হত্যা বা খুন রহস্য যাই বলি না কেনো, এইসব বিষয়ে সাধারণ মানুষের সহজাতভাবেই আগ্রহ থাকে। ইদানীং কথাসাহিত্যে এই জনরার পাঠক চাহিদা ও ব্যাপক। ইতিহাস জুড়ে প্রচুর অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ড রয়েছে যা জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কেসের শেষটা সন্তোষজনক নয়। কখনো কখনো খুনিরা আইনকে ধোঁকা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কখনোবা পুলিশ কিংবা ডিটেকটিভ হত্যার কোনো সূত্রই খুঁজেই পান নি।
১. স্যার হ্যারি ওকস মার্ডার কেস
স্যার হ্যারি ওকস একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি কানাডার উত্তর অন্টারিওতে একটি বড় গোল্ড ফিল্ডের মালিক ছিলেন। হ্যারি তার জীবনে প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন। সেই অর্থে প্রচুর সম্পত্তি কিনেছেন, বিভিন্ন দেশেও তার মালিকানাধীন জমি ছিল। বাহামাতে (ক্যারিবিয়ান দ্বীপ দেশ, তখন ব্রিটিশ কলোনী ছিল) তার প্রচুর প্রভাব ছিল, যেখানে তিনি ওয়েস্টবোর্ন নামে পরিচিত একটি বড় বাড়িতে থাকতেন।
কিন্তু হ্যারির নিখুঁত জীবন একটি অপ্রীতিকর মোড় নেয়; ১৯৪২ সালে যখন তার আঠারো বছর বয়সী মেয়ে ন্যান্সি আলফ্রেড ডি ম্যারিগনিকে বিয়ে করে। ন্যান্সি স্কুল শেষ করার বেশ কয়েক দিন পরে গোপনে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি নিউইয়র্কে হয়েছিল।
হ্যারি যখন মেয়ের বিয়ের কথা জানতে পারেন, তখন তা শুনপ তিনি মোটেও খুশি হতে পারেন নি। মেয়ে জামাই আলফ্রেড কে তিনি মেটেও মেনে নিতে পারেন নি। আলফ্রেড ছিল বড়লোক বাবার বখে যাওয়া ছেলে, যে বাবার টাকা উড়াতো আর বিভিন্ন মেয়েদের ফস্টি-নস্টি করে বেড়াতো, সহজ ভাষায় যাকে ‘লেভিশ প্লেবয়’। মেয়ে জামাই আলফ্রেড এর সাথে হ্যারির একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল ল, সেই সাক্ষাৎ এ আলফ্রেড হ্যারিকে হুমকি ধমকি দিয়েছিলেন।
এরপরের সময়টা ১৯৪৩ সালের ১৭ জুলাই, হ্যারি কে তার শোবার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কেউ মাঝরাতে ভোঁতা যন্ত্র দিয়ে আক্রমণ করেছিল, সেই যন্ত্রদিয়ে পিটিয়ে তার মাথার খুলিও ভেঙে ফেলেছিল এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। লাশেরও একাধিক জায়গায় আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।
বেশ কয়েকদিন পর আলফ্রেডকে হত্যার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল অপ্রতুল। প্রাথমিকভাবে, তদন্তকারীরা অপরাধের জায়গায় আলফ্রেডের আঙুলের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করার জন্য তারা যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল তা গোঁড়া থেকে দূরে ছিল, প্রমাণের উপর সন্দেহ জাগিয়েছিল।
যদিও এটা জানা ছিলো যে দুই শ্বশুর ও জামাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক ভালে ছিলো না, কিন্তু শুধুমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে আলফ্রেড কে দোষী সাব্যস্ত করার সুযোগ ছিলো না। বিচারে ১২ জন জুরির মধ্যে ৯ জন আলফ্রেড কে খালাসের পক্ষে ফেট দেয়, আর ৩ জন বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের অদ্ভুত ব্যাপার হল যে ওয়েস্টবোর্নের কেউ সেদিন রাতে এই হত্যাকান্ড ঘটতে শুনেনি। শরীরের পোড়া দাগও অদ্ভুত। খুনি কি প্রমাণ লোপাট করার জন্য শরীরে আগুন লাগিয়েছিলো? নাকি খুনি তার শিকার কে নিয়ে শুধুই উপহাস করার জন্য এমনটা করেছে?
বহু বছর পেরিয়ে গেলেও এটা আজও এক অসমাপ্ত রহস্য, কে এই মিলিয়নারি কে খুন করেছে?
