃত্যুকে ভয় পায় এবং সহজ উপায়ে মৃত্যু কামনা করে থাকে।
প্রতিদিন হাজার হাজার দূর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তবে এই মৃত্যুর এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে এমন উদ্ভুত ও উদ্ভট মৃত্যু ইতিহাসের পাতায় ঘটে গেছে, তার জন্য তারা আজো স্মরণীয় হয়ে আছেন।
আজকের এই আর্টিকেলে তেমনই ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কিছু অদ্ভুত ও উদ্ভট মৃত্যু সম্পর্কে জানাবো।
মাথায় কচ্ছপ পড়ে মৃত্যু!
অ্যাস্কাইলাস প্রাচীন গ্রীসের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের একজন। তাকে সবচেয়ে বেশি স্মরন করা হয় তার লেখা ট্রাজেডিগুলোর জন্য। তাকে গ্রীক ট্রাজেডির জনকও বলা হয়।
অথচ তার মৃত্যুকে বিয়োগাত্মক নয়, বরং হাস্যরসাত্মকভাবে লোকমুখে শোনা যায়। অ্যাসকাইলাসের মৃত্যুর পর, খুব অল্প সময় বেঁচে থাকা এক রোমান লেখকের ভাষ্যমতে, গ্রীসের এই ট্রাজেডিয়ানের মৃত্যু হয়েছিল আকাশ থেকে পতিত হওয়া এক কচ্ছপের দ্বারা !
আপনি হয়ত ভাবছেন যে এটা কিভাবে সম্ভব! ঠিক আছে, তাহলে শুনুন।অ্যাসকাইলাইসের মাথাকে পাথর মনে করে এক ঈগল ভুল করে উপর থেকে এক কচ্ছপ ছুঁড়ে ফেলেছিল। ভেবেছিল শক্ত পাথরের আঘাতে তার শিকারের খোলসটা ভেংগে যাবে। কিন্তু হায়, ওটা পাথর নয় বরং অ্যাসকাইলাসের শক্ত মাথা ছিল! সাধারনত ঈগল পাখীরা তাদের শিকার করা কচ্ছপদেরকে পাথরের উপরই নিক্ষেপ করে থাকে। আর একটা ঈগলের ভুল সিদ্ধান্তেই এসকাইলাসের মৃত্যু হয়।
টেনিস খেলা দেখতে গিয়ে মৃত্যু
অষ্টম চার্লস ১৪৮৩ সালে যখন ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। এত অল্প বয়সে রাজ্য চালানোর মতো গুরুদায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না বলে তার রাজপ্রতিভূ হয়ে আসেন বড় বোন অ্যান এবং অ্যানের স্বামী ডিউক অগ বোর্বন। চার্লসের পুরো রাজত্বকালের অর্ধেক সময়ই বলতে গেলে তারা তার রাজপ্রতিভূ হয়ে ছিলেন। ঝামেলাকে বরাবরই এড়িয়ে চলতে চাওয়া এই রাজার মৃত্যু এতটা অদ্ভুতভাবে হয়েছিল যে, সেভাবে যে আসলেই কারো মৃত্যু হতে পারে সেটাই কল্পনা করা যায় না।
টেনিস খেলার কারণেই মৃত্যু হয় রাজা অষ্টম চার্লসের। তবে সেখানে তিনি খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন না, ছিলেন কেবলই একজন দর্শক হিসেবে। চলাচলের একপর্যায়ে একটি দরজার উপরের দিকের কাঠের সাথে সজোরে ধাক্কা খান রাজা। তখন সেই ব্যথাকে উড়িয়ে দিলেও খেলা শেষ হবার পরপরই তিনি কোমায় চলে যান। ঘণ্টাখানেক পরই মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েন তিনি।
নিজের দাড়িতে হোঁচট খেয়ে মৃত্যু
১৫৬৭ সাল। তখন গিনেস বুক অব রেকর্ড-এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। থাকলে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে লম্বা দাড়ি রাখার জন্য হ্যান্স সেইনিনগারের নাম ওঠা কেউ ঠেকাতে পারত না। তার দাড়ি ছিল দেড় মিটার লম্বা। ওই দাড়ির জন্যই তার খ্যাতি এবং মৃত্যুও! ইতিহাস বলছে, একবার আগুনের হাত থেকে পালাতে গিয়ে দাড়িতে পা জড়িয়ে পড়ে যান হ্যান্স। বেকায়দায় পড়ার ফলে ঘাড় ভেঙে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার!
