আয়ারল্যান্ডের (আইরিশ) মানুষদের শর্করার প্রধান উৎস আলু। এটিই তাদের প্রধান খাদ্য। যেমটা আমাদের দেশে ভাত। আইরিশদের ইতিহাসের দূর্ভাগ্যের অনেকটা জুড়ে রয়েছে আলুর দুর্ভিক্ষ, যা পটাটো ফ্যামাইন নামে অধিক প্রসিদ্ধ।
আলুর জন্য ঘটে যাওয়া এই দুর্ভিক্ষ পরিচিত বৃহৎ এক ক্ষুধা নামে যা সংঘটিত হয়েছিল ১৮৪৫ সালে। সেসময় Phytophthora Infestense নামের এক ধরনের ফাঙ্গাস দাবানলের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো আয়ারল্যান্ডের জমি জুড়ে। এই ছত্রাকটির উপদ্রবে ধ্বংস হয়ে যায় আইরিশদের প্রধান খাদ্য আলুর প্রায় ৮০ শতাংশ জমি।
সে সময় আয়ারল্যান্ডের প্রজা কৃষকেরা গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হতো এবং তাদের একমাত্র খাদ্যের নির্ভরশীলতা ছিলো আলুর উপর। হঠাৎ এই বিপত্তিতে অসহায় হয়ে পড়ে আইরিশরা। যার প্রভাব পড়ে আয়ারল্যান্ড এবং আইরিশদের উপর। সেসময় আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতি সর্বকালের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছায়। আয়ারল্যান্ডের সেসময় বেশিরভাগ মানুষই ছিলো কৃষক, তারা জমিতে অন্যান্য শাকসবজি চাষের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। একই সাথে ছিলো পশুর প্রাণীর সংকট। আয়ারল্যান্ডে তখন শেয়ালের উৎপাত এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল যে শেয়ালগুলোর থেকে হাঁস, মুরগী কিংবা ভেড়া কেউই রক্ষা পেতো না।
সেসময় আইরিশ মানুষরা যেহেতু পুরোপুরি আলুর উপর নির্ভরশীল ছিলো তাই সব মানুষকে অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের জমিতে Phytophthora Infestense দীর্ঘ ৭ বছর স্থায়ী ছিলো, এবং ধীরে ধীরে বিদায় নেয়। ১৮৪৫ সাল থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত চলা এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় ১০ লক্ষ আইরিশ, যা সংখ্যায় সেসময়কার আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। আর ঘরবাড়ি হাটায় আরো ১০ লক্ষ মানুষ, সেসব মানুষ শূণ্য হাতে অভিবাসী হয়ে অন্য দেশে পারি জমায়।
কেনো আইরিশদের এমন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হতে হয়েছিলো তার জন্য আমাদের কে আরেকটু পেছনে যেতে হবে।
১৮০১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অনুযায়ী আয়ারল্যান্ড গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে ছিলো বিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত৷ ততদিন একত্রে এই রাষ্ট্রের নাম ছিলো ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন এন্ড আয়ারল্যান্ড। তখনকার আয়ারল্যান্ডের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় থাকতো ব্রিটেনের জেনারেল ও লেফটেন্যান্ট।
সে সময় হাউজ অব কমন্সের জন্য আয়ারল্যান্ড পাঠিয়েছিলো প্রায় ১০৫ জন প্রতিনিধি এবং হাউজ অব লর্ডসের জন্য পাঠানো হয়েছিলো ২৮ জন সহকর্মী। কিন্ত এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এতো প্রতিনিধি আইরিশ থাকলেও তাদের জমির মালিক থাকতো ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত পুত্ররা। সে সময়ে পেনাল’ল অনুযায়ী যে সমস্ত আইরিশ জনসংখ্যা ক্যাথলিক চর্চা করতো তারা জমির মালিক হওয়া থেকে শুরু করে ভোট দিতে পারতো না।