২. ব্ল্যাক ডালিয়া মার্ডার কেস
এলিজাবেথ শর্ট সবসময় হলিউড তারকা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। আর অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই তিনি ১৯৪৩ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসেন। লস অ্যঞ্জেলসে এসে বলিউডে প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকেন। আর সেই সঙ্গে অর্থের জন্য সাময়িক সময়ের জন্য পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য হন।
এলিজাবেথকে সর্বশেষ ৯ জানুয়ারি ১৯৪৭ তারিখে দেখা গিয়েছিল; যখন তাকে তার প্রেমিক বিল্টমোর হোটেলে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে, হোটেলের কাছাকাছির একটি খেলার মাঠে তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। তার দেহকে অর্ধেক টুকরো করা হয়েছিল, এবং তার মুখ থেকে কান পর্যন্ত কাটা ছিল।
ময়নাতদন্তের উপর ভিত্তি করে, তদন্তকারীরা বলেছিলেন যে অভিনেত্রীকে বেশ কয়েকদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল, বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং নির্যাতন করা হয়েছিল। শরীর কেটে তার শরীর থেকে সম্পূর্ণ রক্ত বের করে ফেলা হয়েছে। তবে, এমন কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি যা তাদের হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।
লাশ উদ্ধারের দশ দিন পর একটি সিলবিহীন খাম পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। এতে এলিজাবেথের সামাজিক নিরাপত্তা কার্ড, জন্মসনদ পত্র এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত নথি ছিল। তারপরে, ২১ শে জানুয়ারী, একজন বেনামী কলার লস অ্যাঞ্জেলেস এক্সামিনারের সম্পাদককে ফোন করে, নিজেকে খুনি বলে দাবি করে, আর তিনি বলেন তিনিই বেনামি চিঠিতে এলিজাবেথ এর কাগজপত্র পাঠিয়েছেন৷
এই কলটি বৈধ ছিল কিনা তা জানা অসম্ভব, তবে খুনি বলে দাবি করা লোকেদের দ্বারা পঞ্চাশটিরও বেশি স্বীকারোক্তি ছিল। যদিও পুলিশ এই স্বীকারোক্তিগুলি অনুসরণ করেছিল, তবে তাদের বিশ্বাস করার কোনও কারণ ছিল না যে তারা সত্য বলেছে।
তদন্তের সময়, মিডিয়া ও প্রেস এলিজাবেথকে ‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া’ বলা শুরু করে। এই ডাকনামটি দ্য ব্লু ডাহলিয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ডাকা হয়েছিল। ছবিটি এলিজাবেথের মৃত্যুর এক বছর আগে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি জনপ্রিয় হত্যা-রহস্য চলচ্চিত্র।
কিন্তু সিনেমার বিপরীতে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কোন উপসংহার ছিল না। ব্ল্যাক ডাহলিয়া হত্যাকাণ্ডের সমাধান কখনও হয়নি এবং সম্ভবত এটি কখনই হবে না।
৩. কিথ লিয়ন মার্ডার কেস
কিথ লিয়নের মার্ডার কেসটি ইংল্যান্ডের ইতিহাসের একটি ক্লাসিক কোল্ড মার্ডার কেস, যা ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের সাসেক্সে সংঘটিত হয়েছিল।
মৃত্যুর সময় কিথের বয়স ছিল মাত্র বারো বছর। ওভিংডিন এবং উডিংডিনের মধ্যে একটি সেতুপথ ধরে হাঁটার সময় তিনি নিহত হন। তিনি তার স্কুলের বাড়ির কাজের জন্য একটি নতুন জ্যামিতি সেট কিনতে যাচ্ছিলেন; তখন একজন অজানা আততায়ী তাকে আক্রমণ করে।
হত্যাকাণ্ডটি ছিল নৃশংস। কিথকে রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে এগারোবার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল এবং তার রক্তাক্ত দেহাবশেষ একটি সবুজ মাঠের পাশের ঝোপেঝাড়ের নিচে ফেলে রেখে চলে যায়। খুনি হত্যা শেষে যািয়ার সময় কিথ লিওনের সঙ্গে থাকা ৪ শিলিং ও চাবি নিয়ে যায়।
খুনের অস্ত্রটি এক মাইল দূরে একটি স্কুলের মাঠে পাওয়া যায়। ফরেনসিক পরীক্ষার পর, তদন্তকারীরা দুটি ভিন্ন ধরনের রক্ত আবিষ্কার করেন। প্রথমটি কিথের, এবং দ্বিতীয়টি (সম্ভবত) হত্যাকারীর।
দূর্ভাগ্যবশত এই রক্তমাখা ছুড়িটি পুলিশকে খুনি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে নি। কয়েক দশক পরেও যখন এই মামলাটি খোলা হয়, পুলিশ তার রেকর্ড এ থাকা অপরাধীদের ডিএনএ এর সঙ্গে সেই ছুড়ির রক্তের ডিএনএ এর কোনো মিল পায় নি। কিথের স্থানীয় এলাকার মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ডিএনএ টেস্ট করিয়েও খুনির খোঁজ পাওয়ায় যায় নি।
এতো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন কেউ এই কেস নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাকে ভাবতে বাধ্য করে যে কোন ধরনের দানব একটি নিষ্পাপ শিশুকে অকারণে হত্যা করতে পারে?