চ্যাং বাঙ্কার এবং ইং বাঙ্কার জন্মেছিলেন ১৮১১ সালে মেকলং, সিয়াম (জায়গাটির বর্তমানে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরের অংশ)।
তাদের বাবা ছিলেন জাতিগতভাবে একজন চীনা এবং পেশায় তিনি ছিলেন একজন জেলে। তাদের দুজন ছাড়াও তাদের পরিবারে আরো ৭ জন ভাইবোন ছিলো। তবে তারা সবাই ছিলো স্বাভাবিক। তাদের জন্মের সময় সেদেশের রাজা তখন তো বেজায় অখুশি- সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতে চাইছিলেন এমন অলক্ষণে শিশু দুটিকে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন Chang ও Eng।
চ্যাং ও ইং তার অন্য ভাইবোনদের সাথে নদীর পাশেই বেড়ে উঠেছেন। তারা তাদের ভাইবোনের সাথে তাদের বাবার নৌকা চালাতো, খেলতো কিংবা সাঁতার কাটতো।
কনজয়েন্ড টুইন কি?
একটি ভ্রূণ যখন আংশিক বিভাজনের মাধ্যমে দুটিতে রূপান্তরিত হতে যায়, কিন্তু তখনো শারীরিকভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে তখন এ অবস্থাকে বলা হয় Conjoined Twin। যদিও এমন ব্যতিক্রম ঘটনার সম্পূর্ণ সঠিক ব্যাখ্যা দিতে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
কনজয়েন্ড টুইনরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আগে বেশিরভাগ সময়ই গর্ভপাতের সময় মারা যেতো। তবে বতমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্য ও অস্ত্রোপচারের কৌশলের অগ্রগতির ফলে মৃত্যু হার নেই বললেও চলে এমনকি বর্তমানে সার্জারীর মাধ্যমে কনজয়েন্ড টুইনদের আলাদা করার সফল অপারেশন ও হয়েছে।
চ্যাং ও ইং এর প্রারম্ভিক জীবন
মেডিকেল রেকডিং নথির তথ্যমতে এই দুইভাই ছিলেন মেডিকেল ইতিহাসের প্রথম নথিভুক্ত কনজয়েন্ড টুইন। তারা দুজনেই পরিচিত ছিলেন সিয়ামের যমজ ভাই। এই নামটা তাদের শহরের নামেই করা হয়েছে।
চ্যাং এবং ইং দুজনেই কোমরে টিউবুলার ব্যান্ড নামক টিস্যুর কারনে একে অপরের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই টিস্যুর ফলে তাদের শারিরীক অবস্থা মুখোমুখি হতে পারে এমন সম্ভাবনা দেখে তাদের মা তারা বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের ব্যায়াম করার অভ্যাস করেন ফলে টিস্যু প্রসারিত হয় এবং তারা পাশাপাশি হাঁটতে পারার সক্ষমতা লাভ করে। তাদের দু-ভাইয়ের একমাত্র অঙ্গ ছিলো লিভার আর বাকি সব অঙ্গগুলো দুজনের আলাদা ছিলো।
তাদের বয়স যখন ৮ বছর তাদের বাবা কলেরায় মারা যান, ফলে এতো বড় পরিবারের খরচের যোগান দিতে দুই ভাই কোকো বিন তেল তৈরির কাজ শুরু করেন। কখনো হাঁস মুরগী পালন করতেন আর সেই হাঁসমুরগির ডিম হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতেন।
১৮২৪ সালে এই যমজ দুই ভাইয়ের বিশাল পরিবর্তন আসে, যকন তাদের রবার্ট হান্টার নামের একজন ব্রিটিশবণিকের সাথে দেখা হয়।
রবার্ট হান্টার তাদের প্রদর্শনীতে পারফর্ম করার জন্য পরামর্শ দেন এবং তারাও এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। আর তাই তিনি যমজ সন্তানের মা এবং সিয়ামের রাজার কাছ থেকে ছেলেদের সিয়াম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পান চান এবং তা পেয়ে ও যান। ১৮২৯ সালের এপ্রিল মাসে জাহাজে চড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছিলো ১৩৮ দিন। এই দীর্ঘ সময়ে পথের মধ্যেই তারা ইংরেজি ভাষা শিখে ফেলেন।
প্রদর্শনী
চ্যাং এবং ইং বোস্টনে পৌঁছানোর পর তারা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। যোগ দেয়ার পর প্রদর্শনীর পৃষ্ঠপোষকরা দুই ভাইকে একটি ভালো অংকের টাকা দিয়েছিল। দুই ভাই প্রদর্শনীতে প্রথমে দেখাতো তারা একে অপরের সাথে কিভাবে যুক্ত হয়ে আছে। পরবর্তীতে তারা প্রদর্শনীতে ব্যাডমিন্টন দাবার মতো কিছু খেলা খেলতো।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিষ্ময়
বোস্টন শহরে অবস্থান করাকালীন সময়ে দুই যমজ ভাই জোসেফ স্কি নামের একজন ভদ্রলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জোসেফ স্কি ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন ডাক্তার, সেসময় তিনি বোস্টন শহরে অবস্থান করছিলেন। তিনি চ্যাং এবং ইং দুজনের অনুমতি নিয়ে তাদের শরীরের পরীক্ষা করেন।