১৮২৯ সালে এই পেনাল’ল আইরিশদের মাধ্যমে তীব্রভাবে অপগত ঘোষিত হলো। যার প্রভাব পড়ে আইরিশ সমাজ ব্যবস্থায়৷ সব জমি দখল করতে থাকলো ব্রিটিশ ও অ্যাংলো আইরিশরা।
বেশিরভাগ ক্যাথলিক সমর্থকদের জোড় করে জমির কৃষক প্রজারূপে ন্যস্ত করা হলো এবং জমির মালিকদের জবরদস্তি করে কর প্রদানের জন্য বাধ্য করা হলো। আয়ারল্যান্ড দুর্ভিক্ষের প্রায় ১০০ বছর আগে আয়ারল্যান্ড ভদ্র সমাজে পরিচিত ছিলো তাদের আলু চাষের মাধ্যমে।
অথচ কী নিদারুণ কষ্ট তা সত্ত্বেও এর পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ চাপে শুধুমাত্র এক প্রকারের আলু চাষ করা হতো। ক্রমশ এটি হয়ে উঠলো দরিদ্রের একমাত্র প্রধান খাদ্য, বিশেষত শীতের দিনগুলোতে।
Phytophthora Infestense জীবাণুর কারণে যখন আয়ারল্যান্ড ভূমির সবধরণের ফসল ধ্বংস হতে শুরু হলো। আয়ারল্যান্ডের ডাব্লিন শহরের নেতারা ব্রিটিশ কুইন ভিক্টোরিয়া ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সাহায্য প্রার্থনা করলে তারা তৎক্ষণাত তা মঞ্জুর করে এবং শস্য আইন নাকচ করে দেয়।
কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ দেয়া সত্ত্বেও আলু ফসলের কোনো ধরণের উন্নতি হয় না। দিনের পর দিন শেষে বাড়তে থাকে প্রত্যেকের খাদ্য চাহিদা আর অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে প্রধান খাদ্যের পরিমাণ। কৃষকেরা নিজেদের ফসলের খরচ বহন করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদনে ব্যর্থ হতে থাকে। মাসের শেষে হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধার্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। ক্ষুধার্থের পীড়ায় অসুখে ভুগতে থাকে আরো শ’খানেক।
ফসলের এই রোগ থাকাকালীন সময়েও আইরিশদের বেশ পরিমাণ ফসল দিয়ে দিতে হতো গ্রেট ব্রিটেন অর্থাৎ ব্রিটিশদের।
ইতিহাসবিদদরা বলেন, আয়ারল্যান্ড থেকে সেই দুর্ভিক্ষের সময়ই বিদেশ খাদ্য আমদানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি৷ অথচ সে দেশে লাখো লাখো মানুষ মারা যাচ্ছিলো খাদ্যাভাবে। ১৮৪৮ সালের রেকর্ড অনুযায়ী সেসময় আয়ারল্যান্ড থেকে আমদানি হতো নানা ধরণের পণ্যদ্রব্য যেমন, পর্যাপ্ত ডাল, মটরশুঁটি, খরগোশ সহ মাছ ও মধু।
১৮৫২ সাল পর্যন্ত আলু বীজের জমি জীবাণু থেকে মুক্ত হতে পারছিলো না। পূর্বে বিভিন্ন তথ্যমতে, তখন প্রায় ১ মিলিয়ন নারী পুরুষ সহ শিশু মারা গেছে। আরো ১ মিলিয়ন জনসংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়ে দেশ ছেড়েছে।
১৮৪৯ সালে অনেক আইরিশ পরিবার সম্ভাব্য যেকোনো উপায়ে বেঁচে থাকার জন্য ইংল্যান্ডে অভিবাসন শুরু করে। কেউ কেউ বেঁচে থাকার জন্য উত্তর আমেরিকায় পর্যন্ত অভিবাসী হয়েছিল। ইংল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকায় অভিবাসী হতে গিয়ে বিভিন্ন কারণে আরো ৫০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
Featured Image Credit: Fine Art America
Very sad