দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কাল থেকে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকের সময়ে সাহিত্যজগতে এক নতুন ধারার নাটক জনপ্রিয় হতে শুরু করে যা পরিচিতি পায় ‘অ্যাবসার্ড ড্রামা’ নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবের ফলাফল স্বরূপ ইউরোপ তখন পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষের তখন চাকরি নেই,অর্থ নেই, খাবার ও বাসস্থানের সংকট। এত এত সব সমস্যার মাঝে মানুষের জীবনকে তখন তুচ্ছ বলে মনে হতে থাকে। সবকিছুই যেনো শূন্য আর অর্থহীন। বিশ্বযুদ্ধের ফলে মানুষের মধ্যকার এই শূন্যতা ও জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে না পাওয়ার যে হতাশা সে সবকিছুই এই ধরনের নাটকের মধ্যে উঠে এসেছে।
এই নতুন ধরনের নাটকের সবচেয়ে ইউনিক বিষয়বস্তু হলো, অন্যান্য নাটকে যেরকম অনেক ঘটনা, চরিত্র কিংবা ক্লাইম্যাক্স দেখতে পাওয়া যায়, এখানে তার কিছুই দেখা মেলে না। এই ধরনের নাটকে কোন গল্প নেই, নাটকের চরিত্র সংখ্যা থাকে খুবই কম। নাটকে বলার মতো তেমন অসাধারণ কোনো সংলাপ থাকে না। নাটকের চরিত্রদয়ের কথাবার্তা হয় খুবই কম বেশিরভাগই কাটে নিরবতায়। আর যেসব কথাবার্তা হয় তার বেশিরভাগই অর্থহীন। আর মাত্র একটি স্থানেই পুরো নাটকের সবকিছু ঘটে যায়। উপর থেকে দেখলে মনে হবে এই নাটকের কিছুই নেই। কিন্তু নাটকের অন্তর্নিহিত বিশাল অর্থ আছে; যা নাটকের দর্শকদের গভীর চিন্তা ও উপলব্ধি করাবে।
অ্যাবসার্ড নাটকের ধারণাটি এসেছে বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও দার্শনিক আলবার্ট কামুসের লেখা বই ‘The Myth of Sisyphus’ থেকে যা ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে আলবার্ট কামুস তার জীবন দর্শনকে ব্যাখ্যা করেছেন অনেকটা এভাবে যে, মানুষ বাস্তবত একটি অর্থহীন ও শূন্য জগতে বাস করে। অ্যাবসার্ড বলতে কামুস বুঝাতে চেয়েছেন মানুষের জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা ও জীবনের অর্থহীনতার সংঘাতকে। মানুষ তার জীবনের উদ্দেশ্য ও অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে কিন্তু এই পৃথিবী তা দিতে অক্ষম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জনপ্রিয় হওয়া এই নতুন ধরনের নাটকের মধ্যে বিখ্যাত নাট্যকারদের মধ্যে স্যামুয়েল ব্যাকেট, ইউজিন আয়নেস্কো,জ্যাঁ জেনেট ও হ্যারল্ড পিন্টার অন্যতম।তবে তাদের মধ্যে স্যামুয়েল ব্যাকেট এই ধরনের নাটকে নিজেকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। এই ধরনের নাটকে তার বিশেষ অবদানের জন্য তাকে এই ধরনের নাটকের গ্র্যান্ড মাস্টার বা ফাদার বলা হয়।
স্যামুয়েল ব্যাকেটের লেখা নাটকের সংখ্যা অনেক। তবে তার অ্যাবসার্ড নাটকের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ টির মতো। ওয়েটিং ফর গডো তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা, যা তাকে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত করেছে, সেই সাথে পুরো বিশ্বে খ্যাতি এনে দিয়েছে। সেই সাথে সাহিত্যে তিনি এক নতুন ধারার বিপ্লবের জন্ম দিয়েছেন।
স্যামুয়েল ব্যাকেট তার বিখ্যাত নাটক ওয়েটিং ফর গডো রচনা করেছিলেন ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে ফরাসি ভাষায়। তখন তার নাম ছিল ‘En attendant Godot’, পরবর্তীতে স্যামুয়েল ব্যাকেট নিজেই তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
স্যামুয়েল ব্যাকেট এই নাটকটি লিখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক পরপরই। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষের হতাশা, যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিণতি, জীবনের শূন্যতা ও মানুষের জীবনের অস্তিত্বের সংকট এই নাটকের উপজীব্য হয়ে ওঠে।
