১৬৮০ এর দশকের কথা ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের মধ্যে কানাঘুষো হতে থাকে একজন রহস্যময় বন্দী সম্পর্কে। ফ্রান্সের রাজা লুই চতুর্দশের আদেশে একজন বেনামী লোককে আটক করে বাস্তিল দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়েছে। লোকটির আসল পরিচয় কেউ জানে না; কারণ লোকটির মুখ ছিলো লোহার মুখোশে বন্দী। তাকে নাকি জোর জবরদস্তি করেই সেই লোহার মুখোশ পড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
১৬৮৭ সালের একটি গ্যাজেটে একজন প্রাক্তন মাস্কেটিয়ার (মাস্কেটিয়ার্স হচ্ছে রাজার নিরাপত্তার জন্য তৈরি এক বিশেষভাবে বাহিনী, আর সেই বাহিনীর সদস্যদের বলা হয় মাস্কেটিয়ার) বেনিগনি দে সেন্ট-মার্সের হেফাজতে বন্দীর স্থানান্তরের কথা উল্লেখ করেন। বন্দীদের দক্ষিণ ফ্রান্সের কানের উপকূলে একটি ক্ষুদ্র ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ সেন্ট-মার্গেরিট দুর্গে স্থানান্তর করা হয়। রক্ষী এবং তার বন্দী উভয়েই পূর্বে আল্পসের পিগনেরল নামক এক নির্বাসিত দুর্গে বাস করত।
১৬৯৮ সালে এই বন্দী ও তার সাথে থাকা রক্ষীরা সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে প্যারিসের বাস্তিল দুর্গে যায়। সে সময়ও বাস্তিল দুর্গের কারাগারের গভর্নর ছিলেন স্যান্ট মার্স।
এই রহস্যময় বন্দী সম্পর্কে আগে যেসব কথা কানাঘুষো শোনা যেতো তার তখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাস্তিল দুর্গের এক কর্মকর্তা নতুন এই বন্দী ও তার রক্ষী মাস্কেটিয়ার্সের আগমনের বিস্ময়ের স্মৃতি তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন,
লোকটিকে সর্বদা দুজন মাস্কেটিয়ার্স পাহারা দিতো। লোকটির মুখ ছিলো সর্বদা লোহার মুখোশে ঢাকা; দুর্গে তার নামও কখনো উচ্চারিত হয়না।
১৭০৩ সালে রহস্যময় সেই বন্দী লোকটি বাস্তিল দুর্গে মারা যায়। তার মৃত্যুর রেকর্ডে লেখা হয়েছিল, ১৬৫০ এর দশকের একজন লোককে প্যারিসের সেইন্ট পল কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। মৃত্যুর পর ভোরবেলায় তার জিনিসপত্র ও জামাকাপড় সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যে কক্ষে বন্দী আটক ছিলো সেই কক্ষ টিকেও ধুঁয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। দেখা কোনো লেখা থাকলেও সেগুলোও যত্নসহকারে মুছে ফেলা হয়।
নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি
উপরের তৈলচিত্রটি পিগনেরল দুর্গের (বর্তমানে আধুনিক ইতালিতে অবস্থিত)। ১৬৩০ সালে ফ্রান্স এটি দখল করে নিয়েছিলো। রাজা লুই চতুদর্শের শাসনামলে এই দুর্গে বেশ কিছু রাজনৈতিক বন্দীদের আটকে রাখা হয়েছিল।