জোসেফ স্কি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তা নথিভুক্ত করেছেন যে,
তিনি রাতে যমজ ভাইদের ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তিনি দুই ভাইয়ের একজনকে স্পর্শ করলেন, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দুজনেই একসঙ্গে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অ্যানাটমি এবং সার্জারির অধ্যাপক জন ওয়ারেনও চ্যাং এবং ইংকে পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে যমজদের হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস সমানভাবে চলছে। তবে তাদের দুজনেরই আলাদা ও নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রের বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
চ্যাং এবং ইং ইউরোপ ভ্রমণ করেন, যেখানে তারা বিভিন্ন প্রদর্শনীতে পারফর্ম করেন। ইউরোপে তাদের আরও অনেক ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছিল যারা পরীক্ষা করেছেন তাদের সকলেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, যে তাদের সংযুক্ত টিস্যুটি প্রসারিত হওয়ার সময় কোনও ব্যথা অনুভব করেনি, তবে প্রতিটি যমজের অঙ্গ আলাদাভাবে কাজ করে।
যমজদের বিবাহ ও জীবন
দীর্ঘদিন প্রদর্শনীর হয়ে কাজ করার পর ১৮৩৯ সালে চ্যাং এবং ইং যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনার উইলকেসবোরোতে একটি খামার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। তারা খামার পরিচালনা করতে সাহায্য করার জন্য ক্রীতদাস ক্রয় করেছিল, যা সেই সময়ে সাধারণ বিষয় ছিল।
খামার কেনার পর তাদের ইয়েটস পরিবারের দুই বোনের সাথে দেখা হয়, তাদের পরিবার ও ছিলো কৃষক। চ্যাং এবং ইয়ং দুই ভাই সেই দুই বোনের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৮৪৩ সালের ১২ এপ্রিল অ্যাডিলেড ও সারাহ ইয়েটস নামের দুই বোনকেই বিবাহ করেন।
বিবাহের পর প্রথম দিকে দুই ভাই ও তাদের স্ত্রীরা একই বাড়ির একটি ৪ জনের বিছানায় ঘুমাতেন। তাদের দুজন স্ত্রী সন্তান জন্ম দিলে তারা সিদ্ধান্ত নেন তাদের এবার আলাদা বাড়ি থাকতে হবে। স্ত্রী ও সন্তানেরা আলদা বাড়িতে থাকতেন আর চ্যাং এবং ইং কে ৩ দিন এই বাড়ি তে ৩ দিন ঐ বাড়ি করে থাকতে হতো।
জানা গেছে যে চ্যাং এবং অ্যাডিলেড দম্পতির সন্তান ছিলো ১০ জন আর ইং এবং সারার ১১ টি সন্তান সন্তান ছিল। তবে তাদের জন্মানো কোনো সন্তানই কনজয়েন্ড টুইন বা যমজ ছিলেন না। খামার কেনার পরেও তারা মাঝেমধ্যেই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতেন এবং প্রায়শই তাদের স্ত্রী ও সতানদের সেই প্রদর্শনীতে নিয়ে যেতেন।
যুগের পরিবর্তন
১৮৬২ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং দাসপ্রথার মুক্তির ঘোষণা করা হয়। যেহেতু তাদের ফার্ম ক্রীতদাসদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো এবং সকল ক্রীতদাসেরা মুক্ত তাই দুই ভাইয়ের পক্ষে ফার্ম পরিচালনা করা ছিলো অসম্ভব ব্যপার। আর তাই অর্থের জন্য তারা আবার প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে শুরি করেছিলেন। তার মধ্যে অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও ছিলো।
প্রদর্শনীর জন্য তাদের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতে হতো। ভ্রমনের সময় তাদের সাথে বিভিন্ন ডাক্তারের পরিচয় হয়েছে এবং তারা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছেন। যখন দুই ভাইয়ের বয়স ৬০ এর কোটায় পৌছায় তখন তারা একজন মারা গেলেন আরেকজনের কি হবে এই ভয় পেতে শুরু করে। ডাক্তার রা চ্যাং এবং ইং দুই ভাইকেই বলেছিলেন যে তাদেরকে যদি সার্জারী করে আলদা করার চেষ্টা করা হয় তার পরিণাম হিসেবে দু’জনেরই মৃত্যু হতে পারে।
১৮৭৪ সালে সালের ১৭ জানুয়ারি চ্যাং এবং ইং দুজনেই মারা যান। এক জন মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান আরেক জন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে- দুই ভাইয়েরই প্রত্যেক অঙ্গই ছিল আলাদা আলাদা। দ্বিতীয় জন মৃত্যুর ভয়ে মারা যাননি বরং মারা গেছেন রক্তস্বল্পতায়। প্রথমজনের দেহে যে রক্ত প্রবেশ করেছিল সে মারা যাওয়ার পর ঐ রক্ত আর দ্বিতীয় জনের দেহে ফেরত আসেনি।