তার লেখায় দেখতে পাওয়া যায় সমাজের নিচু শ্রেণীতে বাস করা সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম, দুঃখ যন্ত্রণা ও ভাগ্যের পরিহাস। ভিক্টোরিয়ান সমাজের নৈতিকতা, শ্রেণীবিভাগ, এবং যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক সাহসী কণ্ঠস্বর। ভিক্টোরিয়ান যুগের রক্ষণশীল মানুষদের রক্ষণশীলতার প্রতি তিনি তীব্র সমালোচনা প্রকাশ করেছেন তার লেখায়। নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন, সেই সাথে সমাজের যৌন নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
বলছিলাম ইংরেজি সাহিত্যের ভিক্টোরিয়ান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক টমাস হার্ডির কথা। টমাস হার্ডি ১৯৪০ সালের ২ জুন ইংল্যান্ডের হায়ার বকহ্যাম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন। টমাস হার্ডি ছিলেন তার পরিবারের ৪ সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সন্তান। তার বাবা পেশায় ছিলেন একজন স্থপতি ও সঙ্গীতপ্রেমী। আর মা ছিলেন একজন মেধাবী নারী, যিনি হার্ডিকে বই পড়ায় উৎসাহিত করতেন। টমাস হার্ডির বাবার ইচ্ছে ছিলো তার ছেলে একজন পাদ্রী হবেন। কিন্তু হার্ডির জীবনের লক্ষ্য ছিলো অন্যকিছু।
টমাস হার্ডি ডরসেটের হায়ার বকহ্যাম্পটনের একটি নির্জন কটেজে বেড়ে ওঠেন। হার্ডি তার শৈশবের একটা বড় সময়ই কাটিয়েছেন অসুস্থতার মাঝে। গ্রামের ঋতুভিত্তিক জীবনধারা ও সংস্কৃতি পরবর্তীতে টমাস হার্ডির সাহিত্যের মূল ভিত্তি হয়ে উঠে। তিনি তার বেশিরভাগ উপন্যাস ও কবিতায় ওয়েসেক্স নামে পরিচিত ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক কাল্পনিক গ্রামীণ অঞ্চলকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হার্ডির উপন্যাসের Casterbridge,Weatherbury কিংবা Marlott সবগুলো হার্ডির জন্মস্থান ডরসেটের কাছাকাছি কল্পনা কিন্তু বাস্তব একটি গ্রাম।
মাত্র ৮ বছর বয়সে টমাস হার্ডি গ্রাম্য স্কুলে নিজের লেখাপড়ার পাঠ শুরু করেন। পরবর্তীতে হার্ডি ডরচেস্টারের একটি স্কুলে পড়েন, সেখানে তিনি গণিত ও ল্যাটিনের উপর ভালো দক্ষতা অর্জন করেন। ১৮৫৬ সালে তিনি স্থানীয় স্থপতি শিল্প বিশারদ জন হিক্সের অধীনে শিক্ষানবিশ হন এবং ১৮৬২ সালে লন্ডনে গিয়ে আর্চিটেকচারাল অফিসে কাজ শুরু করেন। ১৮৬৩ সালে এই স্থাপত্য বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার লেখার কারনে টমাস হার্ডি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি ১৮৬৭ সালে ডরসেটে ফিরে আসেন এবং লেখক জর্জ মেরিডিথের পরামর্শে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন।
সাহিত্য জীবনের শুরুতে হার্ডি কবিতার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তার কবিতা পাঠকদের মনে সাড়া না ফেলায় তিনি উপন্যাস রচনার দিকে মনোনিবেশ করেন। টমাস হার্ডির প্রথম উপন্যাস ছিলো The Poor Man and the Lady, কিন্তু তিনি বইটি প্রকাশের জন্য তিনজন প্রকাশক দ্বারা প্রত্যাখ্যান হন।
তখন লেখক কবি জর্জ মেরিডিথ হার্ডির এই পাণ্ডুলিপিটি পড়ে তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, হার্ডি তার লেখায় সামাজিক সমস্যাগুলোকে খুবই সরাসরিভাবে উপস্থাপন করেছে। তিনি হার্ডিকে পরামর্শ দেন এমনভাবে লিখতে যাতে উপন্যাসটি কাহিনীনির্ভর ও পাঠযোগ্য হয়। আর তাই মেরিডিথের পরামর্শ শুনেই টমাস হার্ডি Desperate Remedies লেখেন, যা পরবর্তীতে তার সাহিত্যিক যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ সূচনা হয়ে উঠে।
তবে টমাস হার্ডির সাহিত্য রচনার সাফল্য শুরু হয় Far from the Madding Crowd (১৮৭৪) উপন্যাসের মাধ্যমে। এই উপন্যাস তাকে প্রচুর খ্যাতি এনে দেয়। এই উপন্যাসেই তিনি “ওয়েসেক্স” নামে একটি কল্পিত অঞ্চল তৈরি করেন, যা তার পরবর্তী সাহিত্যকর্মগুলোর মূল পটভূমি হয়ে ওঠে।
টমাস হার্ডি শহরের কৃত্রিমতা, শিল্পকারখানার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও সামাজিক নিতীনৈতিকতার অবক্ষয় কে সহজে মেনে নিতে পারেন নি। আর তাইতো তিনি সবসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চেয়েছেন। প্রকৃতিতেই পেতে চেয়েছেন জীবনের শান্তি।
আর তাই প্রকৃতি মহত্ত্ব বুঝাতে তিনি বলেছেন,
Time changes everything except something within us which is always surprised by change.
