You are currently viewing আঙ্কেল টম’স কেবিন: যে উপন্যাস আমেরিকার ইতিহাস পরিবর্তন করে দিয়েছে

আঙ্কেল টম’স কেবিন: যে উপন্যাস আমেরিকার ইতিহাস পরিবর্তন করে দিয়েছে

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার করার পর। দলে দলে ইউরোপের শেতাঙ্গরা সেখানে গিয়ে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তোলে। নতুন নতুন উপনিবেশ তৈরির সময় তারা দেখল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের মাটি তুলোর চাষের পক্ষে খুব উৎকৃষ্ট। 

এই তুলোর চাষের অঞ্চলে প্রয়োজন পড়লো অতি অল্প খরচে অধিক শ্রমদানকারী অসংখ্য মানুষের, যারা চিরদিনের মতো কেনা গোলাম হয়ে দৈহিক নিপীড়নের ভয়ে বিনা পারিশ্রমিকে আমৃত্যু শ্রমদান করবে। আর তাই এই ধরনের শ্রমিক শিকার করা হলো আফ্রিকার দুর্বল অসহায় কালো মানুষদের গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে, আর ওদের খাঁচায় পুরে শেকলে বেঁধে নিজেদের দেশ ও সমাজ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা হলো কামান আর বন্দুকের ভয় দেখিয়ে সমুদ্রের পরপারে আমেরিকায়। 

আর হয়ে গেলো ওরা আজন্ম ক্রীতদাস। ওদের সন্তান-সন্তুতিদের নিয়ে, আর যারা ওদের শিকার করেছিলো সেসব ক্রীতদাস-ব্যবসায়ীরা ওদের বেচতে লাগলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের ওই সব শ্বেতাঙ্গ তুলো-চাষীদের কাছে। যে-সব শ্বেতাঙ্গ ওদের কিনতো, তারা ওদের মৃত্যু ঘটালেও আইনের চোখে অপরাধী হোতো না, কেননা ওরা আইনের বলে সর্বপ্রকার মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এক ধরনের পণ্যসামগ্রী।

লেখিকা হ্যারিয়েট বিচার স্টো ও মার্কিন গৃহযুদ্ধ

হ্যারিয়েটের লেখা আঙ্কেল টমস কেভিল কে মনে করা হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার ভিত্তি স্তম্ভ। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হওয়ার প্রথম বছরেই বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বিক্রি হয় প্রায় ৩ লক্ষেরও অধিক কপি আর গ্রেট ব্রিটেনে তার সংখ্যা ১ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। সে সময়ে কোনো বই এতো বিশাল সংখ্যক পরিমাণে বিক্রি ছিলো কেবলই কল্পনা। শুধুমাত্র বাইবেল বিক্রির সংখ্যাই এই উপন্যাসের কাছাকাছি ছিলো।

একজন লেখক যে শুধুমাত্র লেখকই নয় তিনি চাইলে তার কলমের জোড়ে পুরো একটা সমাজ বা রাষ্ট্রের পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন হ্যারিয়েট বিচার স্টো তার পারফেক্ট উদাহরণ। 

হ্যারিয়েট বিচার স্টো ১৮৩০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ওয়াইয়োতে থাকতেন। সে সময়ে তার বেশ কিছু মুক্তি পাওয়া কিংবা পালিয়ে আসা ক্রিতদাসদের সাক্ষাৎকার নেন। তার মুখেই জানতে পারেন ক্রীতদাসদের ভয়াবহ জীবনের কথা। হ্যারিয়েট বিচার স্টো সবসময়ই বলেছেন উপন্যাসের আঙ্কেল টমস কোনো নির্দিষ্ট ক্রীতদাসের জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখা উপন্যাস নয়। 

