খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, গত শতাব্দীতেও ভারতবর্ষ ছিল এক আশ্চর্যজনক দেশ। এখানে মানুষ ঘর থেকে বের হলে আর ঘরে ফেরত আসতো না। তারা বেমালুম হারিয়ে যেত।
দূর দেশে চাকরি করা বা বাণিজ্য করতে গিয়ে ফেরার পথে হারিয়ে যেতো হাজার- হাজার, লক্ষ- লক্ষ মানুষ।
হারিয়ে যাওয়া সদস্যের জন্য পরিবারের লোকেরা কিছুদিন অপেক্ষা করতেন। এরপর সময়ের সাথে সাথে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যেত। সংসার কর্মে তারা আবার মন দিতেন। তারা হয়তো ভেবে নিতো হয়তো গঙ্গা স্নান করতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে মরে স্বর্গলাভ হয়েছে কিংবা পথে বাঘে খেয়েছে।
সে সময় ইংরেজ ঐতিহাসিক হিসাব করে দেখতে পান গত ৩০০ বছরে প্রতি বছরে কম করে ৪০,০০০ মানুষ হারিয়ে গেছে ভারতের কোল থেকে।
তারা আসলে কেউ গঙ্গায় ডুবে মরে নি কিংবা বাঘের পেটে যায় নি। তারা সকলেই হয়েছিল নিশংস ঠগীদের শিকার।
ঠগী শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ঠগ থেকে এসেছে; যার অর্থ ধোঁকাবাজ বা প্রতারক। যারা পথিকের গলায় রুমাল জড়িয়ে হত্যা করে। পুরো পৃথিবীর ইতিহাস ঘেটে ও তাদের মতো নৃশংস খুনীর দল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঠগীরা ১৩ শতাব্দী থেকে ১৯ শতাব্দী পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৬০০ বছর ধরে পুরো ভারত জুড়ে ত্রাস চালিয়েছে গিনেস বুকে রেকর্ড এর তথ্য মতে এই সুদীর্ঘ সময়ে তারা ২০ লক্ষের বেশি নিরীহ মানুষ মানুষ খুন করেছে। একজন ঠগী মাসে গড়ে ৮-১০ জনকে খুন করতো। বাহরাম বলে এক নিষ্ঠুর ঠগীর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৯৩১ জন মানুষকে সে খুন করেছিল বলে দাবি করে এবং পরবর্তীতে ঐ নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডে ওঠে।
ঐতিহাসিক জিয়া-উদ্- বারনী ১৩৬৫ সালে তার এক লেখায় লিখেছিলেন ১২৯০ সালে জালালউদ্দিনের রাজত্বকালে দিল্লিতে প্রায় ১০০০ ঠগ ধরা পড়ে। ওদের ধরার কারণ ছিল তারা সুলতানের এক প্রিয় দাস কে হত্যা করেছিল। এতে সুলতানের মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সুলতান তাদের কোন শাস্তি না দিয়ে মুক্তি দিয়েছিলেন। মুক্তি দেয়ার আগে সুলতান তাদের সকলের পিঠে নিজের মুদ্রার গরম ছাপপ দিয়ে দেন এবং শর্ত দেন তারা যেন দিল্লি তে আর ফিরে না আসে।
এরপর সেই ঠগীরা উত্তর,দক্ষিণ ভারত থেকে শুরু করে বাংলা সহ পুরো ভারত ছড়িয়ে পড়ে। ঠগীদের সবচেয়ে বর্বর সময় ছিল ১৭ ও ১৮ শতক। শুধুমাত্র ১৮৩০ সালেই ঠগীদের শিকার হয়েছিল প্রায় ৩০,০০০ নিরীহ মানুষ।
ঠগীরা দলবেঁধে পথ ভ্রমণ করত তারা এমন সব পদ্ধতিতে ভ্রমণ করতো যেন তারা কোনো তীর্থযাত্রী কিংবা কোন বণিক দল ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ঠগীদের দল ছিল বিশাল প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জনের মতো দল ছিল তাদের। তারা পথ চলতে পথে বণিক বা পথচারী দেখলে তাদের সাথে ভাব করতো। যেহেতু বড় দলের সাথে পথ চলতে রাস্তায় ঝুঁকি কম হবে সেই ভাবে তারা সেই দলের সাথে পথযাত্রা করতে সম্মতি দিতো। আর সেই দলের সাথে যুক্ত হয়ে তারা নিশ্চিন্তে পথ চলতো, বিশ্রাম নিতো, খাবার খেতো আর সুযোগ বুঝে তারা শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। এছাড়াও বণিক দলের উপর নিজেদের চর লাগিয়ে রাখতো আগে থেকে, তারা কোথায় যাবে। কি পরিমাণ অর্থ সম্পত্তি হাতে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
