শাস্তি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম বিষয়াবলির মধ্যে একটি। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই শাস্তির প্রথা উদ্ভব ঘটেছিল সাধারণত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং অপরাধ দমন করার জন্য। ইতিহাসের বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে শাস্তি পদ্ধতি ও ছিলো ভিন্ন ভিন্ন রকমের।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন লিখিত আইনের নাম হাম্মুরাবির আইন (খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫৪), এই আইন ছিলো “চোখের বদলে চোখ” নীতিতে গড়া। আবার প্রাচীন মিশরে শাস্তি দেবতাদের আদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত হতো। দেবতাদের সেই আদেশ দিতেন দেবতাদের প্রতিনিধি মিশরের সম্রাট ফারাও। প্রাচীন মিশরে সম্রাটরা নিজেও একজন দেবতা বলে বিবেচিত হতেন। আবার প্রাচীন গ্রীসে শাস্তি দেওয়া হতো অপরাধীকে দাসে পরিণত করে। আর প্রাচীন রোমে ক্রুশবিদ্ধকরণ করে।
সময়ে সাথে সাথে শাস্তির ধরণেরও পরিবর্তন ঘটেছে কখনো সেই শাস্তি হয়েছে আরো নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর। যেমন ধরুন মধ্যযুগের ইউরোপের কথা সেখানে ধর্ম বিদ্রোহীদের আগুনে পুড়িয়ে ও পাথর দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হতো।
Poena Cullei : চামড়ার বস্তায় আবদ্ধ করা
প্রাচীন রোমে মানুষকে চামড়ার বস্তায় আবদ্ধ করে মৃত্যুর শাস্তি দেওয়া হতো। এই শাস্তি শুধুমাত্র তাদেরকে দেওয়া হতো যেসকল সন্তান নিজের পিতামাতাকে হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধ করতো। আর এই শাস্তি “পোয়েনা কুলেই” নামে পরিচিত ছিলো।
শাস্তি দেওয়ার আগে অপরাধীকে জনসম্মুখে অপমান, ভৎসনা ও শারিরীক নির্যাতন করা হতো। এরপর তার মুখ ঢেকে ফেলা হতো, যার অর্থ তিনি আলো দেখবার যোগ্য নন। এরপর চামড়ার বস্তার মুখ সেলাই করে ফেলা হতো। বস্তা সেলাই করার পূর্বে বস্তার মধ্যে কুকুর, সাপ, বানর কিংবা মুরগির মতো বিভিন্ন পশুও ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এরপর বস্তাটি নদীর পানিতে ফেলে দেওয়া হতো। অপরাধী ব্যক্তি বস্তার মধ্যে থাকা প্রাণীর আক্রমণের শিকার হতেন, সবশেষে পানিতে ডুবে শ্বাসরোধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটতো।
এই ধরনের মৃত্যু তখনকার সময়ে নাটকীয় প্রদর্শনীর মতো অনুষ্ঠিত হতো। এর মাধ্যমে বুঝানের চেষ্টা হতো যে নিজের পিতামাতা কে হত্যা করা অমানবিক ও ভয়ংকর অপরাধ। মৃত্যুর সময়ে তার সাথে পশু/ প্রাণী রেখে এটা নির্দেশ করা হতো যে সে ব্যক্তি আর মানুষের পর্যায়ে নেই,পশুদের পর্যায়ে চলে গেছে।
এই শাস্তি প্রাচীন রোমে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক থেকে শুরু হয়েছিলো। রোমানরা মনে করতো পিতামাতাকে হত্যা করা প্রকৃতির বিরুদ্ধে ভয়ানক অপরাধ। আর তারা এটাও বিশ্বাস করতো এই শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীর শরীর ও আত্মা শুদ্ধ হয়। এই শাস্তি প্রথা রোমান সাম্রাজ্যের প্রায় বেশিরভাগ সময়েই চালু ছিলো। মধ্যযুগে এই শাস্তি বিলুপ্ত হয়।
র্যাক (The Rack)
মধ্যযুগের ইউরোপে শাস্তি দেবার একটি কুখ্যাত পদ্ধতি ছিলো র্যাক। এই শাস্তি পক্রিয়ায় অপরাধীকে শাস্তি দেবার জন্য প্রথমে একটি কাঠের ফ্রেমে বেধে তারপর হাত ও পা রোলার দিয়ে টেনে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুলে ফেলা হতো। এই শাস্তিতে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির শরীরের হাড় ভেঙ্গে যেতে, জয়েন্ট ও মাংসপেশি ছিঁড়ে যেতো। অনেক সময় শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেই মারা যেতে। অনেকে শাস্তি থেকে বাঁচতে অপরাধ না করেও দোষ স্বীকার করে নিতো। এই শাস্তি মূলত অপরাধ / দোষ স্বীকার করানো ও রাজনৈতিক শত্রুদের নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হতো।
এই রেক পদ্ধতি মধ্যযুগের ইউরোপে বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং স্পেনের মতো দেশগুলো অত্যাধিকহারে ব্যবহার করা হতে। খ্রিস্টান ক্যাথলিকরা যাদেরকে ধর্মবিরোধী মনে করতো তাদের স্বীকারোক্তি নেবার জন্য এটি ব্যবহার করতো।
যদি কেউ পরবর্তীতে বেঁচেও যেতো এই শাস্তি থেকে পরবর্তী জীবন তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করেই বেঁচে থাকতে হতো। সেই সাথে নির্যাতনের ফলে সে মানসিকভাবে সবসময় ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত থাকতো।
