You are currently viewing জার্মান নাৎসি বাহিনীর অমানবিক ও নৃশংস মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট

জার্মান নাৎসি বাহিনীর অমানবিক ও নৃশংস মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট

যুদ্ধ মানে ধ্বংস, আর সেই ধ্বংসের প্রধান বলি সাধারণ মানুষ। এখন পর্যন্ত মানব ইতিহাসে যতগুলো যুদ্ধ সৃষ্ট হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুটো। এরমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে কয়েকগুণ বেশি ছাপিয়ে গিয়েছে।

যুদ্ধতে যে কেবল সৈন্য,সম্পদ,সাধারণ মানুষের মৃত্যু,ধর্ষণ ও লুটপাট ঘটে তাই নয়। সেই যুদ্ধ মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও করা হয়। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান, আমেরিকা কিংবা রাশিয়া সহ আরো অনেক দেশ বন্দী শিবিরের মানুষের উপর অমানবিক নির্যাতন ও মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। আজ এদের বিষয়ে আলোচনা করবো না। আজ কথা বলবো হিটলারের জার্মান নাৎসি বাহিনীর বিজ্ঞানী ও চিকিৎসদের নৃশংস কিছু মেডিকেল পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে।



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাম শুনলেই মাথায় প্রথমেই চলে আসে হিটার আর তার নাৎসি বাহিনীর কথা আর ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যার কথা। নাৎসি বাহিনী যে কেবল ইহুদি হত্যা করেছে তাই নয়! নাৎসি বাহিনী তাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি ছাড়াও রোমান, পোলিশ,রাশিয়ান বন্দীদের উপর নৃশংস পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিল, এমনকি বিভিন্ন প্রতিবন্ধী জার্মান নাগরিকরাও নাৎসিদের সেই নৃশংসতার হাত থেকে মুক্তি পায় নি।

জনশ্রুতি রয়েছে যে জার্মান নাৎসি বাহিনীর এই নৃশংস পরীক্ষা নিরীক্ষা শুধুমাত্র ডঃ জোসেফ মেঙ্গেলের অধীনস্থ আউশউইৎস ক্যাম্পে ঘটেছে। তবে এই কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে অন্যান্য ক্যাম্পগুলোতে এসব ঘটেনি। প্রায় সবগুলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই বন্দীদের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে।



যাদের উপর পরীক্ষা করা হয়েছিল তারা পরীক্ষায় স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি কিন্তু বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছিল এবং ডাক্তারদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল যারা এই প্রকৃত নির্যাতনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। এছাড়াও সেই সকল ব্যক্তিদের কখনই জানানো হয়নি যে তারা কোন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে এবং ফলাফলগুলি প্রায়শই অংশগ্রহণকারীদের মৃত্যু, বিকৃতি বা অঙ্গচ্ছেদ নিয়ে গঠিত।

যুদ্ধের পরে, এই ডাক্তারদের দ্বারা সম্পাদিত অপরাধগুলি নুরেমবার্গ ট্রায়ালে আলাদাভাবে বিচার করা হয়েছিল যা ইতিহাসে ডক্টরস ট্রায়াল হিসাবে পড়েছিল। এটা উল্লেখ করা উচিত যে ডক্টর জোসেফ মেঙ্গেল কখনোই বিচারকদের একটি প্যানেলের সামনে আসেননি, তিনি যুদ্ধের শেষে আর্জেন্টিনায় পালাতে সক্ষম হন (তবে তা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক রয়েছে)।

চলুন নাৎসি বাহিনীর বন্দীদের উপর চালানো বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পর্কে জানি।