শরীরে থাকা ব্যান্ডেজ থেকে মৃত্যু
১৩৪৩ থেকে ১৩৮৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৪ বছর নাভারের শাসনভার পরিচালনা করেছেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মাঝে চলমান হান্ড্রেড ইয়ার্স ওয়্যারের সময় তিনি সুবিধাবাদীর ভূমিকা পালন করেছেন। যখন যে পক্ষ থেকে কিছু লাভ করা যায়, তখনই সেই পক্ষে যোগ দিয়েছেন। ফলে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘চার্লস দ্য ব্যাড’ নামে।
একবার রাজা দ্বিতীয় চার্লস ভয়াবহ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাকে যেন গলা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত পুরো দেহ লিনেনের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়, যে কাপড় আবার ব্র্যান্ডিতে সিক্ত হতে হবে। চিকিৎসকের একজন সহকারী এটা সেলাই করে দিলেন, যেন রাজার গায়ে ভালোমতো তা আটকে থাকে। সেলাই শেষে দেখা গেলো কিছু বাড়তি অংশ রয়ে গেছে। এই কাজটি করা হয়েছিল রাতের বেলায়। সেই সহকারী চাননি কেঁচি দিয়ে সেটি কাটতে এই ভয়ে যে, যদি তাতে রাজার গায়ে আঁচড় লেগে যায়! তাই তিনি আগুন দিয়েই সেই বাড়তি অংশ নেভাতে চেয়েছিলেন। আফসোস, ব্র্যান্ডিতে সিক্ত কাপড়টি আগুনের সংস্পর্শে আসতে না আসতেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ফলে অগ্নিদগ্ধ হয়েই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হন রাজা।
অতিরিক্ত খাবার খেয়ে মৃত্যু হয়েছিল রাজা অ্যাডলফ ফ্রেডরিকের
সুইডিশ রাজা অ্যাডলফ ফ্রেডরিক ‘সেমলা’ ক্রিম রোল নামে একটি স্থানীয় মিষ্টির প্রতি আসক্ত ছিলেন। তাই একবার, ক্যাভিয়ার, গলদা চিংড়ি এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবার ভোজনের পরে, রাজা এক সাথে এক ডজনেরও বেশি ‘সেমলা’ খেয়ে ফেলেছিলেন।
বলাই বাহুল্য, বিপুল পরিমাণ খাবার রাজা আর হজম করতে পারেন নি।
কিছুক্ষণ বাদে অনুভব করেন তার পেট খারাপ হয়েছে। সময় বাড়ার সাথে সাথে অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। একটা সময়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসের পাতায় তিনিই একমাত্র রাজা যিনি অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার ফলে মৃত্যুবরণ করেছেন।
মদের পিপেতে ডুবে মৃত্যু!
এবার একটু ভিন্ন ঘটনা। অন্যান্য মৃত্যগুলোকে দূর্ঘটনা বলা যেতে পারে, কিন্তু জর্জ প্লানটাগেনেট নিজেই নিজের জন্য এক বিচিত্র মৃত্যুভাগ্য নির্ধারন করেছিলেন। “War of the roses” এ পরাজয়ের পর তার ভাই চতুর্থ এডওয়ার্ড এর আদেশে তাকে বন্দী করা হয়, হত্যা করা হবে তাকে। কিন্তু ভ্রাতৃপ্রেম বলে একটা কথা আছে।
এডওয়ার্ড তার ভাইকে নিজের মৃত্যুর প্রক্রিয়া নিজেকেই বাছাই করতে বললেন। এরপর জর্জ এমন এক সৃজনশীলতার পরিচয় দিলেন যার কারনে মানুষ তাকে যুগ যুগ ধরে স্মরন করে আসছে। শিরশ্ছেদনের কথা না বলে জর্জ প্লান্টাগেনেট ইচ্ছে প্রকাশ করলেন তাকে যেন মদভর্তি পিপেতে ডুবিয়ে মারা হয় ! তার প্রিয় মদ, মালভাসিয়াতে ডুবিয়ে ! এবং তার ইচ্ছামতই তাকে মদভর্তি পাত্রে ডুবিয়ে মারা হয়!