হত্যা করার ক্ষেত্রে ঠগীরা কিছু নিয়ম মেনে চলতো। তারা কখনোই ঘুমন্ত অবস্থায় কাউকে হত্যা করত না। হত্যা করার আগে হয়তো তারা শিকারের সামনে চেঁচিয়ে উঠতো সাপ সাপ বলে আর শিকারের ঘুম ভেঙে যেতো। আর তখন ৩-৪ জন শিকারির হাত পা মাটিতে চেপে ধরতো, আর সবচেয়ে পাঁকা ঠগী রোমাল দিয়ে ফাঁস দিয়ে হত্যা করতো। খুন করার সময় ঠগীরা কোনো রক্তপাত ঘটাতো না, এটা তাদের নিয়মের বাহিরে।
ঠগী দলে একজন দলপতি থাকতো। দলপতিদের বলা হতো জমাদার। ঠগীদের আলদা নিজস্ব ভাষা ও ছিলো। সেই ভাষা ঠগী ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারতো না।
বাসন মাজা অর্থ ছিল কবর খোড়া। ঝিরণী দিতে বলা মানে হচ্ছে খুন করার জন্য প্রস্তুত হওয়া। তামুক লাও মানে এখন হত্যা করো। হত্যা করতে যাদের হাত খুব পাকা ছিলো তাদের বলা হতো আউলা। টাকাকে বলতো গুনা।
খুন করার পর ঠগীরা তাদের শিকারকে কবর দিতো বা কোনো কুয়োর ফেলে দিতো। কবর দেয়ার পর সমাধির উপরে তারা এক ভোজের আয়োজন করতো গুঁড় দিয়ে। সেই ভোজে মন্ত্রপুত গুঁড় খেতে দেওয়া হতো, শুধুমাত্র যারা হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করতো তারাই সেই মন্ত্রপূত গুড়ের ভোগ পেত। অন্যরাও ভোগ পেত তবে সেটি মন্ত্রপূত গুঁড় নয়, সাধারণ গুঁড়।
ঠগীদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্মণ, শিখ সকল ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষ ছিলো। ভারতবর্ষে হাজার বছর ধরে ধর্ম, জাত-পাত নিয়ে টানাপোড়ন থাকলেও ঠগীদের মধ্যে ছিলো না। তাদের সকল ধর্ম ছিলো একটাই তারা ঠগী।
ঠগীদের নিজস্ব দেবী ছিলো ভবানী। সনাতন ঠগী ছাড়াও সকল ধর্মের ঠগীরাই এই দেবীকে মানতো ও বিশ্বাস করতো। আর তারা এটাও বিশ্বাস করতো তারা যা করছে দেবী ভবানীকে সন্তুষ্টি ও ইচ্ছায় করছে।
ঠগীরা যখন কাউকে খুন করার জন্য ঠিক করতো, তারা তাকে খুন করতোই। শিকারের কাছে টাকা পয়সা না থাকলেও তারা খুন করতো। তারা বিশ্বাস করতো দেবী খুনের আদেশ দিয়েছে আর খুন না করলে দেবীর আদেশ অমান্য করা হবে। একবার এক ঠগী দল ১২ জনের একটি দলকে খুন করার জন্য প্রায় ২০০ মাইল পথ হেটেছে। কারণ ছিলো একটাই তাদের খুন করার জন্য নিশানা করেছিলো, আর সেটা তাদের সম্পন্ন করতেই হবে।
ঠগীদের সাধারণ মানুষের মতোই স্ত্রী, ছেলে- মেয়ে সন্তান নিয়ে সংসার ছিল। বেশিরভাগ ঠগীর ক্ষেত্রেই তারা যে ঠগী তাদের পরিবারের কেউ জানতো না। ঠগী স্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ জানতো, তবে তারা সমাজে স্বাভাবিকভাবেই বসবাস করতেন। ঠগীরা কখনোও নিজের অঞ্চলে অপকর্ম করতো না। তারা নিজেদের পরিবার ও সমাজ থেকে হাজার মাইল দূরে নিজেদের অপকর্ম চালাতো। ঠগী সদস্যদের পরিবার ও সমাজের মানুষেরা জানতো সে বিদেশে গেছে, চাকরি করছে কিংবা বাণিজ্য করছে। ৬ মাস বা বছরে ১ বার নিজেদের পরিবারের সাথে তারা দেখা করতো।
বেশিরভাগ ঠগীরা তাদের সন্তানদের বয়স ১৪/১৫ পেরোলেই তাদেরও এই পথে নিয়ে আসতো। ধীরে ধীরে সে বালক ছেলেটিও পাকা ঠগী হয়ে উঠতো। আর এই প্রক্রিয়া চলতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
ঠগীরা যে কেবল ব্যবসায়ী কিংবা পথিকদেরকেই নিজেদের শিকার বানাতো তাই নয়। বহু রাজ পরিবারের সদস্যরাও ঠগীদের শিকার হয়েছে। এই ধরনের শিকারের ক্ষেত্রে তারা আরোও চতুরতা অবলম্বন করতো।
