দ্য ক্রাইং বয় পেইন্টিংটি জিওভান ব্রাগোলিন নামে একজন ইতালীয় চিত্রশিল্পী দ্বারা আঁকা হয়েছিল; যা ছিল তার স্প্যানিশ ছদ্মনাম। তার আসল নাম ব্রুনো আমাডিও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৭০/৮০ এর দশক পর্যন্ত এই পেইন্টিং গুলো খুবই জনপ্রিয় উঠেছিল। কমবেশি সবার ঘরেই এই পেইন্টিং থাকতো।
৮০ এর দশকে এসে এই পেন্টিং অভিশপ্ত হওয়ার কুখ্যাতি লাভ করে। ৮০ এর দশকে বেশকিছু বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু সেসব বাড়িতে থাকা এই পেইন্টিং অক্ষত থেকে যায়। দমকল বাহিনী সেসময় একটি তথ্য দেয় যে তারা এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ টি পুড়ে যাওয়া বাড়িতে এই চিত্রকর্মটি পেয়েছে। সেসব বাড়ির সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও ছবিটি অক্ষত ছিল। আর তখন মানুষজনের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে যে এই চিত্রটি অভিশপ্ত।
ক্রাইং বয় পেইন্টিংগুলি ১৯৫০-৮০ এর দশকে ব্যাপকভাবে ছাপা হচ্ছিল, এবং সমগ্র যুক্তরাজ্য জুড়ে ব্যাপকভাবে বিক্রি ও হয়েছিল।
৪ সেপ্টেম্বর,১৯৮৫
ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য সান’ একটি সংবাদ প্রকাশ করে, রন এবং মে হল নামের এক দম্পতি সম্পর্কে, এই দম্পতির বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল এবং তারা এরজন্য ক্রাইং ভয় পেইন্টিং কে দায়ী করছিল। কারণ ঐ বাড়িতে পেইন্টিং টি ছাড়া আর বাকি সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।
পেইন্টিং এর ছেলেটি কে?
জিওভানও এই রকম ক্রাইং বয় নিয়ে অসংখ্য পেইন্টিং তৈরি করেছিলেন। কিছু পত্রিকা প্রচার কে যে তিনি একটি স্প্যানিশ এতিমখানার শিশুদের ছবি আঁকছিলেন যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে যে জর্জ ম্যালরি নামে একজন স্কুল শিক্ষক এই ছবির চিত্রশিল্পী কে খুঁজে বের করেছিলেন এবং তাকে পেইন্টিং করা ছেলেটির সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাকে জিওভানও বলেছিলেন,যে ছেলেটি ‘ডন বনিলো’ নামে একটি স্প্যানিশ পথশিশু ছিল।
জিওভানওর বাচ্চাটির সাথে ১৯৪৯ সালে মাদ্রিদে তার সাথে দেখা হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধের শেষের পরে ইতালি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরে যার বাবা-মা রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিল এবং তাই লোকেরা তাকে ‘এল ডায়াবলো’ নামে ডাকতে শুরু করেছিল, এর মানে ছিল শয়তান। তাই এজন্য কেউ তাকে দত্তক নিতে চায়নি। সে নাকি যেখানে যেতো সেখানেই আগুন লেগে যেত।
ছেলেটিকে একজন পুরোহিতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জিওভান দত্তক নিয়েছিলেন এবং তার চিত্রকর্ম এঁকে তাকে অপব্যবহার করতে শুরু করেন। ছোট্ট দুঃখি অনাথের চিত্রগুলি তাকে ধনী করে তোলে। কিন্তু একদিন হঠাৎই তার স্টুডিওটি রহস্যজনকভাবে পুড়ে যায় এবং জিওভান এই অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী করে সেই ছেলেটিকে, এবং ছেলেটি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এর কয়েক বছর পর, বার্সেলোনায় একটি গাড়ি বিস্ফোরণে সেই ছেলেটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ডঃ ডেভিড ক্লার্ক নামের এক সাংবাদিক এই রহস্য সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন, তিনি বলেন যে তিনি কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি; যে জর্জ ম্যালরির, জিওভানির সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছিল। হয়তো এগুলো তিনি বানিয়ে বলেছিলেন, খবরে আসার জন্য।