ফ্রান্সিস বেকনের মুরগী পরীক্ষা
১৬২৫ সালের এক বিকেলে জনপ্রিয় সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস বেকন মাংস প্রিজার্ভ করার জন্য একটা পরীক্ষা চালাতে মুরগি বেছে নেন। সেই বিকেলে তিনি দেখতে চাইছিলেন যে তুষারে মাংস ফ্রজেন হয় কিনা। এই উদ্দেশ্যে মুরগি নিয়ে তুষারে মধ্যে থাকার সময় ফ্রজেন হয়ে যান বিখ্যাত এই লেখক।
উল্কার আঘাতে মৃত্যু
ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বলে, ভূপতিত উল্কা সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাওয়ার অনুপাত হল ১:১৬০০০০০। কামারাজ হলেন সেই হতভাগ্য একজন ব্যক্তি, যার মৃত্যু উল্কার আঘাতে হয়।
২০১৬ সালের ঘটনা, এই ভারতীয় বাস ড্রাইভারই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যার মৃত্যু হয়েছিল একটা উল্কাপিন্ডের আঘাতে। বাস চালানোর সময় হঠাত আকাশ থেকে একটা পাথর বাসের উপর তীব্র গতিতে ছিটকে পড়ে। প্রচন্ড আঘাতে মারা যান কামারাজ, আহত হন আরো তিন জন ব্যক্তি। অবশ্য এ ঘটনায় নিহত আরো অনেকে থাকলেও কামারাজের মৃত্যুটাই প্রথম রেকর্ড করা হয়েছে।
রাজকীয় নিয়ম পালন করতে গিয়ে মৃত্যু
রাজকন্যার জীবন সব দিক থেকে সমৃদ্ধ হওয়ারই তো কথা! সে খাতেই বইছিল থাইল্যান্ডের রাজা মোংকুট এবং রানি পিয়ামের কন্যা সুনন্দা কুমারীরত্নর জীবন। ১৮৬০ সালে আক্ষরিক অর্থেই সোনার চামচ মুখে জন্মান তিনি। বয়স বাড়তে থাকে, রূপে-গুণে সবার মন জয় করতে থাকেন রাজকন্যা। আনন্দে কাটতে থাকে জীবন, পার করে ফেলেন উনিশটি বছর।এবং, ওই উনিশে যখন পা, ১৮৮০ সালে জীবনের খাতে ঢুকে যায় বেনোজল। সপরিবারে আনন্দ উদযাপনের জন্য গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে যাচ্ছিলেন রাজকন্যা। নদীর বুকে ভেসে চলেছিল বজরা। বজরায় মায়ের সঙ্গে ছিলেন সুনন্দা। হঠাৎই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। নৌকাডুবি হয়। সবার চোখের সামনে জলে তলিয়ে যান মেয়ে সুনন্দাকে নিয়ে রানি পিয়াম। কারণ, দেহরক্ষীদের তাঁদের স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না। এই রাজকীয় নিয়ম পালন করতে গিয়ে তাঁরা রানি আর রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে পারেননি!
নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখে হার্ট অ্যাটাক!
