১৭২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস, মেরি টফ্ট নামে ইংল্যান্ডের একজন দরিদ্র অশিক্ষিত মহিলা খরগোশের জন্ম দেন। এই ঘটনা সম্পর্কে লেখার আগে আপনাকে একটু স্পয়লার দিয়ে দিচ্ছি, কোনো মানুষের পক্ষে খরগোশ জন্ম দেয়া সম্ভব নয়।
মেরি টফ্ট তার স্বামী ‘জোশুয়ার’ সাথে লন্ডনের থেকে বেশ দূরে গোডালমিং নামের একটি গ্রামে থাকতেন।
মাত্র ২৩ বছর বসয়ে মেরি টফ্ট ইতোমধ্যে ৩ টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, এরমধ্যে একটি সন্তান জন্ম দেয়ার সময়ই মারা গিয়েছিল। ৩য় সন্তান জন্ম দেয়ার কয়েকমাস পর মেরি টফ্ট আবারো গর্ভবতী হন। গর্ভপাতের জন্য মেরি টফ্টের স্বামী একজন ডাক্তার কে ডেকে নিয়ে আসেন। ডাক্তার টফ্টের গর্ভপাতের সময় অদ্ভুত রকম অনুভব করেন। তিনি দেখেন মেরি টফ্টের ভেতর থেকে মানব সন্তানের জায়গায় একটি খরগোশের মাথা ও পা বেরিয়ে এসেছে।
ব্যাপারটা এখানেই থেমে যায় নি, ম্যারি টফ্টের গর্ভ থেকে খরগোশের শরীরের বিভিন্ন হার তার শরীর থেকে বের হয়েছে, এবং সর্বমোট ৯ টি মৃত খরগোশ তিনি জন্ম দিয়েছেন বলে দাবী করতে থাকেন।
এই খবর তখন পুরো ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে, ম্যারি টফ্ট কয়েক সপ্তাহ যাবৎ হয়ে উঠেন ইংল্যান্ডের সকল মানুষের মধ্যে কৌতুহলজনক ব্যাক্তি ও মুখরোচক গল্পের বিষয়।
সেসময়ে ইংল্যান্ডের চিকিৎসকরা অলৌকিক ও অবাস্তব ঘটনাটি যাচাই করে রহস্য উদঘাটন করতে মুখিয়ে উঠেছিল।
এই ঘটনা সেসময় ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জর্জের কাছে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে নি। রাজা প্রথম জর্জ এই বিষয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠেন। তিনি দ্রুত তার ব্যাক্তিগত ডাক্তার কে এই ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত করতে মেরি টফ্টের বাড়িতে প্রেরণ করেন।
রাজ পরিবারের ডাক্তার ও সার্জন ‘নাথালিয়েন সেন্ট আন্দ্রে’ মেরি টফ্টের বাড়ি পৌঁছে দেখেন মেরি টফ্ট ততোদিনে ১৫ টি খরগোশের জন্ম দিয়েছেন।
সেন্ট আন্দ্রে তৎক্ষনাৎ মেরি টফ্ট কে পরীক্ষা করেন এবং তাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর দিতে থাকেন।
সেন্ট আন্দ্রে পরবর্তীতে খরগোশ জন্মদানের ব্যাপারে ‘A Short Narrative Of An Extraordinary Delivery of Rabbets’ শিরোনামের একটি প্যামফলেটে তার ফলাফল প্রকাশ করেন।
এর কিছুদিন পরে, মেরিকে লন্ডনে একটি পাবলিক স্নানে নিয়ে যাওয়া হয়। (আগেকার দিনে, মহিলারা কখনও কখনও তাদের শরীরকে সুস্থ করার জন্য জন্ম দেওয়ার পরে বাথহাউসে থাকতেন, এটা একরকম অস্থায়ী হাসপাতালের মতো ছিল)
যে খবরটা সংযুক্ত না করলেই নয়, ঐ সময়টায় ইংল্যান্ডে খরগোশের মাংসের বিক্রি একদমই কমে গিয়েছিল।
মেরি টফ্টের প্রতারণা ও ব্যাখা
সেসময়ে অনেক ডাক্তারের কাছে এটা স্পষ্টভাবে স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল যে মেরি ছোট খরগোশের জন্ম দিচ্ছেন না। প্রকৃতপক্ষে, মেরি টফ্ট কিছু লোককে ভাড়া করে খরগোশের শরীরের বিভিন্ন অংশ জোগাড় করতো।
ম্যারি টফ্ট কেনো এমন প্রতারণা করতো তা নিয়ে যথেষ্ট জাল ঘোলা তথ্য রয়েছে। এমনই কিছু তথ্যের উল্লেখ করছি।
মেরির টফ্টের মতে, তার প্রতারণাটি তার শেষ গর্ভাবস্থায় শুরু হয়েছিল,যখন তিনি মাঠে কিছু খরগোশ দেখেছিলেন। খরগোশ দেখার পর কয়েক সপ্তাহ তার মধ্যে লোভের উদ্রেক শুরু হয় যা সে পূরণ করতে পারে নি। কারণ তার পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র, আর খরগোশের মাংস ছিল খুবই দামী, যা কেনার সামর্থ্য ছিলো না।
