ছোটবেলায় কেউ হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প পড়েন নি বা শুনে নেই এমন মানুষ একেবারেই পাওয়া যাবে না। গল্পের কাহিনী ছিল এমন:
জার্মানির হ্যামিলন শহরে ইঁদুরের আক্রমণ এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল য়ে তা একপ্রকার মহামারি আকার ধারন করেছিল। আর সেই সময়ে সেই শহরে হাজির হয় হরেক রঙের পোশাক গায়ের এক বাঁশিওয়ালা। শহরের মেয়র তাকে প্রস্তাব দেয় যদি সে শহর থেকে সকল ইঁদুর তাড়াতে পারে তাহলে তাকে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে।
বাঁশিওয়ালা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় এবং বাঁশি বাজিয়ে তার সাথে করে শহরের সব ইঁদুরকে সাথে নিয়ে শহরের পাশে থাকা ওয়েসার নদীর জলে ফেলে দিয়ে সকল ইঁদুরকে মেরে ফেলে। বাঁশিওয়ালা তার কাজ শেষ করে পারিশ্রমিক চাইলে তাকে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে মাত্র ৫০ স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হয়।
এই ঘটনায় বাঁশিওয়ালা মনে মনে অনেক ক্রুদ্ধ হয়ে শহর থেকে চলে যায়। সেই সাথে সেই বাঁশিওয়ালা স্থির করে ফেলেন তিনি এর প্রতিশোধ নেবেন। এই ঘটনার কিছুদিন পর ১২৮৪ সালের জুন মাসে শহরের এক উৎসবের দিন সেই বাঁশিওয়ালা হ্যামিলনে ফিরে আসেন। তবে এবার জিপসিদের মতো হরেক রঙের কাপড় পড়ে আসেন নি। তিনি এবার সবুজ রঙের এক পোশাক পড়ে হাজির হয়েছিলেন। বাঁশিওয়ালা তার বাঁশি বাজানো শুরু করলে শহরের সকল শিশুরা সম্মোহিত হয়ে তার সঙ্গে চলতে শুরু করে। পথ চলতে চলতে শহর ছেড়ে তারা বহুদূর চলে যায়। এইসব শিশুরা আর কখনো শহরে ফিরে আসেনি। আর শহরের কেউ সেই বাঁশিওয়ালাকেও আর কখনো দেখেনি।
এই ঘটবার পর শিশুদের স্মরণে হ্যামিলন শহরের চার্চের দেয়ালে শিশুদের নিয়ে সেই ঘটনা ও ছবি আঁকা হয়। তারপর থেকে মানুষের মুখে মুখে রটতে থাকে সেই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন রকম গুজব ও মুখরোচক সব গল্প। তেমনই প্রচলিত কিছু কিছু তত্ত্ব সম্পর্কে জানাচ্ছি।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা শিশু বলাৎকার করতো
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা কে নিয়ে গুজব ছিলো সে শিশু বলাৎকার করতো। সে বাঁশি দিয়ে মোটেও ইঁদুর ধরতো না। সে বাঁশি বাজিয়ে শিশুদের আকৃষ্ট করতো তারপর সেইসব শিয়ুদের সাথে তার বিকৃত যৌনকর্ম সম্পন্ন করতো। সে কম করে ১০০ জনের অধিক শিশুর বলাৎকার করেছে। সে যৌনকর্ম শেষ করে শিশুদের হত্যা করতো। তারপর সেইসব শিশুদপর মৃতদেহগুলো জঙ্গলের গাছে ঝুলিয়ে রাখতো।
আমেরিকান ইতিহাসবিদ তার A World Lit By Fire নামক বইতে সেই বাঁশিওয়ালাকে বর্ণনা করেছেন ‘সাইকোপ্যাথ এবং পেডেরাস্ট’।
শিশুদের ক্রুশেড যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল
মধ্যযুগে মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে গল্প চাউর হতে থাকে যে সে সেইসব শিশুদের সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল খ্রিস্টানের পবিত্র ধর্মযুদ্ধ ক্রুসেডে অংশগ্রহণ নেওয়ার জন্য। জার্মানিতে প্রচলিত একটি লোকগল্প আছে যে ১২১২ সালে নিকোলাস নামের এক বালক ক্রুসেড যুদ্ধ দেখা ও যোগ দেওয়ার জন্য তার সাথে করে শিশুদের একটি বড় দলকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিশুদের সেই দলটি বেশিরভাগই পথেই মারা যায় আর বাকিরা পথ ভুলে বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়, তাদের আর কখনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
এই গল্পের সঙ্গে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সেই গল্পকে জুড়ে নতুন এক গল্পের সৃষ্টি হয়। নিকোলাসই সেই বাঁশিওয়ালা যে তার সাথে করে শহরের সব শিশুকে নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু গল্পের সাথে সময় ও তথ্যের সাথে কোনো মিল বা প্রমাণ কিছুই পাওয়া যায় না।
সে ছিল মৃত্যুর প্রতীক
একটি তত্ত্ব দাবি করে যে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বলে প্রকৃতপক্ষে ছিলো না। তবে সে একটি প্রতিক যে মৃত্যুকে প্রতিনিধিত্ব করে। এটা যতটানা বাস্তব তার চাইতে অধিক কল্পনা। এই থিওরিটি ইঙ্গিত করে যে শিশুরা প্রাকৃতিক কারনে মারা গিয়েছিল। আর শহরের মানুষরা সেই মৃত্যুকে ট্রাজেডিতে রূপ দিতে এমন গল্পের সৃষ্টি করেছিল।
