You are currently viewing মধ্যযুগের কিছু অসমাপ্ত রহস্য

মধ্যযুগের কিছু অসমাপ্ত রহস্য

ইতিহাসে মধ্যযুগ একটি রহস্যময় সময়। এই সময়টা ইতিহাসের অন্যান্য সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল। যার একটা বিশাল সময়ই দখল করে রেখেছে যুদ্ধ, মহামারী ও সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট। এই সময়টাতে এমন সব ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে, যে এখনো পন্ডিত ও ইতিহাসবিদরা গবেষণা করে চলেছেন রহস্যের সমাধান করতে।

ড্যান্সিং প্লেগ

১৫১৮ সালের জুলাই মাসে লেডি ট্রফিয়া (বা ফ্রাউ ট্রফিয়া) নামে একজন মহিলা স্ট্রাসবার্গের (তখন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, আজকের আধুনিক ফ্রান্স) একটি ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ উম্মাদের মতো নাচতে শুরু করেন। তার নাচ দেখে অনেক দর্শক জমে যায়, সাথে তার নাচের ক্ষমতার প্রশংসাসূচক হিসেবে হাত তালিও দিতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু লেডি ট্রফিয়ার এই নৃত্য কিছু সময়ের জন্য ছিলো না। শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। মহিলাটি দীর্ঘ ৬ দিন উম্মাদের মতো নেচেছ! এই ৬ দিন সে সন্ধ্যায় নাচ থামাতো আবার সকালেই তার উম্মাদ নৃত্য শুরু করতো। এক সপ্তাহের মধ্যে তার সঙ্গে আরো চৌত্রিশ জন স্থানীয় লোক নৃত্যে যোগ দিয়েছিল।

Photo: Pieter Brueghel the ElderWikimedia CommonsPublic domain

সেসময়ে চিকিৎসকদের এই ব্যাপারে কোনোরকম ধারণা ছিল না। চিকিৎসকরা উল্টো পরামর্শ দিয়েছিল যে মানুষদের শরীরের জ্বর এসেছে এবং রক্ত গরম হয়ে গেছে, আরো নাচলে তাদের অসুখ নিরাময় হবে।

সেই শহরের সিটি কাউন্সিল এই পরামর্শটি গ্রহণ করেছিল এবং নৃত্যের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করেছিল। নাচার জন্য মিউজিক হিসেবে ব্যান্ড পার্টির ও ব্যবস্থা করেছিল। এবং সঠিকভাবে নাচতে শেখার জন্য নৃত্য প্রশিক্ষক ও আনা হয়েছিল।

আগস্টের শেষের দিকে, রাস্তাটি একটি আধুনিক দিনের কোনো কনসার্টের মতোই অবস্থা হয়েগিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ নাচছে আর হাজার হাজার মানুষ সেই নাচ দেখে হাসছে। নাচ দেখে হাসতে হাসতে তারাও সেই নাচে দলে দলে যোগ দিচ্ছে।

সময় বাড়ার সাথে সাথে মানুষন অতিরিক্ত ক্লান্তি ও স্ট্রোক করে মরতে শুরু করে। কিছু কিছু জায়গায় উল্লেখ আছে যে প্রতিদিন নাচতে নাচতে ১৫ জনের মৃত্যু হতো আর এই নৃত্যের ধারা ১৫১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কেনো এই মহামারী নাচের সৃষ্টি হয়েছিলো। আজো কেউ সেই রহস্যের উদঘাটন করতে পারে নি।

ভয়নিচ পান্ডুলিপি

এটি একটি অজানা ভাষায় হাতে লেখা চিত্রিত ভলিয়মের পান্ডুলিপি। ১৫ শতকের শুরুতে এটি লেখা হয়েছিল এবং এটির নামকরণ করা হয় আলফ্রেড ভয়নিচের নামানুসারে। তিনি মূলত ১৯১২ সালে বইটি ক্রয় করেছিলেন। এটি অসংখ্য বার পড়া হয়েছে কিন্তু এর কোড কেউ ভেদ করতে পারেনি। পান্ডুলিপি টি ৬টি বিভাগে বিভক্ত। হারবাল, জ্যোতির্বিদ্যা, জৈবিক, মহাজাগতিক, ফার্মাসিউটিক্যাল এবং রেসিপি।

আরো পড়ুন:  প্রাচীন ও মধ্যযুগের রহস্যময় ৬ টি বই
Photo: UnknownWikimedia CommonsPublic domain

কিছু পাতা হারানো গেলেও, এর বর্তমান সংস্করণে প্রায় ২৩৪টি পাতা রয়েছে যার অধিকাংশই চিত্রালংকরণের সাথে গঠিত। পান্ডুলিপিটির অনেক বর্ণনাতে সে সময়ের ভেষজ পান্ডুলিপি, গাছপালার চিত্রালংকরণ এবং তাদের সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের মতে – আঁকা উদ্ভিদের অনেকগুলোই কোনো পরিচিত প্রজাতির অনুরূপ না। তারা যৌগিক বলে মনে হয়। কেউ কেউ এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন যে, এটি একটি ফাঁকি কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করেন এটি খুব জটিল এবং অত্যাধুনিক। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এটি একটি মেডিক্যাল ভলিউম যা এখনো রহস্যের আধার।

উলপিটের রহস্যময় সবুজ রঙের ভাই বোন

দ্বাদশ শতাব্দীতে হঠাৎ করেই ইংল্যান্ডের উলপিটে একজোড়া ভাই বোনের উদয় হয়। তারা সবদিক থেকেই সাধারণ মানুষের মতো ছিল। তবে তাদের গায়ের রং ছিল অস্বাভাবিক সবুজ রঙের।