তবে এই উপন্যাস লেখার ব্যাপারে হ্যারিয়েট আগ্রহী হয়ে উঠেন যখন তিনি জোসিয়া হ্যানসন নামক এক নিগ্রো ক্রীতদাসের লেখা নিজের আত্মজীবনী ‘দ্য লাইফ অব জোসিয়া হ্যানসন’ পড়েন। এই আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হয়েছিলো আঙ্কেল টমস কেবিন প্রকাশ হওয়ার ৩ বছর আগে; ১৮৪৯ সালে।

জোসিয়া হ্যানসন তার আত্মজীবনীতে লেখেন আইজ্যাক ম্যারিল্যান্ডে তে রিলে নামের এক ব্যবসায়ীর ৩৭০০ একর জমিতে তিনি তামাক চাষ করতেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ১৮৩০ সালে তিনি সেখান থেকে তিনি পালিয়ে কানাডায় চলে যান। তবে একা পালান নি সঙ্গে আরো অনেক ক্রীতদাসদের সাথে নিয়ে পালিয়ে ছিলেন। নিজের ক্রীতদাস জীবনের ভয়ংকর রোমাঞ্চকর স্মৃতিচারণ করেই নিজের আত্মজীবনী লিখে ফেলেন। আর এই বইটি হ্যারিয়েট বিচার স্টো কে আঙ্কেল টমস কেভিন উপন্যাস লেখার রসদ জুগিয়ে ছিলো। সঙ্গে ছিলো বহু বছরে পাওয়া অনেক কৃতদাসদের নেওয়া সাক্ষাৎকার।

১৮৫২ সালে হ্যারিয়েট বিচার স্টো যখন আঙ্কেল টমস কেবিন প্রকাশ করেন, তখন আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথা বাতিল করার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। খুব দ্রুত বইটি জনপ্রিয় হতে শুরু করায় সাধারণ মানুষজন নতুন করে কৃতদাসদের ব্যাপারে ভাবতে শুরু করে। ফলে মানুষের মধ্যে দাসপ্রথা বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টির শুরু হয়। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলো ছিলো পুরোপুরি দাস নির্ভর ফলে উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে যায় দ্বন্দ্ব এবং ১৮৬০ এ শুরু হয় যায় ৪ বছরের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। 

গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সাথে দেখা হয়েছিলো লেখিকা হ্যারিয়েট বিচার স্টো এর। প্রথম সাক্ষাৎতে লিংকন বলেছিলেন:-

“So this is the little lady who started this great war.” (ইনিই তাহলে সেই অল্পবয়স্ক ভদ্রমহিলা যিনি এই যুদ্ধের সুত্রপাত করেছেন)।

সংক্ষেপে আঙ্কেল টমস কেবিন উপন্যাসের কাহিনী

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আঙ্কেল টমস মালিক আর্থার শেলভি ফার্মের একজন কৃতদাস। আর্থার শেলভি মানুষ হিসেবে ছিলেন খুবই ভালো। তিনি কৃতদাসদের উপর জুলুম নির্যাতন করতেন না। শেলভি ঋনগ্রস্থ ছিলেন। এতোটাই খারাপ অবস্থা যে ফার্ম বন্ধ করে দিতে হবে। শেলভির স্ত্রী এমিলি শেলভি স্বামীকে পরামর্শ দেন যেনো টাকা জোগান দেওয়ার জন্য তাদের ক্রীতদাস টমকে ও আরেক ক্রীতদাসী এলিজার ছেলে সন্তান হ্যারি কে বিক্রি করে দেন। শেলভির ছেলে জর্জ শেলভি আঙ্কেল টমকে বিক্রি করার বিষয়টি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। সে টমের কোলেপিঠে বড় হয়েছে, টমকে সে খুব ভালোবাসতো। অপরদিকে এলিজা যখন বুঝতে পেরেছে তালের মালিক টাকার অভাবে টমের সঙ্গে তার ছোট ছেলে শিশুকেও বিক্রি করে দিবে তাই ঝুঁকি নিয়ে সেই রাতেই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যায়।