যমজদের নিয়ে পরীক্ষা



‘অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ’ বা ‘মৃত্যুদূত’ খ্যাত নাৎসি চিকিৎসক জোসেফ মেঙ্গেল যমজদের নিয়ে অনেক পরীক্ষাই চালিয়েছিলেন। অসউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীরা আসলেই তিনি সেখান থেকে বেছে বেছে যমজদের আলাদা করে রাখতেন। প্রতিদিন রুটিন করে যমজদের রক্তের নমুনা নেয়া হতো। এর পেছনের কারণ যে আসলে কী তা আজও জানা যায় নি। যমজদের শরীর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করা হতো। তাদের শরীরের প্রতিটি অংশের মাপ নেয়া হতো যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে। এমনকি কখনো কখনো একজন থেকে আরেকজনের শরীরে রক্ত সঞ্চালনও করা হতো মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে।

জোসেফ মেঙ্গেল; Source: Wikimedia Commons



মাঝে মাঝে যমজদের একজনের শরীরে হয়তো কোনো রোগের জীবাণু প্রবেশ করিয়ে দেয়া হতো। যদি সে মারা যেত, তাহলে অপরজনকেও মেরে ফেলা হতো দুজনের শারীরিক বিষয়াবলীর তুলনামূলক গবেষণার জন্য। চেতনানাশক ব্যবহার ব্যতিরেকেই অনেকের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলা হতো।

Source: la8period7.pbworks.com



ক্যাম্পে হাসি-খুশি যে যমজ শিশুগুলো পা রাখতো, তাদের অধিকাংশেরই আর বাইরের পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য হতো না। ময়নাতদন্তের মাধ্যমে মানুষরুপী একদল জানোয়ারের গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়াই ছিলো তাদের অন্তিম নিয়তি।



হাড়, পেশী বা স্নায়ু প্রতিস্থাপন



এই পরীক্ষাগুলি মূলত Ravensbrück-এ মহিলাদের শিবিরে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে হয়েছিল। এই পরীক্ষায় প্রায়শই বন্দীদের কাছ থেকে হাড়, পেশী বা স্নায়ুর টুকরো অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই নেওয়া হতো। বিভিন্ন টিস্যুর পুনর্জন্ম পর্যবেক্ষণ করার বা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে টিস্যু প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যারা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই সংক্রমণ বা অঙ্গচ্ছেদের কারণে ভয়ানক যন্ত্রণায় মারা গেছেন।

আরো পড়ুন:  তারারে: পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ; যিনি জীবন্ত কুকুর, বিড়াল এমনকি বাচ্চা শিশু খেয়েছিলেন
Credit: All that interesting

স্পটেড ফিভারের পরীক্ষা

এ পরীক্ষার ব্যাপ্তিকাল ছিলো ১৯৪১ সালের শেষের দিক থেকে ১৯৪৫ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত। বুখেনওয়াল্ড ও নাৎজওয়েইলার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের চিকিৎসকেরা জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য সেখানকার বন্দীদের উপর স্পটেড ফিভার ও অন্যান্য রোগের ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণা চালায়।

Source: medicinenet.com



প্রথমে ৭৫ ভাগ বন্দীকে স্পটেড ফিভারের পরীক্ষণরত ভ্যাকসিনটি দেয়া হয়। এরপর তাদের দেহে প্রবেশ করানো হয় রোগটির ভাইরাস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভ্যাকসিনটি অকার্যকর হওয়ায় তাদের প্রায় ৯০ ভাগই মারা যায় এতে।

অবশিষ্ট ২৫ ভাগের শরীরে কোনো ভ্যাকসিন ছাড়াই স্পটেড ফিভারের ভাইরাস প্রবেশ করালে তাদেরও অধিকাংশ মারা যায়।