নাটকটি মাত্র দুটি অ্যাক্ট বা অঙ্কে বিভক্ত। আর দুটি অ্যাক্টেই একই জিনিস পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। এই নাটকের প্রধান দুটি চরিত্র হলো ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন। আর বাকি তিনটি চরিত্র হলো পোজো, লাকি ও একটি বালক।
নাটকের শুরুতে দেখতে পাওয়া যায় ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন একটি নির্জন রাস্তার পাশের পাতাবিহীন একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গডোর জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের দুজনের কেউই জানেন না এই গডো কখন আসবেন। সময় কাটাবার জন্য তারা ছোটছোট অর্থহীন কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ড করতে থাকেন। তারা একে অপরকে বলে চলো এই গাছে আমাদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ি, কিন্তু শেষমেশ কেউই তা করে না।
এ সময় পোজো নামের এক ধনী লোক তার দাস লাকিকে নিয়ে উপস্থিত হয়। লাকির গলায় পোজো একটি দড়ি বেঁধে রেখেছে আর দড়ির মাথা পোজোর হাতে। পোজোর ব্যাগ লাকি সর্বদা বহন করে চলে। আর ইচ্ছে করলেই পোজো তার হাতে থাকা বেল্ট দিয়ে লাকিকে প্রহার করে। সেই সাথে সে লাকিকে পিগ অর্থাৎ শুকর বলে গালমন্দ করে।
পোজো ভ্লাদিমিরকে বলে সে লাকির মাধ্যমে বিনোদন নেবে কিনা, লাকি নাচতে পারে। পোজোর নির্দেশে লাকি নাচতে থাকে এবং একটি অদ্ভুত দীর্ঘ ও অর্থহীন বক্তৃতা দেয়। এরপর পোজো ও লাকি দুজনেই সেই স্থান ত্যাগ করে। এস্ট্রাগন ও তাদের সাথে এই জায়গা ত্যাগ করে চলে যেতে চায়। ভ্লাদিমির তখন বলে তারা গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। পোজো ও লাকি চলে গেলে একটি ছোট বালক তাদের সামনে উপস্থিত হয়। সে তাদেরকে জানায় যে আজ গডো আসবে না। এস্ট্রাগন ভ্লাদিমিরকে বলে যেহেতু আজ গডো আসবে না তাই চলো আজ আমরা চলে যাই। তখন ভ্লাদিমির বলে আগামীকাল আবার গডোর জন্য আমাদের এখানেই আসতে হবে। চলো এখানে বসেই অপেক্ষা করি।
রাত কেটে যায় আবারো আগের দৃশ্যের মতোই একইভাবে সব চলতে থাকে। অবশ্য স্ট্রাগনের গতকালের ঘটনা কোন কিছুই মনে নেই। ভ্লাদিমির চেষ্টা করেও তাকে কিছু মনে করতে পারে না। আগের সবকিছু সে বেমালুম ভুলে গেছে।
একটু পর তারা দুজন দেখতে পায় পোজো ও লাকি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এবার তাদের দুজনের মধ্যকার কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পোজো অন্ধ হয়ে গিয়েছে আর লাকি বোবা হয়ে গিয়েছে। এস্ট্রাগনের এবার আগের দিনের সামান্য স্মৃতি মনে পড়ে। গতকাল লাকি তাকে একটি লাথি মেরেছিলো। আগের দিনের মতো পোজো ও লাকি উভয়েই সেখান থেকে চলে যায়।
ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন উভয়ই সেখানে থেকে যায়। তারা গডোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আবারো গতকালের সেই ছোট বালকটি সেখানে উপস্থিত হয়। সে তাদের দুজনকে জানায় গডো আজকেও আসবে না। গডো আজকে আসবে না কিন্তু আগামীকাল নিশ্চয়ই আসবে সেই আশায় তারা দুজন আবারো অপেক্ষা করতে থাকে। আর এভাবেই নাটকের সমাপ্তি হয়ে যায়।
এই নাটকে গল্প, অ্যাকশন কিংবা ক্লাইম্যাক্স কোন কিছুই নেই। কোন অসাধারণ বা ভালো সংলাপ নেই। বেশিরভাগই খুবই ছোট ও অর্থহীন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে কিছুই ঘটছে না। কিন্তু নাটকের একটা বিশাল অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে যা নাটকের দর্শকদের চিন্তাভাবনা ও উপলব্ধি করে নিতে হবে।
এই নাটকের শুরুতেই যে বিষয়ে প্রশ্ন জাগে তা হল গডো! এই গডো আসলে কে? স্যামুয়েল ব্যাকেটকে একবার গডোর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিলো।
সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
If I know, I would have said so in the play.