ডঃ ডেভিড ক্লার্ক আরও বলেন যে জিওভান হয়ত ২০-৩০ জন কান্নাকাটিকারী ছেলেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভেনিসে দেখার পর এঁকেছিলেন। যার প্রিন্ট ১৯৭৯ এর দশকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলিতে প্রচুর পরিমানে বিক্রি হয়েছিল।
৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালে, ‘দ্য সান’ পত্রিকায় ক্রাইং বয় পেইন্টিং নিয়ে ‘ক্রাইং বয় জলন্ত অভিশাপ’ শিরোনামটি পাঠকদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। যেটি ছিল রণ ও মে হল দম্পতির বাড়ি পুড়ে যাওয়ার ঘটনা।
এই ঘটনা শুনে ‘ডোরা মানা’ নামে এক পাঠক বলেন,
ছবিটি কেনার ছয় মাস পর তার বাড়ি পুড়ে যায় এবং তিনি আরও বলেন, কান্নারত ছেলেটির ছবি ছাড়া বাড়ির বাকি সবকিছুই পুড়ে গিয়েছিল।
‘দ্য সান’ এই নিউজ প্রকাশ করে তখন জনপ্রিয়তার একদম তুঙ্গে। তখন তারা পাঠকদেরকে তাদের বাড়িতে থাকা এই অভিশপ্ত পেইন্টিং টি সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। ক্রাইং বয় এর প্রায় ২৫০০ টি প্রিন্ট ’সান’ এর অফিসে পাঠানো হয়েছিল। যার ফলে নিউজ রুমে ১২ ফুট উঁচু একটি স্তুপের সৃষ্টি হয়েছিল।
এর এক সপ্তাহ পরে ‘দ্য সান’, ‘ক্রয়িং-বয় কার্স স্ট্রাইকস এগেইন’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। যেখানে তারা একটি তরুণের পরিবারের বাড়ি আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছিল, কিন্তু সেই বাড়িতে শুধুমাত্র পেইন্টিংটি অক্ষত ছিল।
‘দ্য সান’ এই বিষয়ে তাদের শেষ নিউজ কাভার করেছিল ‘Crying Flame’ শিরোনামে। যা হ্যালোউইনে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে তারা দাবি করেছিল যে তারা টেমস নদীর কাছে, তাদের সংগ্রহিত করা সকল পেইন্টিং তারা একটি বিশাল বনফায়ারে পুড়িয়ে দিয়েছে।
এই পেইন্টিং গুলো পুড়িয়ে দেয়ার সময় সেখানে উপস্থিত থাকা ‘ব্যারি ডেভিস’ নামের এক ফায়ার অফিসার বলেন যে
আমি মনে করি, এমন অনেক লোক আছে যারা এখন থেকে একটু সহজে শ্বাস নিতে পারবে।
বাড়িগুলোতে আগুন কেনো লাগতো?
বেশ কিছু তদন্তের পর দেখা গেছে যে এই আগুন লাগার বেশিরভাগেরই স্বাভাবিক কারণ ছিল। যেমনঃ- সিগারেট, ত্রুটিপূর্ণ তারের বা অপ্রত্যাশিত ডিপ-ফ্রাইং প্যান।
বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা
প্রিন্টগুলি অগ্নি-প্রতিরোধী বার্নিশ দিয়ে প্রলেপিত ছিল। ফলে এটি সহজেই পুড়ে যাওয়া বাড়িতে অক্ষত ছিল।
ডঃ ডেভিড ক্লার্ক আরও আবিষ্কার করেছিলেন যে পেইন্টিংটি একটি সংকুচিত বোর্ডে মুদ্রিত হয়েছিল যা এটি পোড়াতে অসুবিধা করে।
চিত্রকর্মটি কি সত্যিই অভিশপ্ত ছিল?
যেহেতু পেইন্টিংগুলিতে কেন আগুন ধরে না তার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে, তাই এটিকে অভিশপ্ত বলা চলে না। তবুও অনেকে বিশ্বাস করে যে চিত্রটি অভিশপ্ত এবং তারা এই জাতীয় চিত্রগুলি বাড়ির দেয়ালে ঝুলিয়ে না রাখার পরামর্শ দেয়।
জিওভান ব্রাগোলিন ১৯৮১ সালে মারা যান এবং এই গল্পের সত্যটিও তার সাথে চলে গেছে এবং এটি একটি নিছক কাকতালীয় ঘটনা যে সমস্ত ঘর পুড়ে গেছে তাদের দেয়ালে এই চিত্রগুলি সাজানো ছিল এবং তাই লোকেরা ভেবেছিল যে চিত্রটি অভিশপ্ত। আর রন ও মে দম্পতির ঘটনার এমন রসালো হেডলাইন সান পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর চিত্রটি দ্রুত হয়ে ওঠে গল্প করার জন্য একটি মুখরোচক বিষয়। যা সম্পর্কে এখনো মানুষের আগ্রহের শেষ হয়নি।
আচ্ছা আপনি কি আপনার বাড়িতে এই পেইন্টিং টাঙানোর সাহস করবেন?
Featured Photo Credit: CNN