যারাই লুইকে অসন্তুষ্ট করতো, রাজা লুই চতুর্দশ তাদেরকে এই পিগনেরল দুর্গে পাঠিয়ে দিতেন বন্দী হিসেবে। সেখানে তাদের জীবন ছিল অবিরাম এক অন্ধকার। সেই দুর্গের গভর্নর বেনিগনে দে সেন্ট-মার্স ও উপর মহলের কিছু শক্তিশালী মানুষদের এই দুর্গে আরোপ করা আইন ছিলো দুর্গের বন্দীদের জন্য জীবন্ত মৃত্যুর মতো। সেখানে কোনো দর্শনার্থী অন্য বন্দীদের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারতো না। ছিলো না কোনো বই কিংবা ব্যায়াম কিংবা সময় কাটাবার মতো ব্যবস্থা।
কন্সপিরেসি থিওরি / ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
রহস্যময় এই বন্দী পুরোটা সময়ই বন্দী ছিলেন রাজা লুই চতুর্দশের শাসনামলে। লুই তার সমর্থকদের কাছে ছিলেন, লে রোই সোলেইল বা সূর্যের রাজা। রাজা লুইয়ের শাসনামলে ফ্রান্স তার রাজ্যের সীমানা দীর্ঘ করেছিলো সেই সাথে আরো অধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। আর নিন্দাকারীদের কাছে তিনি ছিলেন একজন অত্যাচারী রাজা এবং বিভ্রমে থাকা এক শাসক যিনি নিজেকে সূর্য রাজা বলে পরিচয় দেন এবং নিজেকে বলেন তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ফ্রান্স শাসন করছেন। অর্থাৎ নিন্দুকদের মতে তিনি ফ্রান্সকে একটি পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন।
রাজার মৃত্যুর পর রহস্যময় সেই বন্দীর ঘটনাটি আরো ডালপালা মেলতে শুরু করে। গুঞ্জন শুরু হয় যে রহস্যময় সেই বন্দীর সঙ্গে রাজার সরাসরি শত্রুতা ছিলো। রাজার মৃত্যুর আগে থেকেই এই বন্দীকে নিয়ে বেশ কিছু লোভনীয় গল্প চালু ছিলো আর সেগুলো মূলত লুইয়ের বিরোধীরা প্রচার করেছিলো লুইকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য।
লুইয়ের সময় লুই তার সাম্রাজ্যেকে আরো বড়ো করছিলেন। আর ফ্রান্স ও লুইয়ের আগ্রাসন থেকে ডাচরা নিজেদের বাঁচাতে ফরাসি ও ডাচদের মধ্যে চলা নয় বছরের যুদ্ধের (নাইন ইয়ারস ওয়ার ১৬৮৮-১৬৯৭) সময় রাজা লুই সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে দেয়। গুজবটি ছিলো যে যে রাজা লোহার মুখোশ পড়া যে ব্যক্তিকে বন্দী করে রেখেছেন তিনি আসলে রাজা লুইয়ের অবৈধ পিতা। লুইয়ের মা রাণী অ্যান অব অস্ট্রিয়ার সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো আর সেই সম্পর্কে লুইয়ের জন্ম হয়। আর এটা সত্যি প্রমাণ করতে পারলে রাজা লুই অবৈধ রাজা প্রমাণিত হবেন এবং সিংহাসন ছাড়তেও বাধ্য হবেন।
রহস্যময় সেই লোকটির পরিচয় ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদেরই কয়েকজনের মধ্যে একজন বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। জল্পনা কল্পনা ছিল বন্দী লোকটি হয়তো রাজার পুত্র লুই ডি বোরবন, কাউন্ট অফ ভার্মান্ডোইস, কিংবা রাজারই অন্য কোনো পুত্র অথবা রাজার উপপত্নী লুইস দে লা ভ্যালিয়ের।
রাজা লুই এর পুত্র লুই ডি বোরবন ছিলেন সমকামী। এটা প্রমাণ হওয়ার পর রাজপ্রাসাদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। আর তাই নিজের বাবার অনুগ্রহ পেতে তিনি রাজা লুইয়ের হয়ে ফ্ল্যান্ডার্সে (বতমানে বেলজিয়ামের অংশ) প্রচারাভিযানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান। ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা অনুমান করেন যে তিনি আসলে বেঁচে ছিলেন এবং গোপনে তার পিতার দ্বারা বন্দী হয়েছিলেন, আর তিনিই সেই লোহার মুখোশে বন্দী সেই রহস্যময় ব্যক্তি।
