You are currently viewing ইতিহাসে অদ্ভুত কারণে সংঘটিত হওয়া কিছু যুদ্ধ

ইতিহাসে অদ্ভুত কারণে সংঘটিত হওয়া কিছু যুদ্ধ

যুদ্ধ হওয়া নিয়ে এক বা একাধিক পক্ষের স্বার্থ জড়িত থাকে। তবে ইতিহাসে এমন অদ্ভুত কিছু কারণে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ ঘটে গেছে। সেসব আপনি এখন শুনলে, হাসতে হাসতে হয়তো বলবেন, আরে! এসব কারনেও কি যুদ্ধ হয় নাকি?

চলুন আজ তেমনই অদ্ভুত কারনে সংঘটিত হওয়া কিছু যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যাক।

১. শুকরের জন্য যুদ্ধ (দ্য পিগ ওয়ার)

নাম শুনে অদ্ভুত মনে হলেও আসলে ইতিহাসে তেমনই ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অন্যতম ২ পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যুদ্ধ করেছে একটি মাত্র শুকরের জন্য!


যুক্তরাষ্ট্রের মেইনল্যান্ড ও ভ্যানকুভারের মাঝখানে অবস্থিত সান ঝু দ্বীপে নিজেদের দখলদারিত্ব নিয়ে সবসময়েই বেশ ঝামেলা চলছিল যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। আমেরিকান বাসিন্দা এবং ব্রিটিশ হাডসন বে কোম্পানির কর্মী দু পক্ষের বাসস্থান ছিল সান ঝু। নিজেদের জমিজমা নিয়ে সমস্যা যে তাদের মধ্যে তৈরি হতো না তা নয়। তবে সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে ১৮৫৯ সালের ১৫ জুন।

সেই ঘটনাকে নিয়ে আঁকা কার্টুন ছবি credit: Washington our home

আমেরিকান নাগরিক লাইম্যান কাটলার এদিন নিজের আলুর জমিতে শূকর দেখতে পেয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন। ফলে ক্ষেপে যায় ব্রিটিশরা। পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখায় তারা কাটলারকে। আমেরিকান সামরিক বাহিনী ঘটনাটি জানতে পারলে ক্যাপ্টেন জর্জ পিকেট সৈন্যদের নিয়ে চলে আসেন সান ঝু-তে। আমেরিকা সৈন্য পাঠিয়েছে, ব্রিটিশরা কি বসে থাকবে নাকি? চলে এল ব্রিটিশদের ভারী নৌবাহিনী। কয়েক সপ্তাহ প্রচন্ড গোলমালের পর অবশেষে অক্টোবরে শান্তিচুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। দুই দেশের সামরিক বাহিনী সান ঝু দ্বীপের অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। একটা শূকরের কারণে পুরো সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ, ভাবা যায়?

২. কান নিয়ে যুদ্ধ (ওয়ার অব জেনকিন্স ইয়ার)

আঠারোশ শতকের একদম শুরু হতেই ব্রিটিশ এবং স্প্যানিশদের মাঝে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। এর মূল কারণ ছিলো আমেরিকায় এই দুই দেশের কলোনির দখল করা বিভিন্ন জমি-জমার অংশ নিয়ে বিবাদ। সবচেয়ে বেশি ঝামেলা তৈরি হয়েছিলো স্পেন অধিকৃত ‘ফ্লোরিডা’ এবং ব্রিটেন অধিকৃত ‘জর্জিয়া’ এর সীমানা নিয়ে। তাদের মাঝে এ নিয়ে খুটখাট লেগেই ছিলো। সেই খুটখাটের অংশ হিসেবে দেখা যেতো সমুদ্রে তাদের জাহাজগুলোর মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ দুই-চারটা কামানের গোলা বিনিময় হচ্ছে।
ব্রিটেন এবং স্পেনের মাঝে করা বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেনের জাহাজ আমেরিকার স্পেন অধিকৃত অঞ্চলের বন্দরে ভিড়ে সেখানে বিভিন্ন পণ্য এবং ক্রীতদাস বিক্রয় করতে পারতো। এমন এক জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন ‘রবার্ট জেনকিনস’। ১৭৩১ সালে এক স্প্যানিশ কোস্ট-গার্ড অফিসার জেনকিনসের সাথে বচসায় লিপ্ত হয়। স্পেন এবং ব্রিটেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কোস্ট-গার্ড অফিসাররা সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষ দেশের জাহাজে উঠে তাদের হয়রানি করা শুরু করতো। সেই হয়রানি থেকেই হলো বচসার সূত্রপাত এবং এক পর্যায়ে সেই অফিসার জেনকিনসের কান কেটে নিলো।
এই ঘটনায় শুধু জেনকিনসেরই কান কাটা গেলো না। সেই সাথে কান কাটা পড়লো ব্রিটিশদেরও। তবে কান যে কাটা গেছে সেটা বুঝতে ব্রিটিশদের সময় লাগলো মাত্র সাত বছর!

