মৃত্যুদন্ড হলো গুরুতর অপরাধের জন্য কোনো ব্যাক্তিকে প্রমাণ সাপেক্ষে বিচারের মাধ্যমে আদালত বা রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত একটি অনুমোদিত আইনি দণ্ডের একটি রূপ। এরপর দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিক মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
মৃত্যুদন্ড পৃথিবীর প্রাচীন প্রথা গুলোর মধ্যে একটি। বর্তমানে প্রায় ৫৮ টি দেশে গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়ে থাকে। বেশিদিন আগের কথা নয়, কিছুকাল আগে ইউরোপে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড প্রচলিত আইন ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তারা এসব থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে।
বর্তমানে মৃত্যুদন্ডাদেশ হিসেবে সাধারণত ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আরব দেশগুলোতে অবশ্য শিরশ্ছেদ প্রথার কথা প্রায়ই শোনা যায়।
তবে আজ কথা বলবো মৃত্যুদন্ডের ইতিহাস নিয়ে, কিভাবে মৃত্যুদন্ড প্রথা চালু হলো আর সেই মৃত্যুদন্ডের মাধ্যম কিভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে এসেছে তা নিয়ে।
মৃত্যুদণ্ডের উৎপত্তি
মৃত্যুদন্ডের প্রথম লিপিবদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের প্রথমার্ধে ব্যবিলনের রাজা হাম্বুরাবির কোডে।
হাম্বুরাবির কোড বা আইনের ভিত্তি ছিল ‘ চোখের বদলে চোখ’। অর্থাৎ কেউ খুন করলে তার শাস্তি হিসেবে সেও খুন হতো। কেউ কারো হাত ভাঙ্গলে তাকেও হাত ভেঙে দেওয়া হতো।
হাম্বুরাবি কোডে প্রায় ২৮২ টি বিচারের ঘটনা লিপিবদ্ধ ছিল। তার মধ্যে ২০ টি অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল।
তবে বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ করা যায়। প্রায়শই সেসময় অভিজাতদের মৃত্যুদন্ড থেকে অব্যাহতি পেতো, কিন্তু যারা দাস ছিলো তাদের কোনো মুক্তি ছিলো না।
হাম্বুরাবি কোড বা আইনের মতো আরেকটি আইন ছিল যার নাম হিট্টাইট কোড। তবে এই আইনটি হাম্বুরাবি কোডের চেয়ে তুলনামূলক নমনীয় ছিল তবে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত শাস্তি ছিল।
ইতিহাসের প্রথম ধর্ষণের অপরাধের কারণে মৃত্যুদন্ডও প্রথম দেখা যায় এই কোডে। এই হিট্টোহাইট কোড চালু ছিল ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
প্রাচীন যুগ
খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর এথেন্সের ড্রাকোনিয়ান কোড বা আইন সকল কিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সাধারণত ছোটখাটো অপরাধের জন্য ও এই আইনে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হতো। ড্রাকোনিয়ান কোডের ‘ড্রাকোনিয়ান’ শব্দটি মূলত শাস্তির তীব্রতা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
এই আইনে আপেল চুরির মতো ছোটখাটো অপরাধের জন্য একজন ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এই আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সাধারণ ধরনগুলির মধ্যে রয়েছে অপরাধীকে অনেক উঁচু থেকে ফেলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা, তৃষ্ণা বা অনাহারে মারা না যাওয়া পর্যন্ত একজন ব্যক্তিকে একটি তক্তায় বেঁধে রাখা এবং হেমলক বিষ পান করানো।
মৃত্যুদন্ড পাওয়া ব্যক্তির মৃতদেহ তার পরিজনদের কাছে দেওয়া হতো না, তবে দন্ডিত ব্যক্তি কোন অভিজাত বা রাজনৈতিক ব্যক্তি হলে সেই হিসেব আলাদা।
মৃত্যুদন্ড দেয়ার আরেকটি বিশেষ উপায় ছিল হেমলকের বিষ পান করিয়ে মৃত্যু কার্যকর করা। হেমলক একটি বিষাক্ত উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদের রস পাত্রে নিয়ে অপরাধীকে দেয়া হতো যাতে তা পান করে আত্মহত্যা করতে পারে।
এই পদ্ধতিতে ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। যুবকদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়ানো ও দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর সক্রেটিস কে হেমলক দেওয়া হয়েছিল যাতে সে তা পান করে আত্মহত্যা করতে পারে।
প্রাচীন রোমে ও অপরাধের শেষ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড কে বেছে নেয়া হয়েছিল। সাধারণত ঘোরতর অপরাধের জন্য অপরাধীকে অন্ধকার জেলে আটকে রেখে মারা হতো। কাউকে পানিতে ডুবিয়ে, কাউকে শিরশ্ছেদ করে, কাউকে আগুনে পুড়িয়ে এবং ক্রুশবিদ্ধ করেও মৃত্যুদন্ড দেয়ার প্রচলন ছিল।
খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীতে যীশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধকরণ সম্ভবত মৃত্যুদণ্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য ব্যবহৃত রোমান ক্রস আজ খ্রিস্টধর্মের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মধ্যযুগ
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে মধ্যযুগীয় ইউরোপে অপরাধ ও অপরাধী দুটোই দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। তাই প্রায়শই ছোটখাটো অপরাধের জন্য অপরাধীরা মৃত্যুদন্ডও পেতো।
