১৯৩০ এর দশকে ব্রিটেনের উঁচু দালানগুলোর জানালার বাহিরে খাঁচার ভেতরে শিশুদের ঢুকিয়ে রাখা সাধারণ একটি বিষয়। এই পদ্ধতিটি গত শতাব্দীর সবচেয়ে অদ্ভুত আবিষ্কার গুলোর একটি।
এটি আবিষ্কার করার মূল কারণ ছিল গত শতাব্দী শুরু থেকে ব্রিটেনে বহুতল ভবনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। অতিরিক্ত বহুতল ভবনে থাকা দম্পতিরা তাদের নবজাতক শিশুদের নিয়ে চিন্তিত ছিল। এর কারণ ভবনগুলোতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ করতো না, যা নবজাতকের জন্য খুব প্রয়োজনীয়।
এই খাঁচার মাধ্যমে মায়েরা তাদের নবজাত শিশুদের খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে বাহিরে ঝুলিয়ে রাখতো। এই ধরনের খাঁচা গুলো ‘The window crib’ নামে বেশি পরিচিত ছিল।
এই খাঁচা গুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যা শিশুদের জন্য হামাগুড়ি দেওয়া এবং তাজা বাতাস গ্রহণ করা সহজ করে তোলে। অনেক মা তাদের সন্তানদের বাইরে রাখার সুবিধাজনক উপায় হিসাবে এটির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। অনেক মহিলারা তাদের বাচ্চাদের জানালার বাইরে ঝুলিয়ে রাখত যাতে তারা গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ করতে পারে।
ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে এর অতিরিক্ত জনপ্রিয়তার কারণে সিটি কাউন্সিল এই ধরনের খাঁচা ব্যবহারের স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেসময় ‘দ্য চেলসি বেবি ক্লাব’ নামে একটি চিল্ড্রেন ডে কেয়ার নামক এই সংস্থা এই খাঁচা ব্যবহারের জন্য মানুষদের উৎসাহিত করেছিল। এর ব্যবহার বাড়াতে তারা খাঁচা বিতরণ ও করেছিল।
কিভাবে প্রচলন শুরু এই খাঁচা গুলোর?
আগেই বলেছি খাঁচা গুলোর প্রতি মায়েদের আগ্রহ হওয়ার কারণ ছিলো তারা বহুতল ভবনে থাকতো। আর পর্যাত আলো বাতাস পাওয়ার উদ্দেশ্যে এগুলোর ব্যবহার করতেন।
এছাড়াও, শিশুর যত্ন গ্রহণের জন্য দায়ী আরেকটি প্রধান কারণ হল এটি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল এবং শিশুদেরকে তাদের সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে বাইরের শিথিলকরণের জন্য কিছুটা সময় দিতো।
এছাড়া যেহেতু এপার্টমেন্ট গুলো ছোট ছিল, আর বাচ্চার জায়গা তৈরির জন্য ঘরের চলাচলে জায়গাও চোট হয়ে যেতো। অনেক বাবা মা সেই খাচায় পর্দা টেনে দিতেন। ফলে বাচ্চারা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তো।
শিশুদের খাঁচা ব্যবহারের সাথে আরও বেশ কিছু সুবিধাও যুক্ত ছিল। উদাহরণস্বরূপঃ ১৮৮৪ সালে, লুথার এমমেট হল্ট একটি বইয়ে লিখেছিলেন যা তাদের বাচ্চাদের সাথে নতুন মায়েদের সাহায্য করেছিল।
একটি চ্যাপ্টারের শিরোনাম ছিল ‘শিশুদের যত্ন এবং খাওয়ানো’। এই বইটি তখন ছোট বাচ্চাদের সাথে পিতামাতার জন্য একটি জনপ্রিয় গাইড হয়ে উঠেছে।
হোল্টের বইয়ের একটি অংশে উল্লেখ করেছেন এই প্রক্রিয়ার ফলে ছোট বাচ্চাদের নিয়মিত তাজা বাতাস পেতে দেওয়ার গুরুত্বের উপর জোর দেয়।
হল্ট তার বইয়ে আরও উল্লেখ করেছেন যেঃ-
“রক্ত পুনর্নবীকরণ এবং বিশুদ্ধ করার জন্য তাজা বাতাসের প্রয়োজন, এবং এটি সঠিক খাদ্যের মতোই স্বাস্থ্য এবং বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়।”
হল্টের এই লেখাগুলো লন্ডনের অনেক মাকে বিশ্বাস করতে পরিচালিত করেছিল যে তাদের বাচ্চাদের বাতাসের মাধ্যমে ঠান্ডা তাপমাত্রায় প্রকাশ করা রক্ত পরিশোধনে সহায়তা করে এবং তাদের অনাক্রম্যতা তৈরি করে।
এই খাঁচাগুলো আবিষ্কার করেছিলেন ‘এমা রিড’ নামে একজন মহিলা ১৯২২ সালে দেয়া তার এক বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেছেন,
“ সময় যতো বাড়ছে উঁচু বিল্ডিং গুলোর সংখ্যা ও বাড়ছে। আর বাসাগুলোর আকার ও ছোট হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু উঁচু বিল্ডিং গুলোতে বসবাস করা শিশুরা কোনো বাগান চোখে দেখতো না আর ঘরগুলেতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করতো না। আমার চিন্তা ছিলো কিভাবে তাদের পর্যাপ্ত আলো বাতাস নিশ্চিত করা যায়।”
এই খাঁচা গুলো কে তখনকার কোনো বাবা মাই খারাপ মনে করতো না। তাদের সকলেরই প্রতিক্রিয়া ছিল বাহিরে ঘুমানোর ফলে বাহিরের আলো বাতাসে তাদের শিশু আরো বেশি সুস্থ ও স্বাস্থবান হয়ে উঠছে।
কিভাবে খাঁচা ব্যবহার করা হয়?