প্রতারণা করার ক্ষেত্রে মেরি টফ্ট কিন্তু একা ছিলেন নাঃ- তার স্বামী, ভগ্নিপতি এবং শাশুড়ি (তার শাশুড়ীই তার ধাত্রী ছিলেন) তাকে সহায়তা করেছিলেন। এমনকি তাকে দেখতে যেনো গর্ভবতী নারীর মতো দেখতে মনে হয়, সেজন্য তার শারিরীক অবস্থা পরিবর্তনে ও সাহায্য করেছিল। তার পুরো পরিবারের সাহায্য থাকায় অনেক ডাক্তার পরীক্ষা করেও তার মিথ্যাচার ধরতে পারে নি।
মেরি এবং তার পরিবার দ্রুত অর্থ উপার্জনের আশায় খরগোশ জন্মদানের খেলায় নেমে পড়ে। সেই সময়ে ইংল্যান্ডে মানুষের কৌতূহল ছিল বড় ব্যবসা এবং টফ্ট পরিবার ভেবেছিল যে লোকেরা গর্ভবতী মহিলাকে খরগোশ জন্ম দিয়েছে এটা দেখতে আসার জন্য অর্থ প্রদান করতে পারে।
আরেকটি তত্ত্ব মনে করে যে মেরির পরিবার পুরো প্রতারণার স্বপ্ন দেখে থাকতে পারে এবং মেরি টফ্ট কে এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল।
শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কালচারাল হিস্ট্রির’ অধ্যাপক কারেন হার্ভে বলেছেন, বেশি মানব সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতার কারণে মেরি এই পরিকল্পনার সাথে যেতে চাপ অনুভব করতে পারেন। দেখুন, একজন মহিলা হিসাবে, তার প্রাথমিক কাজ ছিল অনেক সন্তানের জন্ম দেওয়া যারা পরিবারকে অর্থ উপার্জন করতে সাহায্য করতে পারে। যখন সে তা করতে অক্ষম ছিল, তখন পরিবার তাকে আরও বিভ্রান্তিকর উদ্দেশ্যে তার শরীর ব্যবহার করতে বাধ্য করেছিল।
হার্ভের এই ধারণাটি অন্য একটি কারণের নিচে চাপা পড়ে গেছে। মেরির খরগোশ জন্মদান জমির মালিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটি রূপ হতে পারে।
খরগোশ সেই সময়ে অত্যন্ত বিতর্কিত প্রাণী ছিল। তারা দীর্ঘকাল ধরে ধনীদের প্রতীক ছিল এবং তাদের পশম এবং মাংসের জন্য খরগোশ ছিলো খুবই মূল্যবান প্রাণী। খরগোশ গুলি প্রায়শই ধনী ও গরিব সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার কারণ ছিল, কারণ খরগোশগুলি প্রায়সই ধনী ব্যাক্তিদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতো এবং সেসব জমির শস্য খেয়ে শেষ করে ফেলতো যেখানে গরীব সাধারণ মানুষ রা চাষবাস করতো।
সেই সময় সেইসব গরীর কৃষকদের জন্য খরগোশ ছিল সত্যিই একটি কীট। কিন্তু সেই খরগোশ গুলোকে ধরা বা হত্যা করা ছিল চুরির সমতুল্য, এবং এরজন্য কঠোর শাস্তি ও ছিল।
লন্ডনে তার স্থানান্তরের পরে, মেরির পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। ন্যাথানিয়েল সেন্ট আন্দ্রের মতো লন্ডনের ডাক্তারদের প্রতারণা করা এত সহজ ব্যাপার ছিল না।
তারা তাকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রোপচারের হুমকি দেওয়ার পরে, মেরি তার অপকর্মের কথা স্বীকার করেন। মেরি টফ্ট বলেন, ‘এই মুখ নিয়ে আমি আর ফিরতে পারবো না, আমি নিজেকে ফাঁসি দেব।
মেরি টফ্ট ওয়েস্টমিনস্টারের একটি কারাগারে কয়েক মাস বন্দী ছিলো। যেহেতু সে কোনো অপরাধ করেনি, তাই ফৌজদারি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
১৭৬৩ সালে মেরি টফ্ট মারা গেলে, প্যারিশ রেজিস্টার ‘মেরি টফ্ট, বিধবা,খরগোশ প্রতারক’ এমন জাতীয় শব্দ দিয়ে তার মৃত্যু লিপিবদ্ধ করেছিল।
মেরি টফ্ট তার ইচ্ছায় কিংবা পরিবারের চাপে এই প্রতারণা করে থাকলেও সে সময় তিনি হয়ে উঠেন সাধারণ মানুষদের কাছে হাস্যরসাত্বক ব্যাক্তি। বন্দী হওয়ার পর ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ অতিআগ্রহী হয়ে মেরি টফ্ট কে দেখতে গিয়েছিল। এই দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটাও ছিল ব্যাঙাত্বক।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর পরবর্তী সময়েও তিনি ছিলেন সেই সময়ের সমাজের নিন্দিত ও ব্যাঙ্গাত্বক ব্যাক্তিত্ব।
Featured photo credit: William Hogarth (1762)