You are currently viewing সান্তা ক্লজ: সেইন্ট নিকোলাসের কিংবদন্তি থেকে আজকের জনপ্রিয় চরিত্র

সান্তা ক্লজ: সেইন্ট নিকোলাসের কিংবদন্তি থেকে আজকের জনপ্রিয় চরিত্র

হরিণের টানা গাড়িতে চড়ে উড়ে উড়ে শিশুদের উপহার দিচ্ছে লাল পোশাক, ও টুপি গায়ে লম্বা সাদা দাঁড়িওয়ালা এক বুড়ো নাম তার ‘সান্তা ক্লজ’। বড়দিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তিনিই। বিশেষত শিশুদেরকেই সান্তা বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু কেই এই সান্তা ক্লজ? কি তার পরিচয়? কিভাবে তিনি বড়দিনের বিশেষ অংশ হয়ে উঠেছেন?

বিশ্বব্যাপি আজ যিনি সান্তা ক্লজ নামে বহুল পরিচিত। তার আসল নাম সেইন্ট নিকোলাস। অতীতে তার উপস্থিতি সত্যি থাকলেও, বর্তমানে আমরা যে সান্তা ক্লজকে চিনি এই সান্তা ক্লজের চরিত্রটি ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাহিনীর সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে।

সান্টা ক্লজ অর্থাৎ সেইন্ট নিকোলাসের জন্ম ৩য় ও ৪র্থ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পাতারা শহরের (বর্তমানে তুরস্ক) এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি তার মা-বাবা কে হারিয়েছিলেন। মা-বাবার মৃত্যুর ফলে নিকোলাস সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়ে যান। আর সেই সব সকল সম্পত্তিই তিনি গরীবদের দান করার কাজে ব্যবহার করে ইতিহাসের পাতায় নিজেকে অমর চরিত্রে স্থান দিয়েছেন।

সেইন্ট নিকোলাস পেশায় ছিলেন একজন খ্রিস্টান বিশপ। তার সম্পর্কে কথিত আছে গির্জার পূর্ববর্তী বিশপের মৃত্যুর পর তিনি সকালে প্রার্থনার জন্য সর্বপ্রথম গির্জায় প্রবেশ করেছিলেন, ফলে অন্যান্য পুরোহিতরা তাকে বিশপ হিসেবে নির্বাচন করেন। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, নিকোলাস ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ডায়োক্লেশিয়ানের শাসনামলে বন্দি হয়েছেল। পরবর্তীতে রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইন দ্য গ্রেটের আমলে মুক্তি পান। অনুমান করা হয় যে নিকোলাস ৩৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ৭৩ বছর বয়সে মারা যান।

সেইন্ট নিকোলাসের সান্তা ক্লজ নামে পরিচিত হওয়ার পেছনে রয়েছে উচ্চারণের বিবর্তন। সেইন্ট নিকোলাস কে ডাচ ভাষাভাষীরা উচ্চারণ করতো ‘সিন্টারক্লাস’ নামে। ১৭৭৩ ও ১৭৭৪ সালে পরপর দু’বার আমেরিকার একটি পত্রিকায় সামনে আসে অভিবাসী এক ডাচ পরিবারের সেন্ট নিকোলাসের মৃত্যুবার্ষিকী উৎযাপনের খবর। ঐ অভিবাসী ডাচ পরিবার সেইন্ট নিকোলাস কে ডাকতেন ‘সিন্টার ক্লাস’ নামে। ক্রমে ক্রমে সময়ের সাথে সাথে তা মানুষের মুখে ‘সান্তা ক্লজ’ নামে জনপ্রিয় হতে থাকে। তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সান্তা ক্লজ ভিন্ন ভিন্ন নামেও পরিচিত যেমন ইংল্যান্ডে তিনি “ফাদার ক্রিসমাস” ফ্রান্সে “পেরে নোয়েল” জার্মানিতে “ক্রিস্টকাইন্ড”।

সেইন্ট নিকোলাস তার সারাজীবন খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার ও মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করে সন্ন্যাসী জীবন কাটিয়েছেন। সেইন্ট নিকোলাসের ধর্ম প্রেম নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে যে একবার আরিয়াস নামক এক ধর্মত্যগী লোককে নিকোলাস থাপ্পড় মেরেছিলেন। 

আরিয়াসের বক্তব্য ছিলো,

“যীশু কোনো অবতার নন, তিনি আমাদের মতোই সাধারণ জীব।”