টমাস হার্ডি ছিলেন ভাববাদী, নিয়তিবাদী ও নৈরাশ্যবাদী মানুষ। ভাগ্য ও নিয়তিকে তিনি তার লেখায় প্রাধান্য দিতেন। হার্ডি বিশ্বাস করতেন সকল মানুষই নিয়তির হাতের পুতুল। হার্ডির এই বিশ্বাসের সবচেয়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োগ আমরা তার উপন্যাস Tess of the D’Urbervilles (১৮৯১), Jude the Obscure (১৮৯৫) ও The Mayor of Casterbridge (১৮৮৬) এই উপন্যাসগুলোতে দেখতে পাই প্রবলভাবে।
তবে টমাস হার্ডি তার উপন্যাস Tess of the D’Urbervilles (১৮৯১) ও Jude the Obscure (১৮৯৫) এই দুটি উপন্যাসের জন্য প্রচন্ড সমালোচনার শিকার হন। ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল সমাজ ও চার্চ টমাস হার্ডিকে বিদ্রূপ করতে থাকে। Tess of the D’Urbervilles (১৮৯১) বইটির প্রধান চরিত্র টেসকে হার্ডির রক্ষণশীল সমাজ “পাপের প্রতীক” হিসেবে দেখে, কিন্তু হার্ডি তাঁকে একজন নির্দোষ ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করেন। চার্চ বইটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, এবং এটি অনেক জায়গায় নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
Jude the Obscure (১৮৯৫) উপন্যাসে রক্ষণশীল সমাজ ও চার্চের অভিযোগ ছিলো বইটি শোকবিহ্বল এবং নৈতিকভাবে ধ্বংসাত্মক। এই উপন্যাসে টমাস হার্ডি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বৈবাহিক ব্যবস্থার প্রতি তীব্র সমালোচনা করেন, যা রক্ষণশীল সমাজকে ক্ষুব্ধ করে। Jude the Obscure প্রকাশের পর, এক বিশপ বইটি পোড়ানোর ব্যবস্থা করেন, যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
এই ঘটনাগুলো টমাস হার্ডিকে মানসিকভাবে আঘাত করে, তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। হার্ডি বিশ্বাস করেন যে তার সাহিত্য সৃষ্টিকে তারা অনুধাবন করতে পারে নি। এই ঘটনার পর টমাস হার্ডি আর উপন্যাস রচনা করেন নি। আর এখন হার্ডির Tess of the D’Urbervilles এবং Jude the Obscure হার্ডির সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।
উপন্যাস লেখা ছেড়ে দিয়ে হার্ডি ১৯০০ সাল থেকে কবিতা রচনার দিকে মনোনিবেশ করেন। তবে তার প্রায় সব কবিতাই প্রকৃতি, প্রেম এবং মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লেখা। এর পেছনের কারণ হিসেবে ভাব হয় টমাস হার্ডির ব্যক্তিগত জীবন ও প্রথমবিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়কার প্রভাব। হার্ডির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে Wessex Poems and Other Verses ও Poems of the Past and the Present অন্যতম।
টমাস হার্ডির সাংসারিক জীবন খুব একটা সুখকর ছিলো না। হার্ডি ১৮৭০ সালে কর্নওয়ালে একটি গির্জা পরিদর্শনে গিয়ে এমা লাভিনিয়া গিফোর্ড নামে একজন নারীর সাথে তার স্বাক্ষাৎ হয়। ১৮৭৪ সালে তারা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দাম্পত্য জীবনের শুরুটা প্রেমময় হলেও সেই প্রেম দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। দুজনের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এমার মৃত্যু হলে হার্ডি বেশ কিছু আবেগপ্রবণ কবিতা লিখেন।
এমার মৃত্যুর ২ বছর পরে ১৯১৪ সালে হার্ডি ফ্লোরেন্স ডুগডেল নামে একজন তরুণী লেখিকাকে বিয়ে করেন। কিন্তু এই দাম্পত্য জীবনেও হার্ডিকে সেভাবে আনন্দ দিতে পারে নি। দাম্পত্য জীবনে অসুখী জীবন ইউরোপের যুদ্ধ আর বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও সাধারণ মানুষের কষ্ট, এসবকিছুই হয়ে উঠে হার্ডির কবিতার বিষয়বস্তু।
১৯২৮ সালের ১১ জানুয়ারি টমাস হার্ডি ৮৭ বছর বয়সে মারা যান। তাকে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাধিস্থ করা হয়। টমাস হার্ডির সাহিত্য আজও ইংরেজি সাহিত্যে অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। গ্রামীণ ইংল্যান্ড ও গ্রামের সাধারণ মানুষদের জীবন ও তাদের জীবনের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরার অসাধারণ দক্ষতা তাকে বিশ্বসাহিত্যে অমর করে রেখেছে।