রক্ত জমাট বাধার পরীক্ষা

ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের উপর রক্ত জমাট বাধা সংক্রান্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন জার্মান চিকিৎসক সিগমুন্ড র‍্যাশার। এই উদ্দেশ্যে বীট ও আপেলের পেক্টিন (চিনির মতো এক ধরনের যৌগিক পদার্থ যা জ্যাম, জেলি বানাতে ব্যবহৃত হয়) থেকে তিনি পলিগ্যাল নামক একটি ট্যাবলেট বানিয়েছিলেন। ডাক্তার র‍্যাশার ভেবেছিলেন তার নিজস্ব ফর্মুলায় তৈরিকৃত এ ট্যাবলেটটি বোধহয় যুদ্ধক্ষেত্র ও চিকিৎসায় রক্তপাত বন্ধ করতে সাহায্য করবে।

ডাক্তার সিগমুন্ড র‍্যাশার; Source: scrapbookpages.com



ট্যাবলেটটি আসলেই কাজ করছে কিনা সেটি বোঝার জন্য প্রথমেই বন্দীকে সেটি খাওয়ানো হতো। এরপর সরাসরি গুলি করা হতো তার বুক কিংবা ঘাড়ে! পরবর্তীতে চেতনানাশক প্রয়োগ না করেই দুর্ভাগা সেই বন্দীদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়া হতো। পরবর্তীতে এদের বেশিরভাগই বন্দী সংক্রমণে মারা গেছে।

সালফোন্যামাইড পরীক্ষা



এবার যাওয়া যাক র‍্যাভেন্সব্রুক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানকার বন্দীদের উপর সালফোন্যামাইড তথা সালফা ড্রাগের বিভিন্ন পরীক্ষা চালানো হতো। এজন্য প্রথমেই একজন বন্দীর পায়ের বেশ কিছু অংশ কেটে ফেলা হতো। এরপর সেখানে ব্যাক্টেরিয়ার মিশ্রণ ঘষে জায়গাটি সেলাই করে বন্ধ করা হতো। আসল যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা আনার জন্য মাঝে মাঝে সেখানে গ্লাস স্প্লিন্টারও লাগানো হতো।

Source: utoronto.ca



তবে সত্যি কথা হলো, সম্মুখযুদ্ধে সৈন্যরা যেভাবে আহত হতো, সেই তুলনায় বন্দীদের এই কাটাছেঁড়া ছিলো একেবারেই নগণ্য। বন্দুকের গুলির ক্ষতের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে একজন বন্দীর রক্ত নালিকা কেটে উভয়পাশই বেঁধে দেয়া হতো যেন রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই অমানবিক পরীক্ষাগুলো পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ওষুধের উন্নতিতে অনেক অবদান রেখেছিলো- এ কথাটি যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি এটাও অনস্বীকার্য যে, মারাত্মক সেই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে অনেক বন্দীরই আজীবনের জন্য কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়ে যেত, এমনকি মারাও গিয়েছে অনেকে।

হাইপোথার্মিয়ার প্রভাব পরীক্ষা করা


এছাড়াও সামরিক চিকিৎসার প্রয়োজনে, বিশেষ করে পূর্ব ফ্রন্টে কঠিন পরিস্থিতিতে, লুফ্টওয়াফে মানবদেহের ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। এই পরীক্ষার বেশিরভাগ গিনিপিগ ছিল রাশিয়ান বন্দী। তারা জার্মানদের তুলনায় জেনেটিক্যালি বেশি প্রতিরোধী বলে বিবেচিত হয়েছিল, তাই তারা বারবার এই পরীক্ষাগুলির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।

Source: pbs.org


আর এজন্য প্রায় ৪০০ টি পরীক্ষা করা হয়েছিলো। পরীক্ষা করবার জন্য বন্দীদের ঠান্ডা বরফ জলে ও তুষারের মধ্যে নগ্ন হয়ে ঠান্ডা সহ্য করতে হয়েছিল।
প্রায় ৩০০ জন বন্দীর উপর এই পরীক্ষা একাধিকবার করা হয়েছিল এবং অনেকেই ঠাডায় মারাও গেছে। এমনকি মারা যাওয়া সেসকল ব্যাক্তিদের পুনরুজ্জীবিত করার বিভিন্ন পদ্ধতিও চেষ্টা করা হয়েছিল। এর জন্য মৃতের দেহ গরম ফুটন্ত পানিতে ফেলে দেয়া হতো।

