You are currently viewing হুয়ানা মারিয়া: নির্জন দ্বীপে নিঃসঙ্গতার ১৮ বছর

হুয়ানা মারিয়া: নির্জন দ্বীপে নিঃসঙ্গতার ১৮ বছর

হুয়ানা মারিয়া ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের সান নিকোলাসের একটি প্রত্যন্ত দ্বীপে আটকে পড়েছিলেন দীর্ঘ ১৮ বছর! সেখানে তিনি পোশাক পরিধান করতেনন পাখির পালক দিয়ে বানানো নিজ হাতে তৈরি পোশাক। তার খাবার ছিলো কাঁচা ও শুকনো মাংস। তিনি যে স্থানে রাত্রিযাপন করতেন তা ছিলো মৃত প্রাণীর হাড় দিয়ে তৈরি!

১৯৬০ এর দশকের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘আইল্যান্ড অফ দ্য ব্লু ডলফিন্স’ স্কট ওলেড হুয়ানা মারিয়ার আত্মজীবনী কে কেন্দ্র করেই রচনা করেছিলেন।

Juana Maria ; Credit :tomorrowpictres .tv

হুয়ানা মারিয়া ঊনবিংশ শতাব্দির শুরতে জন্মগ্রহণ করেন। এই হুয়ানা নামটাও তার নয়, যারা তাকে খুঁজে পেয়েছিল তারা দিয়েছেন। তার প্রকৃত নাম, জন্ম সাল, মাস কিংবা তারিখ কোনোটাই জানা যায় নি। তবে তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর একাকী নির্জন দ্বীপে কাটিয়েছেন এই সময়ের ব্যাপারে কোনো ভুল নেই। ১৮৩৫ সাল থেকে ১৮৫৩ পর্যন্ত সান নিকোলাস এর দ্বীপে আটকে ছিলেন। সবশেষে ১৮৫৩ সালে তিনি মুক্তি পান। অবশ্য মুক্তি পেয়ে তার জীবন আর বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি।

হুয়ানা মারিয়া মারিয়া একজন নেটিভ আমেরিকান মহিলা। যার ছোট্ট পৃথিবী ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের হাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। চলুন আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক…

হুয়ানা মারিয়ার ‘উপজাতির’ ট্রাজেডি

হুয়ানা মারিয়া সান নিকোলাস দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন। দ্বীপটি ক্যালিফোর্নিয়া চ্যানেলের মধ্যে থাকা অনেকগুলো দ্বীপের মধ্যে একটি। তার আদিবাসী গোত্রের নাম ছিল ‘নিকোলিওস’ এই গোত্রটি এই দ্বীপে বসবাস করছিল দীর্ঘ ১০ হাজার বছর যাবৎ!

হাজার বছরের জাতিগত ইতিহাস থাকার পরও তাদের কে অস্তিত্ব হারানোর ট্রাজেডির মুখোমুখি হতে হয়। তাদের প্রথম বিপর্যয় ঘটে ১৮১১ সালে, যখন আলাস্কান ও রাশিয়ান ওটার (উদবিড়াল) শিকারিরা এই দ্বীপে প্রবেশ করে। আর নির্বিচারে হত্যা করে আদিবাসীদের।

১৮৩৫ সালে তাদের জনসংখ্যা কমতে কমতে দাড়ায় মাত্র ২০! হুয়ানা মারিয়া তখন ১০/১২ বছরের কিশোরী।

এই গোষ্ঠীর ব্যাপারে তখন জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। ক্যাথলিক পুরোহিত রা পুরো গোষ্ঠীকে (২০জন) কে এই দূর্গম দ্বীপ থেকে সরিয়ে অন্য স্থানে স্থানান্ত করার অনুরোধ করেছিল। তারা কেনো এই অনুরোধ করেছিলো, সেই ব্যাপারে ইতিহাসের পাতা চুপ থেকে গেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোনা যায় তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করাই তাদের পরিকল্পনা ছিল।

শুধুমাত্র হুয়ানা মারিয়া একাই রয়ে গেলেন সেই দ্বীপে

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই আদিবাসীদের স্থানান্তরিত করার সময় হুয়ানা মারিয়া নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক জায়গায় উল্লেখ পাওয়া যায় হুয়ানা তার ২ বছরের শিশু ভাইকে খোঁজতে গিয়েছিল।

Credit: Wikimedia Commons

কারণ যেটাই হোক হুয়ানা কে সান নিকোলাসে একা ফেলেই জাহাজ টি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বেশি দেরি করলে ঝড়ের সম্মুখীন হতে হবে এর জন্যই জাহাজটি তাড়াহুড়ো করে দ্বীপ ত্যাগ করে।

Credit: Wikimedia Commons

নির্জন দ্বীপে হুয়ানা মারিয়ার নিঃসঙ্গতার ১৮ বছর!