ফ্যাগিলু মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই! এ ক্ষেত্রে ছোটগল্পের কাদম্বিনীও যা, রাশিয়ার ফ্যাগিলু মুখামেটজিয়ানভও তাই! ২০১১ সাল পর্যন্ত স্বামী ফ্যাগিলির সঙ্গেই রাশিয়ার কাজানে তাঁর দাম্পত্য ছিল ঠিকঠাক।
সমস্যা দেখা দিল এক রাতে, যখন বুকে ব্যথা শুরু হল মহিলার! যা করণীয়, তাই করা হয়। বছর একান্নর স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যান স্বামী। ভর্তি করা হয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। ১২ মিনিটের মাথায় ডাক্তাররা জানান, ফ্যাগিলু আর বেঁচে নেই।শুরু হয় শেষকৃত্যের আয়োজন। কফিনে দেহ নিয়ে পরিজনরা পৌঁছন গোরস্থানে। মাটি খোঁড়া হয়। শুরু হয় অন্তিম প্রার্থনা।এই সময়ে সবাইকে অবাক করে কফিনের মধ্যে নড়ে-চড়ে ওঠেন ফ্যাগিলু! তাকান চোখ মেলে। শুনতে পান, ধর্মযাজক তাঁর আত্মাকে এই পৃথিবী ছেড়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন।পুরো ব্যাপারটায় এতটাই অবাক হন মহিলা যে এবার সত্যিই হার্ট অ্যাটাক হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়!
দেহের ভেতরে আগুন লেগে পুড়ে ছাই!
ধরুন, আপনি ঘরে বসে আপন মনে মদ পান করছেন। অনেকটা পান করার পর সিগারেট ধরাতে গিয়ে আপনার মুখের মধ্যে চলে গেল জ্বলন্ত সিগারেটের খানিকটা ফুলকি। ব্যস আপনার গলা থেকে পেট অবধি জ্বলতে শুরু করলো, আপনি মাটিতে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন!
খুব সম্ভবত এরকমটাই ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমার বাসিন্দা ডেনি ভ্যানজান্ডটের ভাগ্যে। তার ফ্ল্যাটে যখন তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়, তখন তখন আর তাকে চেনার উপায় নেই। অটোপসি করার পর ডাক্তাররা জানান, ড্যানির মৃত্যু হয়েছে মৃদু আগুনে দীর্ঘক্ষণ ঝলসে, যার উৎপত্তি তার দেহের ভিতরেই! তাছাড়া মৃতদেহের আশেপাশে অক্ষত আসবাবপত্র দেখেও পুলিশের মনে হয়েছে বাইরে থেকে নয়, বরং ড্যানির সিগারেটই আগুনের উৎপত্তি ঘটিয়েছিল।
জর্জ রিচমান ও বজ্রপাত
রিচম্যান ছিলেন একজন জার্মান ডাক্তার ও বিজ্ঞানী। তবে তিনি থাকতেন রাশিয়ায়। যে বছর বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন উড্ডয়ন যন্ত্র তৈরি করেন তার পরের বছর ১৭৫৩ সালে তিনি অনেকটা ঘুড়ির মতো একই রকম আরেকটি যন্ত্র তৈরি করেন। একদিন একাডেমি অব সায়েন্সের এক সভায় তিনি অংশগ্রহণ করছিলেন। সে সময় তিনি বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পান। বজ্র পাতকে কাছ থেকে দেখার আশায় তার উড্ডয়ন যন্ত্র নিয়ে ওড়েন আকাশে। পর্যবেক্ষণ চলাকালীন বিদ্যুৎ চমকায় এবং বজ্র পাতে মারা যান তিনি।
ফ্রাঞ্জ রিচেল এর আইফেল টাওয়ার থেকে লাফ
ফ্রাঞ্জ রিচেল্ট ওড়ার জন্য এক ধরনের ওভারকোট তৈরি করেছিলেন, যা আধুনিক প্যারাসুটের মতো কাজ করবে। তার এই আবিষ্কার পরীক্ষা করার জন্য তিনি সেই সময়কার সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা আইফেল টাওয়ারের ফার্স্ট ডেক (৬০ মিটার) থেকে লাফ দেন। তিনি ভেবেছিলেন তার ওভারকোটটি খুলে যাবে এবং তিনি নিরাপদে মাটিতে নেমে আসবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্যারাসুটটা কাজ না করায় তিনি মাটিতে পড়ে মারা যান।