এডওয়ার্ড মর্ড্রেক সম্ভবত ১৮৭১ কিংবা ১৮৭২ সালে জন্মেছিলেন, তার সঠিক জন্মতারিখ এর দলিল পাওয়া যায় নি। এডওয়ার্ড ছিলেন এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা একজন বুদ্ধিমান ও সুদর্শন যুবক। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী। এবং খুব অল্প বয়সেই এডওয়ার্ড সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
কিন্তু তার এতো জ্ঞান, গুণ ও প্রতিভার সাথে তিনি একটি গোপন অভিশাপ নিজের সাথে বহন করে চলছিলেন!
তিনি তার মাথার খুলির পিছনে একটি ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় মুখ বহন করেছিলেন। সেই মুখটি ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাক্তিত্ব।
এডওয়ার্ড মর্ড্রেক এর এই মুখটি ছিল মেয়েলি ধরনের। এডওয়ার্ড মরড্রেক এক পরিচায়কের ভাষ্যমতে..
এটা ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতো সুন্দর এবং শয়তানের মতো ভয়ঙ্কর।
আধুনিক যুগের জানুস
প্রাচীন রোমের রোমান নাগরিকরা এক দেবতার পূজা করতেন। তার নাম ছিলো জানুস। এছাড়া গ্রীকরাও জানুস দেবতার পূজা করতো। এই জানুস দেবতাকে উল্লেখ করছি এই কারনে যে এই দেবতারও সামনে পেছনে ২ খানা মুখ ছিল।
এই দুমুখো এডওয়ার্ড মর্ড্রেকের সম্পর্কে প্রচলিত ছিল বিভিন্ন অদ্ভুত গল্প। দ্বিতীয় মুখটি মর্ড্রেকের প্রধান মুখের বিপরীত ছিল। শেনা যায় এডওয়ার্ড যখন দুঃখ ও বিষণ্ণতায় কাঁদতেন, দ্বিতীয় মুখটি তখন হাসতে বা উপহাস করতে পছন্দ করত।
এডওয়ার্ড এর দ্বিতীয় মুখটি তার সামনের মুখের তুলনায় অনেক ছোট ছিল। এই মুখের চোখ মুখ কিংবা কানের নিয়ন্ত্রণ এডওয়ার্ড এর মস্তিষ্কের ছিলো। এই মুখটি নিজেই একটি আলাদা ব্যাতিত্ব হয়ে উঠেছিল। আর সবসময় সেই মুখটি কিছু না কিছু নিয়ে বিরবির করতো।
দ্বিতীয় মুখটি দেখতে বেশ ভয়ঙ্কর ছিল। এর অত্যাচারে এডওয়ার্ড রাতে ঘুমাতে বা বিশ্রাম করতে পারতেন না।
প্রচলিত গল্প অনুসারে, এটি ছিল কারণ এডওয়ার্ডের “ডেভিল টুইন”। মর্ড্রেক বলেছিলেন যে এই অন্য মুখটি কখনই ঘুমাতো না এবং সবসময় এমন সকল জিনিস নিয়ে কথা বলতো যার সাথে পার্থিব জগতের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। সেই মুখটি কেবল নরক ও নরকের নৃশংসতা নিয়ে এডওয়ার্ড মর্ড্রেক কে ভয় দেখাতো।
এই দ্বিতীয় স্বত্বা বা মুখ যাই বলি না কেনো, এটি এডওয়ার্ড এর জীবন কে পাগলপ্রায় করে তুলেছিল। তাই এর মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ১৮৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর মাত্র ২৩ বছর বয়সে এডওয়ার্ড আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা করার আগে এডওয়ার্ড মর্ড্রেক একটি সুইসাইড নোট লিখে যান।
সেই সুইসাইড নোটে তিনি লিখেছিলেন..