শিশুর খাঁচাগুলো পোষা প্রাণীর খাচার মতো ছিল। খাঁচাগুলো তার দিয়ে তৈরি ছিল। আর সেগুলো জানালার ফ্রেমের বাহিরের অংশের সাথে সংযুক্ত ছিল।
নরম কাপড় বা ঝুড়ি সাধারণত জানালার ফ্রেমের বাইরে ঝুলিয়ে রাখার আগে শিশুর খাঁচায় রাখা হতো। যেখানে এই খাঁচাগুলি ছিল সেই সামান্য জায়গাটিকে আজ যেখানে জানালা-ভিত্তিক এয়ার কন্ডিশনারগুলি রাখা হয়েছে তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
মহিলা এবং তত্ত্বাবধায়করা তাদের বাচ্চাদেরকে সেই খাঁচায় রাখতো তখন যখন তারা গৃহস্থালি কাজে ব্যাস্ত থাকতো। অনেকে বাচ্চার হাতে খেলনা ও দিতেন।
লন্ডন শহরের অনেক বিল্ডিং এর মালিক তার বিল্ডিং এর এপার্টমেন্ট গুলোতে বাচ্চার খাঁচা রাখার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। যেনো মানুষরা তার বাসা ভাড়া নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়।
এই খাঁচার ব্যাপারে কারো অভিযোগ ছিলো না একেবারেই তা নয়।
১৯০৬ সালে, এলেনর রুজভেল্ট একটি খাঁচা কিনে এনে তার নিউইয়র্কের এপার্টমেন্টে তার কন্যা আনাকে রাখার জন্য। আনাকে সেই খাঁচায় রাখার ফলে সে চিৎকার করতো। আনার চিৎকারে প্রতিবেশীরা অভিযোগ করা শুরু করে। আনার মা সহ অনেক প্রতিবেশী তখন এই খাঁচার ব্যাপারে ভাবতে শুরু করেন। শোনা যায় তারা নাকি এই খাঁচার বিষয়ে একটি অভিযোগ ও জমা করেছিলেন Prevention of Cruelty Towards Children এর কাছে।
খাঁচা ব্যবহারের সমাপ্তি
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন শিশুর খাঁচা ব্যবহার ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। যদিও যুদ্ধের পরে এর জনপ্রিয়তা আবার বৃদ্ধি পায়, তবে ১৯৫০ এর দশকে এর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
আশ্চর্যজনকভাবে, শিশুর খাঁচা ব্যবহার করার ফলে আঘাতের কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। যদিও নিচ থেকে বা উপর থেকে দেখে খাঁচা গুলোকে ঝুকিপূর্ণ মনে হতো।
যাইহোক, আইনের বিকাশ হওয়ার সাথে সাথে, শিশু যত্ন এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। সময়ের সাথে সাথে যা অভিভাবকদের আরও সচেতন করে তোলে এবং তারা এই অভ্যাসটি বন্ধ করে দেয়।
নিরাপত্তার উদ্বেগের পাশাপাশি, বৈজ্ঞানিক বৈধতার অভাবও শিশুর খাঁচা ব্যবহারে ব্যাপক হ্রাস ঘটায়।
Featured Image Credit: Ranker