দীর্ঘ গল্প
লোহার মুখোশধারী ব্যক্তির আরো একজন সন্দেহবাজন ব্যক্তি ছিলেন ফ্রাঙ্কোইস ডি বোরবন, ডিউক অফ বিউফোর্ট। তিনি ছিলেন রাজার এক চাচাতো ভাই। ফ্রাঁসোয়া ফ্রন্ডের নেতাদের একজন ছিলেন, যে দলটি লুইয়ের রাজত্বের প্রথম দিকে রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং জনগণ ও রাজকর্মচারীদের রাজার বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছিলো। যদিও ফ্রাঁসোয়া পরে এক যুদ্ধে মারা যান, কিন্তু পরচর্চাকারীরা রাজার দ্বারা তার অপহরণ এবং কারাবাসের (অসম্ভাব্য) গল্প ছড়িয়ে দেয়।
১৮ শতকে এসে বন্দীর সেই পরিচয়ের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে। কেউ কেউ বলেছিলেন যে লোহার মুখোশের লোকটি রাণী অ্যান অব অস্ট্রিয়ার (লুইয়ের মা) জারজ ছেলে এবং রাজার সৎ ভাই। কারো কারো মতে মুখোশধারী লোকটি ছিলেন লুইয়ের স্ত্রী মেরি থেরেস অব অস্ট্রিয়ার প্রেমিক এবং রাণীর অনুমতিতেই তিনি রাণীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে রাণীকে গর্ভবতী করেছেন।
গুজব হয়ে উঠে শিল্প
অনেক ফরাসি মুক্তচিন্তকদের মতে মুখোশধারী ব্যক্তিটি ছিলো নিপীড়ন এবং অত্যাচারের একটি শক্তিশালী প্রতীক ছিল, যা সূর্যের রাজার সবচেয়ে খারাপ পাপের মূর্ত প্রতীক।এই চিন্তকদের মতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ভলতেয়ার। তিনিই সর্বপ্রথম সেই রহস্যময় বন্দীকে রাজা লুই চতুর্দশের যমজ ভাই বলে পরিচয় দেন। এর আগের বর্ণনাগুলোয় বলা হয়েছিল মুখোশটি মখমলের কাপড়ের; ভলতেয়ারই প্রথম বলেন মুখোশটি ছিলো লোহার এবং এর চিবুকটি ছিলো স্টিলের স্প্রিংস দিয়ে তৈরি, যা দিয়ে সে খাবার খেতো।
ভলতেয়ারকে ১৭১৭ সালে বাস্তিল দুর্গে বন্দী করা হয়েছিলো। তিনি বলেন যে বন্দী হওয়ার পর তার সাথে দুর্গের পুরণো কয়েদিদের সাথে কথা হয়েছিলো তারা তাকে বলেছিল।
একজন অজানা বন্দী, তার উচ্চতা ছিল লম্বা, অল্পবয়সী, একই সাথে খুবই সুন্দর এবং ব্যক্তিত্ব ছিল মহৎ। তিনি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন, তার আচরণ পরিমার্জিত ছিল এবং তিনি গিটার বাজাতেন। তাকে ভালো খাবার পরিবেশন করা হতো, অন্য বন্দীদের সাথে কোনও যোগাযোগ যেনো না হয় তার জন্য তাকে সবার থেকে দূরে রাখা হয়েছিলো এবং শুধুমাত্র দুর্গের গভর্নর তার সাথে দেখা করতে পারতেন।
ভেলভেট মুখোশ