তারা দুই ভাই বোন অজানা ভাষায় কথা বলতো, অদ্ভুত পোশাক পরিধান করতো এবং খাবার হিসেবে শুধু কাঁচা শিম খেতো। কিছুদিন পর অবশ্য তাদের মধ্যে ছেলেটি মারা যায় কিন্তু মেয়েটি বেঁচে ছিল। মেয়েটি পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেছিল এবং অন্যান্য খাবার খাওয়া শিখেছিল। ধীরে ধীরে মেয়েটি তার গায়ের সবুজ রং হারাতে শুরু করে। সে অন্যদের বলেছিল যে, তারা দুই ভাই বোন সেন্ট মার্টিন্স ল্যান্ড থেকে এসেছে।

Image Credit: armagedopic

তার ভাষ্য মতে, সেন্ট মার্টিন্স একটি ভূগর্ভস্থ এলাকা যেখানে সবাই সবুজ গাত্র বর্ণের অধিকারী। এই গল্পের ভিত্তি পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ এটিকে নিছক পরীর গল্প মনে করেন। কেউ আবার মনে করেন সত্য গল্পের কিছুটা রদবদল হয়েছে। কেউ আবার এখনো মনে করেন তারা হয়তো আসলেই ভূগর্ভস্থ পৃথিবীর কোনো অশরীরী প্রাণী।

ইংল্যান্ডের হারিয়ে যাওয়া যমজ যুবরাজ

১৪৮৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর, তার ১২ বছর বয়সী ছেলে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হন। কিন্তু রাজ্যাভিষেকের আগে, ছেলেটি তার ছোট ভাই সহ – গ্লুসেস্টারের ডিউক রিচার্ড দ্বারা বন্দী হয়েছিল।

রিচার্ড, ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হতে আগ্রহী ছিলো, আর তাই তিনি তার ভাগ্নেদের অবৈধ ঘোষণা করেন। আর এই ঘোষণাই তাকে ইংরেজ সিংহাসনের সঠিক উত্তরাধিকারী করে তোলে। টাওয়ার অফ লন্ডনে তালাবদ্ধ হওয়ার পরে, যুবরাজদের আর কখনও দেখা যায়নি এবং তাদের চাচা ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় রিচার্ড ও হয়েছিলেন।

আরো পড়ুন:  ব্ল্যাক ডেথ : মধ্যযুগের ইউরোপের ভয়াবহতা
Image Credit: Wikipedia Commons

অধিকাংশ ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন যে রিচার্ড তার ভাগ্নেদের হত্যা করেছিলেন, বা – অন্ততপক্ষে – তিনি তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যাইহোক, কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে হেনরি স্ট্যাফোর্ড বা হেনরি টিউডর ও এই অপরাধের পিছনে ছিলেন, কারণ তাদের উভয়েরই সিংহাসনের দাবি ছিল। কিন্তু এসবকিছুই অনুমান মাত্র। দুই যুবরাজের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো তা এখনো এক রহস্য।

গ্রীক ফায়ার

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের যোদ্ধাদের পছন্দের একটি জ্বালানি অস্ত্র হিসেবে ৬৭০ সালের দিকে গ্রীক ফায়ার প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিলো। দাহ্য তরল জলের উপর পুড়ে যায়, এটিকে অনির্বাণ এবং নৌ যুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর করে তোলে। নাবিকরা গ্রীক আগুনে বোঝাই গ্রেনেড শত্রু জাহাজে নিক্ষেপ করত বা টিউব থেকে স্প্রে করত। জলে পোড়ানোর ক্ষমতা এটিকে একটি কার্যকর এবং ধ্বংসাত্মক নৌ-অগ্নিসংযোগকারী অস্ত্র বানিয়েছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলি উপাদানটি অনুলিপি করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল।

Image Credit: Wikimedia Commons / Public domains

এই যুদ্ধাস্ত্র কিভাবে তৈরি করা হয়েছিলো তা এখনো রহস্য। ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে এটি পাইন রজন , ন্যাফথা , কুইকলাইম , ক্যালসিয়াম ফসফাইড , সালফার বা নাইটারের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছিল ।

চেঙ্গিস খানের কবর কোথায়?

চেঙ্গিস খান মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার একুশ বছরের শাসনে এশিয়ার প্রায় সিংহভাগ নিজের জয় করেছিলেন। সাম্রাজ্যের বিস্তার করতে চেঙ্গিসখান অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছেন। চেঙ্গিস খান প্রায় ৪ কোটি নিরীহ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

Iamge Credit: Wikimedia Commons /Public Domain

তবে চেঙ্গিসখানের মৃত্যু নিয়ে রয়ে গেছে রহস্য। কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছিলো তা নিয়ে রয়েছে অনেক মতভেদ। মনে করা হয় যে ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খান ঘোড়ার পিঠ থেকে পরে মারা যান। তাকে ওনান নদীর তীরে অত্যন্ত গোপনে সমাহিত করা হয়। কথিত আছে যে তাকে যারা সমাহিত করে একদল প্রথমে তাদের মেরে ফেলে। এরপর একজন আর একজনকে মারতে থাকে এবং সর্বশেষ জন আত্ত্বহত্যা করে। ৮০০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কেউ চেঙ্গিস খানের সমাধি আবিষ্কার করতে পারে নি।