যেহেতু তারা সন্ন্যাসী কিংবা বণিক সেজে লুটপাট চালাতো তাই অপরিচিত হওয়ায় তারা রাজ সদস্যদের দলের কাছাকাছি খুব একটা ঘেঁষতে পারতো না। আর তাই তারা তাদের দলের নারীদের এই কাজে ব্যবহার করতো। পথ চলতে গিয়ে রাজ সদস্যদের দল হঠাৎ দেখতে পেতো কোনো রূপসী নারী মাঝ পথে বসে কাঁদছে আর তা দেখে তারা নেমে তার কাছে তার কান্নার কারন জানতে চাইলো, আর সেই মহিলাও বানিয়ে বানিয়ে নিজের দুঃখের কথা বলতে শুরু করলো। আর তাকে বাঠি ফিরিয়ে দিয়ে আসতে আবদার করে বসলো। আর তারাও না করতে পারলো না। আর তাকে নিজেদের বহরে সঙ্গী কটে নিলো। আর হঠাৎই দেখা গেলো সেই মহিলাই রোমাল দিয়ে ফাঁস দিয়ে উপকারীর হত্যা করলো আর সঙ্গে সঙ্গে তার ঠগী সাঙ্গোপাঙ্গরা হামলা করে পুরো দলকেই হত্যা করে ফেললো।
ঠগীদের খুন করার অস্ত্র ছিল রোমাল, হলুদ কাপড়ের অতি সাধারণ এক অস্ত্র, তবে খুবই কার্যকরী। রেমালের মাঝে তারা রুপোর টাকা বেঁধে রাখতো আর সেটাই হয়ে উঠতো অব্যর্থ মরণ ফাঁস।
ঠগীদের এই ত্রাসের সমাপ্তি হয় ইংরেজদের মাধ্যমে। ঠগীদের ব্যপারে ইংরেজরা শুরুতে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। তারা তাদের ছুঁচোপুচকে ৮/১০ টা সাধারণ ডাকাত দলই মনে করতো। তবে ইংরেজদের টনক নরে ১৮২০ সালের দিকে। তখন তারা প্রচুর গণকবর আবিষ্কার করে। একেকটি গণকবরের মৃতের সংখ্যা ছিলো ৫০ বা তারো বেশি।
ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের নিমূর্ল করার জন্য উইলিয়াম শ্লিমানকে দায়িত্ব দেয়। স্লিম্যান তখন বেঙ্গল আর্মির অফিসার ছিলেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি।
ভারতে আসার পর তিনি ঠগীদের নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। ঠগীদের ব্যপারে তিনি এতোটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে তার সহকর্মীরা তার নাম দিয়েছিলো ঠগী স্লিম্যান।
শুরুর দিকে স্লিম্যান কিছুতেই অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদের থেকে ঠগীদের পৃথক করতে পারছিলেন না, কারন ঠগীরা অত্যন্ত নিপুণ কৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল।
স্লিম্যান গুপ্তচর নিয়োগ করলেন, গঠন করলেন বিশেষ পুলিশ বাহিনী ও আলাদা বিচার আদালত। পাশাপাশি ঠগীদের অপরাধস্থল বিশ্লেষণ করে তৈরি করলেন মানচিত্র এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করলেন যাতে পরবর্তী হত্যার সময়কাল আঁচ করা যায়। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ সেসব স্থানে পাঠাতে থাকেন।
তারপর ১৮৩০ সালে শ্লিমানের গুপ্তচরদের দক্ষতায় ঠগীরা দলে দলে ধরা পড়তে থাকে। এদের কারো কারো মৃত্যুদণ্ড, কারো যাবজ্জীবন জেল, কারো বা দ্বীপান্তর দিয়ে এদের দমন করতে সক্ষম হন।
এই ঠগীদের বিনাশ করতে গিয়ে স্লিম্যান ঠগীদের ভাষাও শিখে ফেলেছিলেন। ঠগীদের ধরার পর স্লিম্যান তাদের জবানবন্দি নিতেন। তখন উঠে আসতো বিচিত্র সব নৃশংস ঘটনার কথা, যা শুনলে সভ্য সমাজের মানুষের আত্মা কেঁপে উঠবে।
স্লিম্যান মৃত্যুদন্ড দেয়ার আগে ঠগীদের শেষ ইচ্ছে জানতে চাইতেন। তাদের বেশিরভাগেরই শেষ ইচ্ছে ছিলো হিন্দু ঠগী হলে তার মৃত্যুর পর তার দেহ পুড়িয়ে ফেলতে বলতো আর মুসলমান ঠগী হলে বলতো লাশ কবর দেয়ার জন্য। অনেক ঠগী নিজেদের মৃত্যুর আগে স্লিম্যান কে বলতেন, স্বর্গে যাই কিংবা নরকে ঠগীর রোমালের ফাঁস থেকে তুমি বাঁচবে না।
স্লিম্যান একেকটা ঠগীদের দলকে ধরতেন আর একসঙ্গে ৩০/৪০/৫০ জন ঠগীকে ফাঁসি নিয়ে মৃত্যু কার্যকর করতেন। স্লিম্যান এতো দ্রুত ঠগী দলগুলোকে ধরতে শুরু করেছিলেন যা বাকি যারা ঠগী ছিলো তারা নিজেদের এই জঘন্য পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
আর সেই সাথে বিলুপ্তি ঘটে ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ডাকাত সম্প্রদায়ের।
তথ্যসূত্রঃ ঠগী – শ্রীপান্থ