বেশির লোকের কাছে আমি কে?
একজন অকর্মা, উদ্ভট, খ্যাপাটা মানুষ। সেই লোক সমাজে যার কোনো অবস্থান নাই, থাকবেও না।
যদি তেমনটাই হয়ে থাকে, খুব ভালো। আমি আমার শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই, এই খ্যাপাটে লোকটারও আছে সুন্দর একটি হৃদয়৷
উক্তিটি বিশ্ববিখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেণ্ট ভ্যান গগ এর। নিজের কুৎসিত মুখাকৃতির ও জীবনের প্রতি প্রবল হতাশায় ভুগে এসব কথা বলেছিলেন তিনি।
একটা সময়ে বিষন্নতায় ক্লান্ত হয়ে ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই ভিনসেন্ট ভ্যান গগ নিজের বুকে নিজেই গুলি করে বসেন। বলা হয়, একটি গম ক্ষেতে দাড়িয়ে তিনি নিজের বুকে গুলি চালান। গুলি করার আগ মুহূর্তে গমের ক্ষেতে বসেই ছবি আঁকছিলেন তিনি। গুলি করার পরেও তিনি পায়ে হেঁটে হেঁটে নিজ বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। সেখানে তাকে দুজন ডাক্তার দেখভাল শুরু করেন , জীবন – মৃত্যুর মাঝামাঝি দুটো দিন কাটিয়ে ২৯ জুলাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
ছোট ভাই থিও ভ্যান গগের ভাষ্যমতে , তার জীবনের শেষ বাক্যটি ছিলঃ-
‘ লা ত্রিসতেসে দুরেরা তৌজুরস ’ , যার ইংরেজি অনুবাদঃ- This sadness will last forever.’
প্রাথমিক জীবন
ভিনসেন্ট ভ্যান গগ এর পুরো নাম ‘ভিনসেন্ট উইলেম ভ্যান গগ’। ১৮৫৩ সালের মার্চের ৩০ তারিখ নেদারল্যান্ডস এর বেরাইড শহরের কাছে গ্রুট জুন্ডার্থ নামে একটি ছোট গ্রামের একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত গ্রামে জন্ম গগের। ভ্যান গগের বাবা ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম যাজক। ছয় ভাইবোনের মধ্যে গগ ছিলেন সবার বড়।
গগ এর পরিবারে ৪ জন গগ!
ভিনসেণ্ট ভ্যান গগ এর নামকরণ করা হয়েছে তার পিতামহের নামের নামে। তার দাদার নাম ও ছিল ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। সেসময় পূর্বপুরুষদের নামানুসারে নামকরণের একটা প্রথা ছিল। গগের ছোট ভাইয়ের নামে অংশ ও আবার থিও ভ্যান গগ। দুজনের নামই প্রায় এক। আবার গগের মৃত্যুর পর থিও ভ্যান গগ তার ছেলের নাম গগের নামানুসারে রাখেন।
ভ্যান গগ ১৮৭৩ থেকে মে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত লন্ডনে গৌপিল আর্ট গ্যালারির জন্য কাজ করেন। ১৮৭৫ সাল থেকে ১৮৭৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্যারিসে কাজ করেন। শিল্পকর্মের সাথে প্রতিদিনের যোগাযোগ তার শৈল্পিক সংবেদনশীলতাকে জাগিয়ে তোলে এবং শীঘ্রই তিনি রেমব্রান্ট, ফ্রান্স হালস এবং অন্যান্য ডাচ শিল্পীদের চিত্রকর্ম তার মধ্যে আর্ট বিষয়ে আর আনন্দ আরো আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে। তবে গগের সবচেয়ে পছন্দ ছিল দুই সমসাময়িক ফরাসি চিত্রশিল্পী, জিন-ফ্রাঁসোয়া মিলেট এবং ক্যামিল কোরোটের চিত্রকর্ম। তাদের প্রভাব গগের ভেতর সারাজীবন ধরে ছিল।
১৮৭৪ সালে লন্ডনের এক নারীকে প্রেমের প্রস্তা দেয়। সেই নারী তার প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করলে জীবনের প্রতি গগের দৃষ্টিভঙ্গি অন্ধকার হয়ে যায়। মানব স্নেহের জন্য তার জ্বলন্ত আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়, তিনি ক্রমশ একাকী হয়ে পড়েন।
তিনি ইংল্যান্ডে একজন ভাষা শিক্ষক এবং সাধারণ প্রচারক হিসাবে কাজ করেছিলেন। ১৮৭৭ সালে, নেদারল্যান্ডসের ডরড্রেখটে একজন বই বিক্রেতার জন্যও কাজ করেছিলেন।
মানবতার সেবা করার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি পরিচর্যায় প্রবেশের কল্পনা করেছিলেন এবং ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আর তাই দক্ষিণ-পশ্চিম বেলজিয়ামের কয়লা-খনির অঞ্চল বোরিনেজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশনারি কাজ করতে চলে যান। সেখানে তিনি খনির লোকেদের স্কেচ আঁতে শুরু করেন। এরমধ্যে গির্জার পরিচালকদের সাথে পার্থিব জগৎ ও খ্রিষ্টান ধর্মের ব্যাপারে তার বাগ্বিতণ্ডা হয়, এবং তাকে গির্জা থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তিনি অসহায় এবং অনুভব করে যে তার বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে গেছে।তিনি হতাশায় ডুবে গেলেন এবং সবার থেকে দূরে সরে গেলেন।