বিষ নিয়ে পরীক্ষা

মানবদেহে বিভিন্ন বিষের প্রভাব যাচাইয়ের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিলো বুখেনওয়াল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের। ১৯৪৩ সালের দিকে গোপনে তাদের খাবারের মাঝে বিষ মেশানো শুরু হয়।

Source: IDR Hazardous Waste Disposal Blog



কেউ কেউ সেসব বিষের প্রভাবে তাৎক্ষণিকভাবেই মারা গিয়েছিলো। কিছু বন্দীকে মেরে ফেলা হয়েছিলো ময়নাতদন্ত করে অধিক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এক বছর পরে আরো অনেক বন্দীকে সরাসরি বিষ মেশানো বুলেট দিয়ে গুলি করা হয়েছিলো দ্রুত তথ্য লাভের আশায়। এদের কষ্ট হয়েছিলো সবচেয়ে বেশি।

ম্যালেরিয়া এক্সপেরিমেন্ট




এবারের দুর্ভাগারা ছিলো ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দী। প্রায় তিন বছর সময় ধরে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য সেখানকার প্রায় এক হাজার বন্দীর উপর পরীক্ষা চালায় নাৎসি বাহিনীর চিকিৎসকেরা। সুস্থ বন্দীদের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করানো হতো। এরপর নাৎসি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে চলতো রোগীদের উপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অনেকেই এ সময় মারা যায়। যারা বেঁচে যায়, তাদেরও সহ্য করতে হয় নিদারুণ কষ্ট। অনেকে সেসব ওষুধের প্রভাবে চিরতরে পঙ্গুও হয়ে গিয়েছিলো।

আরো পড়ুন:  শ্বেতাঙ্গ দাস: ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা এক অধ্যায়

সালফোন্যামাইড পরীক্ষা



এবার যাওয়া যাক র‍্যাভেন্সব্রুক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানকার বন্দীদের উপর সালফোন্যামাইড তথা সালফা ড্রাগের বিভিন্ন পরীক্ষা চালানো হতো। এজন্য প্রথমেই একজন বন্দীর পায়ের বেশ কিছু অংশ কেটে ফেলা হতো। এরপর সেখানে ব্যাক্টেরিয়ার মিশ্রণ ঘষে জায়গাটি সেলাই করে বন্ধ করা হতো। আসল যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা আনার জন্য মাঝে মাঝে সেখানে গ্লাস স্প্লিন্টারও লাগানো হতো।



তবে সত্যি কথা হলো, সম্মুখযুদ্ধে সৈন্যরা যেভাবে আহত হতো, সেই তুলনায় বন্দীদের এই কাটাছেঁড়া ছিলো একেবারেই নগণ্য। বন্দুকের গুলির ক্ষতের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে একজন বন্দীর রক্ত নালিকা কেটে উভয়পাশই বেঁধে দেয়া হতো যেন রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই অমানবিক পরীক্ষাগুলো পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ওষুধের উন্নতিতে অনেক অবদান রেখেছিলো- এ কথাটি যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি এটাও অনস্বীকার্য যে, মারাত্মক সেই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে অনেক বন্দীরই আজীবনের জন্য কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়ে যেত, এমনকি মারাও গিয়েছে অনেকে।



আগ্নেয় বোমার পরীক্ষা



১৯৪৩-৪৪ সালের মাঝে তিন মাস ধরে বুখেনওয়াল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের উপর চালানো হয় অমানবিক এক পরীক্ষা। বিভিন্ন আগ্নেয় বোমায় (Incendiary Bomb) ব্যবহৃত ফসফরাসের কারণে শরীরে যে ক্ষতের সৃষ্টি হতো, তার বিরুদ্ধে জার্মানদের ওষুধগুলো কতটা কার্যকর সেটা বুঝতেই করা হতো এমন পরীক্ষা। এ উদ্দেশ্যে প্রায় সময়ই সেসব বোমায় ব্যবহৃত ফসফরাস দিয়ে বন্দীদের শরীর পুড়িয়ে দেয়া হতো!