Credit: British tars

যুদ্ধ বাঁধলো যেভাবে

১৭৩৮ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা টের পেলো অনেকদিন কোথাও যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে না পেরে জীবনটা কেমন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো- যেহেতু স্পেনের সাথে এই মূহুর্তে তাদের সম্পর্ক ভালো না, তাই তারা স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। কিন্তু যুদ্ধের একটা ইস্যু তো লাগবে। পার্লামেন্টে সেটা নিয়ে আলোচনার সময় বেরিয়ে এলো জেনকিনসের কাহিনী, যার কান সাত বছর আগে স্প্যানিশরা কর্তন করেছিলো। সেই ঘটনা শুনে তারা জেনকিনসকে পার্লামেন্টে ডাকলো শুনানি করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে। সেই শুনানিতে আসার পর যখন সবাই দেখলো তিনি শুনানির কোনো কিছু ভালোমতো শুনতেই পারছেন না, তখন ঘটনার সাত বছর পরে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের লজ্জায় কান কাটা গেলো। তারা স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো ১৭৩৯ সালে।
যুদ্ধ মোটামুটি দুই বছরের মত চলেছিলো। এই দুই বছরে উল্লেখ করার মত তেমন কিছুই ঘটেনি। ফ্লোরিডা এবং জর্জিয়ায় যেসব যুদ্ধ হয়েছিলো তাতে কোনো পক্ষই তেমন সুবিধা লাভ করতে পারেনি। নিউ গ্রানাডায় (বর্তমানের কলাম্বিয়া) ব্রিটিশরা সফল আক্রমণ করলেও মাস-খানেক পরে জঙ্গলের ভেতরে মশার কামড় খেয়ে অসুখে ভুগে সবকটাই মারা গিয়েছিলো। ক্যারিবিয়ান উপসাগরে এবং ভেনিজুয়েলার উপকূলে কিছু যুদ্ধ হয়েছিলো নামেমাত্র।

১৭৪২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা বাইরে এখানে-সেখানে দু-চারটা কামানের গোলা দাগালেও সরাসরি স্পেন আক্রমণের চিন্তা করেনি। কারণ তাদের ভয় ছিলো – স্পেন আক্রমণ করলে ফ্রান্সও তাদের সাথে যোগ দিয়ে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। কিন্তু ১৭৪২ সালেই চিত্রপট পুরো পালটে গেলো। এই জেনকিনসের কান নিয়ে যুদ্ধটাই শেষমেশ গড়ালো অস্ট্রিয়া এরউত্তরাধিকারীর যুদ্ধে। পুরো ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়ে গেলো অস্থিরতা। দেখা গেলোফ্রান্স ঠিকই স্পেনের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে নেমে গেছে। এই যুদ্ধ হতেই উদ্ভূত হলো ইতিহাসের সাত বছর ব্যাপী যুদ্ধের, ১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩।

যুদ্ধে কে জিতেছিলো? কে হেরেছিলো?

পুরো ইউরোপ তাদের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে যাবার আগ পর্যন্ত যদি প্রথম দুই বছরে ব্রিটেন এবং স্পেনের মধ্যেকার মূল ‘জেনকিনসের কান নিয়ে যুদ্ধ’ কে বিবেচনায় নিই, তাহলে বলা যায়- কোনো পক্ষই জেতেনি। কারণ সেই যুদ্ধটা ছিলো অনেকটা দুই বৃদ্ধ মানুষের ছাতা হাতে নিয়ে লড়াই করার মত। কিন্তু সেই লড়াইটা যখন পুরো ইউরোপ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো ‘অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ’ এবং ‘সাত বছর ব্যাপী যুদ্ধ’ এর মাধ্যমে, তখন সেটার ফলাফল স্বরূপ ব্রিটিশরা আবির্ভূত হলো সুপারপাওয়ার হিসেবে। এই যুদ্ধের কারণেই আমেরিকার উত্তর অংশে ব্রিটিশরা তাদের দাবি শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলো।

৩. দি পেস্ট্রি ওয়ার

১৮২৮ সালে মেক্সিকোতে একটি পেস্ট্রির দোকান ছিল এক ফ্রেঞ্চ শেফের। মেক্সিকোতে তখন বিদ্রোহ চলছিল। বিদ্রোহের সময় বেশ কিছু দোকানপাট লুটপাট হয়, অনেক দোকান নষ্ট করে দেয় মেক্সিকোর বিদ্রোহী জনগণ।

Credit: J mark paul

তাদের ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হলে শেফ যায় মেক্সিকান প্রশাসকের কাছে নিজের দোকানের মালামাল বাবদ ক্ষতিপূরণ চাইতে। কিন্তু প্রশাসনের তো অত সময় নেই। শেফের কথা পাত্তা দেয়নি তারা। কিন্তু দোকানটা ছিল শেফের একমাত্র সম্বল।