সেসময় তিনি তার এক পরিচিতজন কে বলেছিলেনঃ-
তারা মনে করে আমি একজন পাগল,কারণ আমি একজন সত্যিকারের খ্রিস্টান হতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে কুকুরের মতো বের করে দিয়েছিল, এই বলে যে আমি একটি কেলেঙ্কারী তৈরি করছি।
এরপর থেকেই ভ্যান গগ গম্ভীরভাবে আঁকতে শুরু করেন, যার ফলে ১৮৮০ সালে একজন শিল্পী হিসাবে তার প্রকৃত পেশা আবিষ্কার হয়। ভ্যান গঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এখন থেকে তার লক্ষ্য হবে শিল্পের মাধ্যমে মানবতাকে সান্ত্বনা দেওয়া।
তিনি তার ভাই থিওকে একবার বলেছিলেনঃ-
আমি হতভাগাদের জন্য একটি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বার্তা দিতে চাই। যখন আমি (আমার পেইন্টিংগুলি) ‘ভিনসেন্ট’ নামে স্বাক্ষর করি, তখন এটি তাদেরকে দেওয়া আমার বার্তাগুলোর মধ্যে একটি।
গগের চিত্রকর্মের এক দশক
ভিনসেন্ট তার জীবনে এঁকেছেন প্রায় ২,১০০টি ছবি এঁকেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ৮৬০টি তৈলচিত্র। বেশিরভাগ ছবির কাজই সম্পন্ন করেছেন নিজের জীবনের শেষ দুই বছরে।
গগের শৈল্পিক কর্মজীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ছিল, ১৮৮০ সাল থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই সময়ের প্রথম চার বছরে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সময়, তিনি নিজেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অঙ্কন এবং জলরঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। প্রথমে, তিনি ব্রাসেলস একাডেমিতে অঙ্কন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে যান। ১৮৮১ সালে তিনি নেদারল্যান্ডসের এটেনে তার বাবার কাছে চলে যান এবং প্রকৃতি নিয়ে শিল্পকর্মের কাজ শুরু করেন।
ভ্যান গগ কঠোর পরিশ্রম করছিলেন তার শিল্পকলা নিয়ে। কিন্তু শীঘ্রই তিনি স্ব-প্রশিক্ষণের অসুবিধা এবং আরও অভিজ্ঞ শিল্পীদের নির্দেশনা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। ১৮৮১ সালের শেষের দিকে তিনি একজন ডাচ ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার ‘আন্তন মাউভের’ সাথে কাজ করার জন্য ‘হেগে’ স্থায়ী হন।
তিনি জাদুঘর পরিদর্শন করেন এবং অন্যান্য চিত্রশিল্পীদের সাথে দেখা করেন। ভ্যান গগ এইভাবে তার প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রসারিত করেন এবং ১৮৮২ সালের গ্রীষ্মে তেল রং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
১৮৮৩ সালে তিনি প্রকৃতির সাথে একাকি থাকার জন্য এবং কৃষকদের খুব কাছ থেকে দেখার জন্য ‘ড্রেন্থে’ চলে আসেন, এটি ছিল উত্তর নেদারল্যান্ডের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ। এখানে গগ ৩ মাস কাটিয়েছিলেন।
গগ ১৮৮৪ ও ১৮৮৫ সালের বেশিরভাগ সময় ‘নুয়েনে’ ছিলেন এবং এই বছরগুলিতে তার শিল্প আরও সাহসী এবং আরও প্রানবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি তখন তিন ধরনের বিষয় (still life, landscape, and figure)। এগুলোর সবই ছিলো কৃষকদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের সহ্য করা কষ্ট এবং তারা চাষ করা গ্রামাঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত।
এমিল জোলার জার্মিনাল লেখা ফ্রান্সের কয়লা-খনন অঞ্চল সম্পর্কে একটি উপন্যাস, ভ্যান গগকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং এই সময়ের থেকে তার অনেক ছবিতে সমাজতাত্ত্বিক সমালোচনা নিহিত রয়েছে-যেমন, Weavers ও The Potato Eaters.