১০ম শতাব্দীতে ল ব্রিটেনে ফাঁসি কার্যকর করার মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড একটি সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি হয়ে উঠে। এছাড়া শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড ও প্রচলিত ছিল এবং অপরাধীর দেহ কয়েক টুকরো করা হতো।
মধ্যযুগীয় ইউরোপের বেশিরভাগ অপরাধের মৃত্যুদন্ডের কারন ছিল ধর্মীয় বিধিনিষেধ না মানা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। মধ্যযুগে পুরো ইউরোপে তখন খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসার চলছিল। সে সময় বিচারকার্য পুরোটাই ধর্মীয় গুরুরা দেখতেন। আর সেই ধারায় চার্চের ধর্মীয় গুরুরা একটি নতুন আইন প্রনয়ণ করেন, কোনো খ্রিস্টান যদি কোনো ইহুদি নারী বা পুরুষ কে বিয়ে করে তাকে অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হতো।
এছাড়াও মধ্যযুগের ইউরোপে জাদুবিদ্যার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ১৩ শতক থেকে প্রায় ১৮ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয়রা সন্দেহভাজন নারীদের ডাঈনি উপাধি দিয়ে সাধারণ জনগণের সামনে আগুনে জীবন্ত পুড়ে দাহ করা হতো।
ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের সাথে সাথে যৌনতা ও ব্যভিচারের অপরাধে খলিফারা অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পদ্ধতি চালু করেন।
ব্যভিচার, ব্যভিচার বা ধর্ষণের জন্য দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার প্রাথমিক উপায় ছিল পাথর মেরে হত্যা।
আধুনিক যুগ
ঔপনিবেশিকতা আমেরিকা সহ বিশ্বের বাকি অংশে মৃত্যুদণ্ডের ধারা প্রবর্তন করেছিল। আমেরিকায় পুঁজির অপরাধ উপনিবেশ অনুসারে পরিবর্তিত হয় তবে সাধারণত জাতিগত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একবিবাহ অস্বীকার করা এবং ভারতীয়দের সাথে ব্যবসা করা মতো কারনেও মৃত্যুদন্ড দেওয়ার খবর পাওয়া যায়।
১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদন্ড স্থগিত করে দিয়েছিল। এর পেছনে তারা যুক্তি দিয়েছিল এটি কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক ছিল। যাইহোক, ১৯৭৬ সালে এটি শীঘ্রই পরিবর্তিত হয় যখন এটি পুনঃস্থাপিত হয়, তবে অপরাধের তালিকা সংক্ষিপ্ত করা হয় মৃত্যুদন্ডের জন্য।
বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য বা ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য দোষী ব্যক্তিদের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। নাৎসি জার্মানিতে সামরিক অবাধ্যতা বা পরিত্যাগ একটি ঘোরতর অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত ছিল।
আগ্নেয়াস্ত্র ক্রমবর্ধমান সাধারণ হয়ে উঠলে, ফায়ারিং স্কোয়াড দ্বারা মৃত্যু মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে ওঠে।
হিটলার, স্ট্যালিন এবং মুসোলিনির মতো স্বৈরাচারী নেতারা রাজনৈতিক নিপীড়নের জন্য এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ডদেশ দিতেন।
জোসেফ স্তালিনের শুদ্ধিকরণের ফলে প্রায় ১ মিলিয়নেরও বেশি সোভিয়েতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যেখানে মাও সেতুং-এর শাসনে চীনের বিপ্লবের সময় ৮ লক্ষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল।
মৃত্যুদণ্ডের এই নির্লজ্জ অপব্যবহার উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে, এবং বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা এই প্রথাটি বাতিল বা কঠোরভাবে সীমিত করার প্রচেষ্টায় তাদের আওয়াজ তুলেছে।
বর্তমান সময়ে মৃত্যুদন্ড
বর্তমানে পৃথিবীর ১০৯ টি দেশ সম্পূর্ণভাবে মৃত্যুদন্ড বিলুপ্ত করেছে। এরমধ্যে অনেকগুলো দেশ মৃত্যুদন্ড বিলুপ্ত করার কার্যক্রম চালাচ্ছে (গত ১০ বছরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেনি এবং কাউকে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার নীতি রয়েছে)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাজ্য মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে বা এর ব্যবহারকে ব্যাপকভাবে সীমিত করেছে।
বেলারুশই একমাত্র ইউরোপীয় দেশ যারা এখনও মৃত্যুদণ্ডের অনুশীলন করে, যেখানে রাশিয়া এই পদ্ধতি থেকে সরে দাড়িয়েছে।
তবে বর্তমানে বাংলা ভারতের মতো অনেক দেশই যুদ্ধাপরাধ ও টেররিজমের মতো ভয়ংকর অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড চালু রেখেছে।
হিউম্যান রাইটস কোড এবং সংস্থাগুলি প্রতিষ্ঠার ফলে এটির ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এর অনুশীলনের জন্য জনসমর্থন হ্রাস পেয়েছে। তা সত্ত্বেও, অনেক দেশ প্রকাশ্যে বিভিন্ন অপরাধের জন্য এটি ব্যবহার করে।
মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দিক দিয়ে বর্তমানে শীর্ষে আছে সৌদি আরব, চীন, ইরান, মিশর এবং ইরাক।