মেক্সিকো কিছু করলো না দেখে নিজের দেশ ফ্রান্সে গিয়ে অভিযোগ তোলে শেফ। সেখানেও অভিযোগ পড়ে থাকে প্রায় এক যুগ। অনেকদিন পর অভিযোগনামা চোখে পড়ে রাজা লুইস ফিলিপের। ফলাফল গড়ায় অনেক দূর পর্যন্ত। এমনিতেও মেক্সিকোর উপরে বেশ ক্ষেপে ছিলেন লুইস ফিলিপ। এই ঘটনার জের ধরে ঐ শেফকে ৬,০০,০০০ পেসো দেওয়ার দাবী জানান তিনি। এতগুলো পেসো দিতে চায়নি মেক্সিকো কোনোভাবেই। ব্যস, শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ।

১৮৩৮ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোতে ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ চলে আসে। প্রায় ২৫০ জন সৈনিক মারা যায় যুদ্ধে। অবশেষে ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধ থামে। শেষমেশ ৬,০০,০০০ পেসো দিতে হয় তাদের ফ্রান্সের সেই পেস্ট্রির দোকানের মালিককে।

৪. কুকুর নিয়ে যুদ্ধ (দি ওয়ার অব স্ট্রে ডগ)

শুকর নিয়ে যুদ্ধের ঘটনা তো শুনেছেন, এবার শুনুন কুকুরের কারনে যুদ্ধ হওয়ার ঘটনা। ১৯১০ সালে বলকান যুদ্ধের পর প্রতিবেশী দুই দেশ গ্রীস ও বুলগেরিয়ার মধ্যে ক্ষোভ একটু একটু করে বাড়ছিলো।

Credit: War history

আর সেই ক্ষোভের ঘিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় এক কুকুর। গ্রীসের বর্ডার পার হয়ে বুলগেরিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল কুকুর। তার পেছন পেছন কখন যে গ্রীক সৈনিক নিজের দেশ ছেড়ে বুলগেরিয়ায় চলে এসেছে সেটা খেয়াল করার সময় পায়নি। কিন্তু তাতে কী? এতদিন পর শত্রুদেশের কাউকে সামনে পেয়ে দেরী না করে তাকে গুলি করে মেরে ফেলে বুলগেরিয়ার সৈন্যরা।

পুরো গ্রীসে যেন আগুন লেগে যায় এই ঘটনার পর। আক্রমণ করে গ্রীস বুলগেরিয়ায়। ফলাফল আরো খারাপ হওয়ার আগেই তৎকালীন লীগ অব নেশন বা জাতিপুঞ্জ শান্তিচুক্তি করে যুদ্ধ থামিয়ে দেয় দুই দেশের মধ্যে। তবে তার আগেই অবশ্য এই যুদ্ধের কারণে মৃত্যু হয় ৫০ জনের!

৫. দি নিকা রায়ট

এই যুদ্ধটিকে যুদ্ধের চেয়ে গৃহযুদ্ধ বলাই বেশি শ্রেয়। খ্রীস্টপূর্ব ৫৩২ সালের কথা। সেসময় কন্সটান্টিপোলে (মানে বর্তমানে তুরষ্কের ইস্তাম্বুল) ঘোড়দৌড় ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। তবে কেবল খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না এটি। তার চাইতে অনেক বড় আর মারদাঙ্গা একটা রূপ নিয়েছিল এই ঘোড়দৌড়। বিশেষ করে দুই প্রতিযোগী দল নীল আর সবুজ দল খেলার মাঠের বাইরেও একে অন্যের শত্রু হয়ে পড়েছিল। এই দুই দলের দুজন সদস্যকে শাসক জাস্টিনিয়ান মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। তার এই সিদ্ধান্তের ফলাফল দাঁড়ায় ভয়াবহ।

Credit: History Collection

নিজেদের এই বিপদে এক হয়ে যায় নীল আর সবুজ দল। সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ করে বসে তারা। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই রাজধানী পুড়ে শেষ হয়ে যায়। রাজকীয় সৈন্যদের প্রায় হারিয়ে দেয় বিদ্রোহীরা। জাস্টিনিয়ানকে শাসকের পদ থেকে সরিয়ে নতুন শাসক ও শাসনব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা করে তারা। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কত দূর গড়াতো কে জানে, তবে এই ঝামেলার ভেতরে জাস্টিনিয়ান নীল দলকে ঘুষ দিয়ে নিজের দলে টেনে নেন। থেমে যায় বিদ্রোহ। এরপরও যারা লড়াই করছিল তাদেরকে মেরে ফেলা হয়। সর্বমোট প্রায় ৩০,০০০ মানুষ মারা যায় এই গৃহযুদ্ধে।

Reference: weird history, history. Com, medium

Leave a Reply