স্যামুয়েল ব্যাকেট নিজেও জানতেন না গডো আসলে কে? কিন্তু পাঠক ও দর্শকদের তা উপলব্ধি করে নিতে হবে। একেকজনের দৃষ্টিতে একেক রকম মনে হবে। কারো কাছো Godot আসলে God অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা। নাটকের দুই চরিত্র মূলত সৃষ্টিকর্তা ও তার করুণার অপেক্ষা করছেন। কারো মতে গডো হলো পূর্নাঙ্গ এক পৃথিবী যার জন্য অপেক্ষা করছে পুরো পৃথিবীর মানুষ। আবার কারো কাছে গডো হলো এমন কিছু যা আমরা সবাই চাই কিন্তু কখনোই তা পাই না।
খুবই সাধারন ও অর্থহীন নাটক মনে হলেও স্যামুয়েল ব্যাকেট সিম্বল অর্থাৎ প্রতীকের মাধ্যমে দর্শকদের অনেক বার্তা দিয়েছেন এই নাটকের মাধ্যমে। পুরো নাটকে স্থান ছিল মাত্র একটি। একটি নির্জন রাস্তা ও পাতাবিহীন একটি গাছ নির্দেশ করেছে যুদ্ধের বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের ফলে ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলেই এমন নিশ্চুপ ও ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। এই নির্জনতা ও গাছের প্রতীকের মাধ্যমেই তিনি দেখিয়েছেন মানব সভ্যতার পতনের ঘটনাকে। এছাড়াও নাটকে তিনি অস্তিত্ববাদ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতায় নিরীহ মানুষ প্রান হারাচ্ছে কিন্তু মানুষ গডোর অপেক্ষা করেও ফলাফল আদৌও কিছু পাচ্ছে না।
নাটকের প্রধান দুই চরিত্র ভ্লাদির ও এস্ট্রাগন নিজেদের প্রদর্শন করছেন বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সাধারণ মানুষ হিসেবে। ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন দুই ভবঘুরে ভাবছে গডো আসলেই তাদের এই ভবঘুরে ও অর্থহীন জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। যা যুদ্ধ পরবর্তী মানুষদের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিচ্ছবি।
পোজো ও লাকি চরিত্রের মাধ্যমে স্যামুয়েল ব্যাকেট ক্ষমতা ও দাসত্বের চিত্র অঙ্কিত করেছেন। এখানে পোজো চরিত্রের মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন হিটলারের মতো স্বৈরাচারদের। যিনি তার অধীনে থাকা মানুষদের কেবল শোষণ ও নিপীড়ন করেছেন। সেই সাথে দেখিয়েছেন পোজো যেমন অন্ধ হয়ে ক্ষমতা হারিয়েছেন সেরকম ভাবেই স্বৈরশাসকদের ক্ষমতাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আর লাকির মাধ্যমে দেখিয়েছেন বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী শোষিত মানুষদের।
নাটকের প্রথম দৃশ্য ও পরবর্তী দৃশ্য একই রকম যেন একই জিনিস ঘটে চলেছে। স্যামুয়েল ব্যাকেট দেখাচ্ছেন বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে ঠিকই কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর যুদ্ধ কেবল চক্রাকারে আমাদের জীবন জুড়ে চলতেই থাকবে।