অনেক ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন যে রহস্যময় বন্দী আসলে লোহার মুখোশ পরেননি। তিনি মখমলের একটি মুখোশ পরতেন, যেমনটি ১৬ এবং ১৭ শতকের ইউরোপীয় মহিলাদের জন্য ফ্যাশনেবল ছিল। স্টাইলিশ মহিলারা এগুলি কেবল আনুষাঙ্গিক হিসাবেই নয়, তাদের ত্বককে সূর্য থেকে রক্ষা করার জন্যও পরতেন। ইতিহাস বিষয়ক পণ্ডিতরা আরও মনে করেন যে তিনি এটি সব সময় পরতেনন না, শুধুমাত্র কারাগারের মধ্যে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় তার পরিচয় গোপন রাখার জন্য এটি পড়ানো হতো।
ইতিহাস থেকে ঐতিহাসিক সাহিত্য
ফরাসি ঔপন্যাসিক আলেকজান্ডার ডুমা ভলতেয়ারের কাহিনীকেই বেশি গ্রহনযোগ্য মনে করেছিলেন। এই ঘটনাকে তিনি ‘দ্য ভিকোমে অফ ব্রাজেলন’ নামে (১৮৪৭ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত) করেন ইংরেজিতে যার নাম দ্য ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক। আর এই দীর্ঘ উপন্যাস দিয়ে দুমা তার বিখ্যাত ও অতিদীর্ঘ থ্রি মাস্কেটিয়ার্স সিরিজের ইতি টানেন।
লোহার মুখোশ নিয়ে দুমার এই তত্ত্বটির সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। মুখোশের আড়ালের ব্যক্তিটি লুই চতুর্দশেরই আরেক যমজ ভাই ফিলিপ। নিজের সিংহাসন কে দীর্ঘস্থায়ী করতে নিজেরই আপন ছোট যমজ ভাইকে তিনি বন্দি করেন। আর উপন্যাস কে কেন্দ্র করে হলিউড তৈরি করেছে বেশ কিছু মুভি ও সিরিজ।
সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসবিদরা একটি থিওরি দাড় করিয়েছেন। মাস্ক পরিহিত ব্যক্তিটি হয়তো সেসময়কার দুর্নীতিগ্রস্থ শক্তিশালী অর্থমন্ত্রী নিকোলা ফুকে। দুর্নীতি ও রাষ্টদ্রোহিতার দায়ে যাকে রাজা গ্রেফতার করে পিগনেরল দুর্গে বন্দী করা হয়েছিল, সেই একই স্থানে যেখানে সেন্ট-মার্স প্রথম রহস্যময় মুখোশধারী বন্দিকে পাহারা দিয়েছিল। নিকোলা ফুকে সেখানে ১৬৮০ সালেই মারা যান; তিনি কখনো যে বাস্তিল দুর্গে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন সেটারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। নিকোলা ফুকেই যে সেই মাস্ক পরিহিত ব্যক্তি তা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা যায় না।
অনেক ইতিহাসবিদদের মতে মুখোশধারী ব্যক্তিটি হয়তো ইউস্টাচ ডগার। যিনি ১৬৬৯ সালে একটি অজানা অপরাধের জন্য গ্রেফতার করে পিগনেরল দুর্গে বন্দী করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে ডগার ছিলেন নিকোলা ফুকের খাস চামচা। আর সেখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি হয়তো কোনো স্পর্শকাতর খবর জেনে ফেলেছিলেন।
ঐতিহাসিকবিদারা মনে করে এই লোহার মাস্ক পড়ানো ও বন্দী ব্যক্তির বিষয়টা অতিরঞ্জিত। মুখেশটি মোটেও লোহার ছিলো না, সেটি কালো মখমলের মুখোশ ছিলো যেটি চুধু বন্দীদের স্থানান্তর করার সময় ব্যবহার করা হতো। যেহেতু সে সময় ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিলো উত্তেজনাপূর্ন তাই এই উত্তেজক পরিবেশের সাথে এই ঘটনা মিলেমিশে আজকের ফ্রান্সের এক আকর্ষণীয় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ব্রিটনিকা এনসাক্লোপিডিয়া, হিস্ট্রি. কম