একটা সময়ে নুয়েনে তিনি খুব একাকী বোধ করছিলেন, তাই নুয়েন ত্যাগ করলেন।
ভ্যান গগ ১৮৮৬ সালের মার্চ মাসে প্যারিসে চলে আসেন সেখানে তার ভাই থিও একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া করে। গগ ফার্নান্ড করমনের স্টুডিওতে তার চিত্রকর্ম নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করেন। প্যারিসে Painted portraits of friends and acquaintances, Still life paintings, Views of Le Moulin de la Galette, Scenes in Montmartre, Asnières and along the Seine এর মতো চিত্রকর্ম গুলো এঁকেছিলেন।
দুই বছর পর ভ্যান গগ শহরের জীবন থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের আর্লেসের উদ্দেশ্যে প্যারিস ত্যাগ করেন।
পরবর্তী ১২ মাস ধরে তিনি যে ছবিগুলি তৈরি করেছিলেন – ফুলের গাছ, শহর এবং আশেপাশের দৃশ্যগুলি, স্ব-প্রতিকৃতি, পোস্টম্যান এবং অন্যান্য।
পল গাউগুইন
১৮৮৮ সালে অক্টোবে গগের সাথে বরেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পল গাউগুইন এর পরিচয় হয়। গগ ২ মাস গাউগুইন এর সাথে কজ করেছিলেন। গগ আর গাউগুইন দুজনেই দুজনের চিত্রকর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ কথা গগ তার ভাই থিওর কাছে লেখা এক চিঠিতে স্বীকার করেন।একটা সময়ে তাদের দুজনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
গগের কান কাটা
প্রচলিত আছে যে গগ, পল গাউগুইন সাথে তর্ক করেছিলেন এবং একটি ক্ষুর দিয়ে পল গগকে তাড়া করেছিলেন এবং পল গগের বাম কানের নীচের অর্ধেকটি কেটে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে সেটি র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে যৌনপল্লির এক মহিলার কাছে তা পাঠিয়ে দেন, যে মহিলার নিকট ভ্যান গগ ও পল গাউগুইন দুজনেরই যাতায়াত ছিল। সেই যৌনকর্মী নাকি একবার গগ কে উপহাস করে বলেছিলেন তোমার কানগুলো খুব সুন্দর।
এই কান কাটার ঘটনার পরই পল গাউগুইনের সাথে বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে তার। তাই সবার ধারণা, কান কর্তনের সাথে পল গাউগুইন সরাসরিই জড়িত।
মানসিক বিপর্যয়
১৮৮৮ সালের বড়দিনের প্রাক্কালে গগ মারাত্মক শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে তিনি স্বেচ্ছায় ফ্রান্সের সেইন্ট রেমি-ডি প্রদেশের আশ্রমে আসেন। বলা হয়ে থাকে ‘স্ট্যারি নাইট’ ছবিটি ছিল ভ্যান গগের বিছানার পাশের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া রাতের দৃশ্য। ১৯৪১ সাল থেকে এই ছবিটি মেট্রোপলিটন আর্টস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। গগ সেখানে প্রায় ১ বছর থেকেছিলেন।
গগের শিল্পকর্মের মূল্য
বেঁচে থাকতে গগ কোনো সম্মান বা মর্যাদা পাননি। জীবনে প্রায় ২ হাজার শিল্পকর্ম তৈরি করে একটি মাত্র বিক্রি করতে পেরেছিলেন। অথচ আজকের দিনে তার শিল্পকর্ম মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে নিলামে বিক্রি হচ্ছে। ভিনসেন্টের আঁকা সবচেয়ে দামী ছবিটি হচ্ছে ‘পোরট্রেইট অফ ডক্টর গ্যাচেট’। ১৮৯০ সালে আঁকা এই ছবিটি ঠিক একশ বছর পর ১৯৯০ সালে নিলামে ওঠানো হয়। সেই সময়ে ছবিটি বিক্রয় হয় ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে, যেটি কি না পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবিগুলোর মধ্যেও একটি।
গগের আত্মহত্যা
গগকে তার জীবনের একাকিত্ব আর বিষন্নতা আর ব্যার্থতা গ্রাস করে নিয়েছিল। তাই তার একাকিত্ব আর বিষন্নতার বিনাশ করতে ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই তিনি একটি গম খেতের মাঝে দাড়িয়ে নিজের বুকে নিজেই গুলি করে বসেন। গুলি করার পূর্ব মুহূর্তে তিনি সেখানে বসেই আঁকছিলেন। গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা যান নি। পায়ে হেটে নিজের বাড়িতেও পৌঁছেছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসলে সে পুলিশের কোনো প্রশ্নের উ্ত্তর দেয় নি।
পুলিশকে বলেছিলেনঃ-
আমি যা করেছি তা তা নিজের সাথে করেছি। আমার নিজের শরীর নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি, এটা আমার স্বাধীনতা।
২ দিন জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি কাটিয়ে ২৯ জুলাই পৃথিবী ত্যাগ করেন এই মহান চিত্রশিল্পী।
Reference: Wikipedia, Britanicca, Medium
Featured Photo Credit: The Art Institute of Chicago