নোনা পানির পরীক্ষা




সমুদ্রের নোনা পানি মুখে গেলে আমরা সাথে সাথেই চোখ-মুখ কুঁচকে তা ফেলে দেই। কিন্তু এই নোনা পানিকে পানযোগ্য করতে চালানো পরীক্ষাতেও গিনিপিগ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিলো ডাকাউ ক্যাম্পের বন্দীদের। এজন্য প্রথমে বন্দীদের চারটি দলে ভাগ করে নেয়া হতো। এগুলো হলো- ১) কোনো পানি নয়, ২) কেবলমাত্র সামুদ্রিক পানি, ৩) বার্কা পদ্ধতিতে শোধনকৃত সামুদ্রিক পানি এবং ৪) লবণমুক্ত সামুদ্রিক পানি।

Source: pinterest



এ সময় বন্দীদেরকে কোনো খাবার কিংবা দলের জন্য নির্ধারিত পানীয় ব্যতীত অন্য কোনো পানীয়ও দেয়া হতো না। যাদের পানীয়ের তালিকায় সমুদ্রের নোনা পানি স্থান পেতো, তারা নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হতো। ডায়রিয়া, কনভালশন, হ্যালুসিনেশন, উন্মত্ততা ইত্যাদির পর একসময় তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।



অনার্যদের নিধন


অনার্যদের নিধনের জন্য কোন পদ্ধতিতে সবচেয়ে কম সময় ও অর্থ খরচ হবে, সেটি খুঁজে বের করতেও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে নাৎসি বাহিনীর চিকিৎসকেরা। এক পরীক্ষায় স্ত্রী-জননাঙ্গে একটি রাসায়নিক পদার্থ ঢুকিয়ে দেয়া হতো যাতে করে বন্ধ হয়ে যেত ফ্যালোপিয়ান টিউব। কেউ কেউ এর ফলে মারা যেতেন। আবার ময়নাতদন্ত করার জন্যও এদের মাঝে কোনো কোনো মহিলাকে হত্যা করা হতো।



আরেক পরীক্ষার কথা জানা যায় যেখানে বন্দীদের সুতীব্র এক্স-রে’র মুখোমুখি হতে হত। ফলে তাদের পাকস্থলি, কুঁচকি ও নিতম্ব অনেকটাই পুড়ে যেত। এ ক্ষতগুলোর অনেকগুলোই ছিলো নিরাময়ের অযোগ্য। আক্রান্তদের কেউ কেউ এর ফলে মারাও যেত।



উচ্চতা সংক্রান্ত পরীক্ষা




আবারো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, আবারো ডাকাউ ক্যাম্প। এবারের পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিলো ১৯৪২ সালের মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। ডাকাউ ক্যাম্পের বন্দীদের দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিলো মানুষ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ কত উচ্চতা পর্যন্ত জ্ঞান না হারিয়ে টিকে থাকতে পারে। এই পরীক্ষাটি জার্মান এয়ার ফোর্সের জন্য করা হয়েছিলো।

পরীক্ষা চালানোর পর অজ্ঞান হয়ে পড়া এক বন্দী; Source: jewishvirtuallibrary.org



বন্দীদেরকে নিম্ন-চাপ সম্বলিত এমন একটি কক্ষে রাখা হতো যার অবস্থা হতো অনেকটা ২১,০০০ মিটার (৬৮,০০০ ফুট) উচ্চতার মতো। এ পরীক্ষার মাঝে দিয়ে যাওয়া অধিকাংশ বন্দীই মারা গিয়েছিলো। যারা বেঁচে ছিলো, তাদের শারীরিক অবস্থারও মারাত্মক অবনতি ঘটেছিলো।