সান্তা ক্লজ সম্পর্কে প্রচলিত অলৌকিক গল্প 

সান্তা ক্লজ বা সেইন্ট নিকোলাস সম্পর্কে বেশ কিছু অলৌকিক গল্প প্রচলিত আছে। তারমধ্যে অন্যতম একটি গল্প হচ্ছে সান্তা ক্লজ একবার তিনজন ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। 

তখন দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিলো, তিনটি ছোট ছেলে পথ হারিয়ে এক কসাইয়ের দোকানের সামনে চলে আসে। কসাই তখন তাদের তিনজনকে খাওয়ানোর জন্য ডাকে। কিন্তু কসাইয়ের মনে ছিল  ভয়ানক এক পরিকল্পনা। কসাই খাবার খাওয়ানোর পর তিনটি শিশুকেই হত্যা করে। এরপর তাদের দেহকে টুকরো টুকরো করে মাংসের ড্রামে লুকিয়ে রাখে। কসাইয়ের উদ্দেশ্য ছিলো মাংসগুলো লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে তা বিক্রি করা। সেই সময় সেইন্ট নিকোলাস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। কসাইকে তার অপকর্মের কথা ফাঁস করেন, তারপর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলে সেই ড্রাম থেকে তিন ছেলে শিশুই জীবন্ত অবস্থায় বাহিরে বেরিয়ে আসে।

Image Source: The National Galleries of Scotland

সান্তা ক্লজকে নিয়ে আরো একটি গল্প প্রচলিত আছে। একটি অতিরিক্ত গম বোঝাই জাহাজ মাইরা শহরের বন্দরে অবস্থান করছিল। সেইন্ট নিকোলাস তখন সেই গমের কিছু অংশ শহরের মানুষদের জন্য রেখে যেতে বলেছিলেন। নাবিকরা নিকোলাসের কথা শুনে দ্বিধা করলে তিনি তাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, তারা তাদের গমের নগদ দাম পাবে। নিকোলাসের শহরের মানুষকে গম দিয়েও বাকি গম নিয়ে নাবিকরা জাহাজ নিয়ে চলে গেলে তারা দেখতে পায় সম্রাটের জন্য তারা যে পরিমাণ গম প্রথমে আনতে চেয়েছিলো, ঠিক সেই পরিমাণই আছে। গমের পরিমাণ একটুও কমেনি।

সেইন্ট নিকোলাস যেভাবে সান্তা ক্লজ হয়ে উঠলেন 

সেইন্ট নিকোলাসের সম্বন্ধে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত থাকলেও তিনি সান্তা ক্লজ নামে পরিচিতি পেয়েছে অন্য একটি ঘটনার কারনে। এই ঘটনার কথা পাওয়া যায় ৮ম শতকের লেখক মাইকেল দ্য আর্কিম্যান্ড্রাইটের লেখা বই Life of Saint Nicholas থেকে। ধারণা করা হয় এই গল্প হয়তো তিনি অন্য কোনো উৎস হতে সংগ্রহ করেছিলেন।

গল্পটি অনেকটা এরকম, সেইন্ট নিকোলাসের মাইরা শহরের এক দরিদ্র পিতার তিন কণ্যা সন্তান ছিলো। কিন্তু সেই দরিদ্র বাবার তার তিন কণ্যাকে বিয়ের সময় বর কে যৌতুক দেবার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিলো না। সেইন্ট নিকোলাস তখন মাইরা শহরের বিশিষ্ট বিশপ ছিলেন। এই গরীর বাবার দুঃখের কথা তার কানে পৌঁছালে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাদেরকে সাহায্য করবেন।

Image Source: The National Galleries of Scotland

সেইন্ট নিকোলাস এক রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে তিনটি স্বর্ণের মুদ্রার থলি নিয়ে ওই পরিবারের বাড়িতে ঢুকে পড়েন এবং মেয়েদের বিছানার বালিশের কাছে  গোপনে রেখে যান। এই স্বর্ণের মুদ্রাগুলি দেখে দরিদ্র বাবা ভীষণ অবাক হন। অর্থ পেয়ে গরীব বাবার তিন মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায়। এই কাহিনীর কারণেই ক্রিসমাসে শিশুদের জন্য মোজার মধ্যে খেলনা ও চকলেট মুদ্রা রাখার প্রচলন শুরু হয়।

সেইন্ট নিকোলাসের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে এই গল্পগুলো পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, সেই সাথে তিনি বড়দিনেরও অংশ হয়ে উঠেন। কসাইদের থেকে শিশুদের জীবন বাচানো গরীবদের সাহায্য করার এই গল্পগুলোর কারনে, পরবর্তীতে সেইন্ট নিকোলাস শিশু ও গরীবদের ত্রাণকর্তা হয়ে উঠেন। 

Leave a Reply