এছাড়াও কেউ কেউ ধারণা করেন সেইসব শিশুরা অনাহারে মারা গিয়েছিলো। কারণ সেই সময়টায় অনাহারে, দূর্ভিক্ষে মানুষের মৃত্যু ছিলো অতি সাধারণ একটি ব্যাপার। অনেকে আবার বুবোনিক প্লেগের দিকে ইঙ্গিত করেন। কারন ইঁদুরের মাধ্যমেই ইউরোপে প্লেগ মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু বুবোনিক প্লেগ ইউরোপে এসেছিলো এই ঘটনার আরো প্রায় ৫০ বছর পরে। তাছাড়া একদিনে অনাহারে বা মহামারিতে শহরের সকল শিশুর মৃত্যু একপ্রকার অসম্ভব একটি ব্যপার।
বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে বাঁশিওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল
এই তত্ত্বটি অন্য সবগুলো থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য। মনে করা হয় যে শহরের শিশুদের বাবা মায়েরা একজন লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। আর সেই লোকই গল্পে গল্পে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালায় পরিণত হয়েছেন।
১৩ শতকে জার্মানির সাধারণ মানুষজন ছিলো অতি দরিদ্র। তাছাড়া জনসংখ্যাও ছিলো অনেক বেশি। আর সে সময়ে জার্মানিতে পরিবারের বড় ছেলেই উত্তরাধিকারসূত্রে পরিবারের সকল সম্পত্তি পেতো। আর বাকি সন্তানদের বড় ছেলের ক্রীতদাস হয়ে জীবন কাটাতে হতো।এই তত্ত্ব অনুসারে, হ্যামেলিনের বাচ্চাদের পূর্ব ইউরোপের বাল্টিক অঞ্চলের একজন দাস ব্যাবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়েছিল।
সেই সময়ে শিশুদের ক্রয় বিক্রয় অতি সাধারণ একটি বিষয় ছিলো। বিশেষ করে শহরের দরিদ্র, এতিম ও অবৈধ শিশুদের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার এটি ছিলো অন্যতম সেরা একটি উপায়। এই তত্ত্বের সাথে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পের সময় ও পরিস্থিতি দুটোই মিলে যায়।
হতে পারে ১২৮৪ সালের ২৬ জুন তারা তাদের বাচ্চাদের ক্রীতদাস হিসবে বিক্রি করে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে তারা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে অনুতাপ করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে সেই ঘটনাকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পে রূপ দিয়ে চার্চের দেয়ালে ছবি ও ঘটনা লিখে রাখে। সেখানে দাস ব্যবসায়ী সেই লোককেই মনে করা হয় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
দেশান্তরিত হয়েছিল
বেশ কিছু ঐতিহাসিক এই তত্ত্বের সাথে কিছুটা সহমত পোষণ করে। মনে করা হয়ে যে হ্যামিলনের সন্তানরা বিশেষ করে যুবকরা পূর্ব ইউরোপে স্থানান্তরিত হয়েছিল, বিশেষ করে পোল্যান্ড ও ট্রান্সিলভেনিয়া (বর্তমানের রোমানিয়া) চলে গিয়েছিল উপনিবেশ স্থাপন করতে।
হ্যামিলনের সন্তানরা দেশান্তরিত হওয়ায় হ্যামিলন শহরের জনসংখ্যা কমে এসেছিলো। চলে যাওয়া যুবকদের জন্য শহরের মানুষজন ও তার বাবা মায়েরা তাদের শোকে চার্চের দেয়ালে এইসব ছবি এঁকে তাদের স্বরণ রাখার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু এখানেও একটি কিন্তু থেকে যায়! যুবক বয়সের ছেলে মেয়েরা দেশ ত্যাগ করলে কেনো চার্চের দেয়ালের ছবিতে তাদের শিশু হিসবে তুলে ধরা হয়েছে? আর এখানে বাঁশিওয়ালাই বা আসছে কোথা থেকে?
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ডান্সিং ম্যানিয়ার নেতা ছিলেন
আরো একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব ছিলো যে বাচ্চারা নিজেদের মৃত্যুর জন্য নাচছিলো আর তাদের নাচের লিচার ছিলো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
“ড্যান্সিং ম্যানিয়া” ছিল একটি অতি অদ্ভুত ঘটনা যা ইউরোপে বেশ কয়েকবার ঘটেছে, বিশেষ করে জার্মানিতে সেইই সময়কালে। একদল লোকজন অনিচ্ছাকৃতভাবে নাচতে শুরু করতো। এবং একেবারে অসুস্থ না হওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েকদিন পর্যন্ত উম্মাদের মতো নাচতে থাকতো। ইতিহাসবিদরা এখনো সন্দিহান যে গণ হিস্টিরিয়া কি আদৌও কোনো অজানা ভাইরাস ছিল না অন্যকিছু?
হ্যামিলনের বাঁশিয়ালার সাথে দীর্ঘ নাচের ফলে সকল শিশুরা নাচার ফলে ভূমিধস হয়েছিলো। আরো বলা হয় যে তারা মোসেল নদীর সেতুর উপর জোরে জোরে নাচছিলো তারপর সেতুটি ছিঁড়ে নদীর জলে পরে যায় আর সকল শিশুরাও সেখানে নদীর জলে ডুবে মারা যায়। সেই দলে শিশুর সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০০ জন। এদের কারোরই খোঁজ পাওয়া যায় নি।
এই তত্ত্বের ভিত্তি কিছুটা শক্ত হলেও বাঁশিওয়ালা ও শিশুদের জলে ডুবে মরার শক্ত কোনো প্রমাণ নেই। পুরো তত্ত্বটিই অনুমান নির্ভর।