আঙ্কেল টমসকে বিক্রি করে দেওয়া হয় হেলী নামক এক দাস ব্যবসায়ীর কাছে। সেই সাথে হ্যালি গুন্ডাদেরকেও এলিজাকে ও তার ছেলে হ্যারিকে যেনো খুঁজে ধরে নিয়ে আসে। বিক্রির পর শুরু হয় টমের উপর শারিরীক প্রহার। টমকে বিক্রি করার জন্য জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। সেই জাহাজ থেকে ইভা নামের একটি মেয়ে শিশু পানিতে পড়ে প্রায় মরতে বসে। টম নিজের ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিয়ে ইভার জীবন বাঁচায়। আর তাই ইভার বাবা ক্লেয়ার টমকে অনেক দাম দিয়ে কিনে নেন। টমের সাথে ইভার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এতোটাই ভালো বন্ধুত্ব যে ইভা নিজের মা থেকে টমকেই বেশি ভালোবাসতো।

চিত্রশিল্পীর তুলিতে আঙ্কেল টম age Courtesy: Uncle toms cabin & Americans History

২ বছর সুন্দর ও সুখী ভাবেই জীবন কেটে যায় টমের। একসময় অসুস্থ হয়ে ইভা অল্প বয়সেই মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে ইভা তার বাবাকে অনুরোধ করে গিয়েছিল যেনো সে আঙ্কেল টমকে কৃতদাস থেকে মুক্তি দিয়ে দেয়। ইভার বাবা টমকে মুক্তি দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন। এরই মধ্যে ইভার বাবা আততায়ীর হাতে খুন হন। 

ইভার মা টমকে একদম পছন্দ করতেন না কারন তার মেয়ে বেঁচে থাকতে তার থেকে টমকেই বেশি ভালোবাসতেন। আর তাই তিনি টমের উপর ক্রুদ্ধ ছিলেন। টমকে তিনি সিমন লেগ্রি নামক এক পাষণ্ড দাস ব্যাবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেন। সিমন লেগ্রি তাকে নিয়ে যায় লুসিয়ানায় তার তুলোর বাগানে। সিমনের অত্যাচারে ক্রীতদাসেরা মারাও যেতো সেখানে আইন কানুন বলে কিছু ছিলো না। হতো না কোনো অপরাধের বিচার। 

সিমন আঙ্কেল টমকে দিয়ে অন্য কৃতদাসদের নির্যাতন করতে চাইলে টম তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে সীমন ক্ষেপে যায় টমের উপর সে প্রহার করতে শুরু করে। টম ছিলো ঈশ্বরে বিশ্বাসী সেটা সিমন একদম পছন্দ করতো না। টম বলতো এই শরীর তোমার তুমি যা কিছু করতে পারো কিন্তু আমার আত্মা আমি কেবল যীশু কে উৎসর্গ করেছি। এসব শুনে সিমন লেগ্রি আরো ক্ষেপে টমকে প্রহার করতো।

এরই মাঝে আঙ্কেল টম ক্যাসি ও ইমেলি নামে দুই ক্রীতদাসও দাসীকে বাগান থেকে পালাতে সাহায্য করেন। আর এটা সীমন কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে নি। সে আঙ্কেল টমকে এতোটাই প্রহার শুরু করে যে আঙ্কেল টমস প্রায় মৃত্যু শয্যায় চলে যায়। মৃত্যুর আগে টমের প্রথম মালিকে শেলভির জেলে জর্জের সাথে দেখা হয়। জর্জ টমকে বলে সে তাকে মুক্ত করতে এসেছে। টম জর্জকে বলে যীশু তাকে মুক্তির জন্য ডাকছে। এর কিছুক্ষণ পর টম পরলোকগমন করেন। টমের মৃত্যুতে শোকাহত শেলভি পরিবার তাদের সকল ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণা করে। অপর দিকে এলিজা ও তার ছেলে হ্যারিকে নিয়ে নিজের পলাতক কৃতদাস স্বামীর সাথে পালিয়ে কানায় চলে যেতে সক্ষম হন। আর মুক্তি পান ক্রীতদাসের জঘন্যময় জীবন থেকে।

Leave a Reply