জাহাজটি দ্বীপ ছাড়া পর আর ফিরে আসেনি। দীর্ঘ ১৮ বছর হুয়ানা একাকী থেকেছে। ১৮৫৩ সালে যখন সে ঐ দ্বীপ থেকে উদ্ধার হয়, তখন উদ্ধারকারীরা দেখতে পান; হুয়ানা হাঁস, পাখি শিকার করে তাদের পালক দিয়ে তৈরি পোশাক পড়ে আছেন। সে যে কুটিরে থাকতো তা সে তৈরি করেছে মৃত তিমি ও পশু পাখির হাড় ও লতাপাতা দিয়ে। এছাড়া থাকার জন্য একটি গুহা ও তৈরি করেছিলেন তিনি।

অবশেষে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেলো হুয়ানা মারিয়া!

১৮৩৫ সালে নিজের গোষ্ঠীর সাথে দ্বীপ ত্যাগ করতে ব্যার্থ হওয়া হুয়ানা কোনো মানুষের দেখা পান ১৮৫৩ সালে। দীর্ঘ ১৮ বছর পর তাকে খুঁজে পান ‘ জর্জ নিডেভার’ নামে এক জাহাজের কেপ্টেন।

জর্জ নিডেভার তার স্মৃতিকথায় (The life and Adventure of George Nideever), সেই মুহূর্তটির কথা উল্লেখ করেছেন।

যখন তাকে আমি প্রথম দেখি তখন সে মৃত তিমি থেকে তিমির চর্বি সংগ্রহ করছিল।

তিনি আরো বলেন, সে আমার থেকে দূরে দূরে থাকতো। তারপরই আবার আমার দিকে চেয়ে হাসি দিতো; আর মাথা নত করতো। আবার মাঝেমাঝে অবোধ্য ভাষায় বকবক করতো।

কেপ্টেন তার স্মৃতিকথায় আরো বলেনঃ-

সে মাঝারি উচ্চতার ছিলো। বয়স দেখে মনে হচ্ছিল প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি; কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে খুব শক্তিশালী ও বিচক্ষণ। তার মুখটি আনন্দময় ছিলো, কারণ আমাদের দেখে সে ক্রমাগত হাসছিল। গায়ে ছিল চামড়া আর পাখির পালকে মিশ্রিত এক অদ্ভুত ধরনের পোশাক।

মজার ব্যাপার হচ্ছে মহিলা তার সঙ্গে অনেকগুলো জিনিস সঙ্গে করে জাহাজে উঠেছিল। তার মধ্যে একটা হাড় দিয়ে তৈরি সুচ ও ছিল। সম্ভবত ওটা দিয়েই তিনি তার পোশাক সেলাই করতেন।

১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে যে জায়গায় তার জিনিসপত্র গুলো রাখা হয়েছিলো সেই জায়গাটি ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফলে ইতিহাসবিদদের কাছে হুয়ানার জীবনের কোনো জিনিসই নেই।

হুয়ানা কারো সাথেই কথা বলতে পারেনি

একমাত্র ভাষাই একজন মানুষকে অন্য মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। হুয়ানার ভাষা কেউ বুঝতে পারতো না। কারণ সে তার স্থানীয় ভাষায় কথা বলতো। হুয়ানা তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে হয়তো অনেক কিছুই বলার ছিলো কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে উঠে নি। ইতিহাসবিদরা নেটিভ আমেরিকানদের ভাষা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছে কিন্তু হুয়ানার ভাষার সঠিক নাম অর্থ কিছুই বের করতে পারেন নি।

হুয়ানার আদিবাসীরা এখন কোথায়?

প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয়ই? হুয়ানা কি তার আদিবাসী গোত্রের মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে কিনা? উত্তরটি দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, না! হুয়ানা তার গোত্রের কারোরই দেখা পান নি! তার গোত্রের সবাই মারা গেছে। সেই একমাত্র শেষ জীবিত ব্যাক্তি ছিল তার গোত্রের।

তার গোত্রের আদিবাসীরা সেই স্থান ত্যাগ করার পর সবাই মারাত্মক রোগ অসুখে আক্রান্ত হতে থাকে। তাদের সকলেরই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল একদমই কম। দূর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য খুব অল্প সময়েই সবাই মারা যায়।

হুয়ানা মারিয়ার মৃত্যু

হুয়ানা মারিয়া দ্বীপ ছাড়া পর বেশিদিন বাঁচেন নি। সান নিকোলাস দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার পর তিনি রোগ ভোগে ভুগতে শুরু করেন। আর সেই সকল রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তার শরীরে ছিলো না। যে বছর উদ্ধার হন। ঠিকই সেই বছরই ১৮৫৩ সালে উদ্ধারের মাত্র ৭ সপ্তাহের মধ্যেই হুয়ানার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু ও যেন তার জীবনের মতোই রহস্য রেখে গেছে।

Reference: Wikipedia, Wikimedia Commons, medium

Leave a Reply