এই দ্বিতীয় মুখটি হয়তো আমার মৃত্যুর পরে আমার কবরেও তার কুরুচিপূর্ণ ফিসফিস কথাবার্তা চালিয়ে যাবে।
সেই সুইসাইড নোটে তিনি আরো লিখেছিলেন তার মৃত্যুর পর তাকে কবর দেয়ার আগে যেনো সেই মুখটাকে ধ্বংস করে তারপর কবর দেয়া হয়।
দুই মুখের মানুষের গল্প
এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পরপরই এই দুমুখো মানুষের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা আমেরিকায়। চিকিৎসা পেশাজীবীরা এডওয়ার্ডের অবস্থা নিয়ে গবেষণা প্রকল্প শুরু করেন, তিনি কী রোগে ভুগছিলেন সে সম্পর্কে আরও বিশদ বুঝতে।
১৮৯৬ সালে এডওয়ার্ড মর্ড্রেক এর মৃত্যুর ১ বছর পর এক আমেরিকান চিকিৎসক দম্পতি ওয়াল্টার এল. পাইল এবং জর্জ এম. গোল্ড, তাদের বই ‘Anomalies and Curiosities of Medicine’ এ এডওয়ার্ড মর্ড্রেক সম্পর্কে বিস্তরভাবে লিখেছিলেন। এই বইয়ে যে কেবল এডওয়ার্ড এর কথাই লেখা ছিলো না না, সেই ডাক্তার দম্পতি তাদের চিকিৎসা জীবনে যেসকল অস্বাভাবিক মেডিকেল কেস নিজ চোখে দেখেছেন তার সবই সেই বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন।
মেডিকেল এভিডেন্স
এই ব্যাধিটি মেডিকেলের ভাষায় “ক্র্যানিওফেসিয়াল ডুপ্লিকেশন” হিসাবে পরিচিত। এই অবস্থা প্রাণীদের মধ্যেও দেখা যায় এবং এটি সংযুক্ত যমজের একটি রূপ হিসাবে বিবেচিত হয়। এডওয়ার্ড মর্ড্রেকের মতো একই ক্ষেত্রে, চ্যাং জু পিং নামে আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত অতিরিক্ত মুখের বৈশিষ্ট্য এবং একটি অতিরিক্ত মুখ নিয়ে বেঁচে ছিলেন।
এডওয়ার্ড মর্ড্রেকের একটি মোমের মাথার খুলির ভাস্কর্য সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং এটিতে দুটি মুখ বিশিষ্ট একটি মাথা প্রদর্শন করা হয়েছে, যার একটি মন্দ আবেদনের প্রতিলিপি করে এবং অন্যটির স্বাভাবিক গঠন রয়েছে। ছবিতে একজন লোককে দেখা যাচ্ছে যে সামনে থেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, কিন্তু মাথার খুলি থেকে পিছনের দিকে মুখ করে আরেকটি সম্পূর্ণ গঠিত মাথা।
এডওয়ার্ড মর্ড্রেক তার মেছনের মাথার মানসিক নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু এ ছাড়াও তার আত্মহত্যা করার পেছনে আরো একটি কারণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো, সেটি হলো এডওয়ার্ড এর আশেপাশের মানুষজন!
তারা তার এই দুমুখের জন্য সবসময় তার সামনে ও আড়ালে তাকে অভিশপ্ত বলে কটাখ্য করতো।
এডওয়ার্ড মর্ড্রেক বলে কি সত্যিই কেউ ছিলেন?
বেশ কিছু জায়গায় এই কথার উল্লেখ পাওয়া যায় যে এডওয়ার্ড বলে কেউ ছিলেন না, এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি গল্প।
সত্যি বলতে এডওয়ার্ড মর্ড্রেক এর জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। ফলে হয়তো এই প্রশ্ন টা তোলাই যায়। কারণ তার বিকৃত শরীরের জন্য সবসময় তিনি নির্জনে থাকতেই পছন্দ করতেন। এডওয়ার্ড তার চিকিৎসকদের বলতেন তার পূর্বপুরুষদের কোনো পাপের ফলই হয়তো তিনি বহন করছেন।
তার নির্জনতার জীবন, এবং তার মামলার মর্মান্তিক প্রকৃতির কারণে, অনেকে গল্পটিকে জাল বলে মনে করেন।
তবে তাকে নিয়ে সে সময় বোস্টন সানডে একটি নিবন্ধন প্রকাশ করে। এই পত্রিকাটি আধুনিক বিজ্ঞানের সকল বিষ্ময়কর ঘটনা সম্পর্কে লেখা ছাপাতো।
বর্তমানে ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করলে এডওয়ার্ড মর্ড্রেক এর যে সকল ছবি পাওয়া যায় সেগুলো আদৌ এডওয়ার্ড মর্ড্রেক এর আসল ছবি নয়। তার ছবিগুলো অনুমানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা।
তবে এডওয়ার্ড এর গল্পটি জাল নয় তার সবচেয়ে বড় প্রমান রয়্যাল সোসাইটি। রয়্যাল সোসাইটি এডওয়ার্ড মর্ড্রেক এর কবর খনন করে তার দেহের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবং তারা সেই মৃতদেহের কঙ্কালে দ্বিতীয় মুখের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন।
এডওয়ার্ড মর্ড্রেকের গল্পটি ছিল মানুষের বিকৃতির সাথে জড়িত সবচেয়ে বিষন্ন গল্পগুলির মধ্যে একটি। তিনি প্রায় সমস্ত সময় তার দ্বিমুখী অবস্থার কারণে সম্পূর্ণ নির্জনতায় কাটিয়েছেন এবং তার নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করার ক্ষেত্রেও এড়িয়ে গেছেন।
এই গ্রহে তার সংক্ষিপ্ত ২৩ বছরের জীবনেই তিনি প্রচন্ড মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতায় বিধ্বস্ত ছিলেন। তবে দিনশেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় তার মৃত্যুর দায় কার সেই দুষ্টু দ্বিতীয় স্বত্বার? নাকি সেই সমাজের যারা তাকে নিয়ে উপহাস করে বেড়াতো?