র্যাক শুধুমাত্র শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো তা একদমই না। শাস্তি ছাড়াও এটি ছিল ভয় প্রদর্শন এবং সমাজে শাসকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি উপায় ছিল। ১৭শ শতকের শেষদিকে র্যাকের ব্যবহার বিলুপ্ত হতে শুরু করে।
ইঁদুর নির্যাতন (The Rat Torture)
ইঁদুর ব্যবহার করে নির্যাতনের এই পদ্ধতি মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়ানক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভীতিকর শাস্তিগুলোর মধ্যে একটি। ইঁদুর ব্যবহার করে এই শাস্তি মধ্যযুগ ও পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষ স্বভাবতই ইঁদুর ভয় পায়, সেই সাথে ইঁদুরের আক্রমনাত্মক বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে অপরাধীকে শারিরীক ও মানসিক কষ্ট দেওয়া হতো।
এই শাস্তি পদ্ধতিতে অপরাধী বা শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে একটি ছোট, অন্ধকার, এবং স্যাঁতসেঁতে কক্ষে বন্দি করে রাখা হতো। তারপর সেই কক্ষে অনেকগুলো ক্ষুধার্ত ইঁদুর ছেড়ে দেওয়া হতো।ইঁদুরগুলো সেই ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন অংশে আক্রমণ করত, বিশেষ করে নরম অংশগুলো যেমন: মুখ হাত বা পা।
এই শাস্তি সেই মানুষটির উপর শারিরীক কষ্টের পাশাপাশি বড় রকমের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলতো। ইঁদুরের আওয়াজ শুনলেই সেই মানুষটি ভয়ে কেঁপে উঠতো। তাছাড়া কতক্ষণ তাকে এই অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে; সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা থাকতো না, যা তাকে মানসিকভাবে আরো ভেঙে দিতো।
ইঁদুরের মাধ্যমে নির্যাতনের এই পদ্ধতি মধ্যযুগীয় ইউরোপে বেশ পরিচিত ছিল। বিশেষ করে, নিষ্ঠুর শাসকরা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করত। এছাড়াও ঔপনিবেশিক সময়ে দক্ষিণ আমেরিকায় এই পদ্ধতির প্রয়োগের নজির পাওয়া যায়।
ইঁদুর দিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো বিশেষত রাজনৈতিক বন্দীদের স্বীকারোক্তি আদায় কিংবা বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার জন্য। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ মানসিক ও শারিরীক যন্ত্রণা দেওয়া ছিলো প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়া উদাহরণ সৃষ্টি ও অন্যতম কারণ ছিলো। যেনো ভবিষ্যতে কেউ শাসকের বিরুদ্ধে যাবার সাহস না করে।
কিলহলিং (Keelhauling)
কিলহলিং ছিলো নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত একটি ভয়ংকর শাস্তি পদ্ধতি। এই শাস্তি প্রধানত বিদ্রোহী নাবিক ও জলদস্যুতার মতো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। ১৭ ও ১৮ শতকের ইউরোপীয় নৌবাহিনীগুলোর মধ্যে এই শাস্তি প্রথা প্রচলিত ছিলো। এই শাস্তি ছিলো খুবই কষ্টদায়ক এবং প্রায়শই প্রাণঘাতী।
এই শাস্তি পদ্ধতিতে অপরাধীর হাত-পা শক্ত করে রশি দিয়ে বাঁধা হতো। তারপর জাহাজপরর কিল অর্থাৎ তলার নিচে রশির সাহায্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো। জাহাজ যখন দুলতো তখন সেই ব্যক্তির জাহাজের তলার সাথে ঘষা লাগতো। জাহাজের তলা সাধারণত শক্ত খোলস বা বার্নাকল (barnacles) দিয়ে আবৃত থাকত। এই ধারালো বস্তুগুলো অপরাধীর ত্বক ছিঁড়ে ফেলত, যার ফলে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি হতো। এই শাস্তিতে সেই ব্যক্তিকে দীর্ঘ সময় পানির নিচে রাখা হতো, যার ফলে শ্বাস নিতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো।কিলহলিং শাস্তির দৃশ্য জাহাজের অন্যান্য নাবিকদেরকে দেখানো হতো যাতে তারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস না। নাবিকদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার অন্যতম উপায় ছিলো এই শাস্তি।
এই শাস্তির ফলে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি শারিরীক ভাবে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হতেন। ধারালো বার্নাকলের কারণে অপরাধীর ত্বক ছিঁড়ে গিয়ে গুরুতর রক্তক্ষরণ হতো। অনেক সময় এই ক্ষত থেকে সংক্রমণ হতো, যা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াত। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে একা থাকার আতঙ্ক তাকে মানসিকভাবে দূর্বল করে দিতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তিপ্রাপ্তদের মৃত্যু ঘটতো। কিন্তু যারা বেঁচে যেতেন তারা বাকি জীবন মানসিক ট্রমা নিয়ে বাঁচতেন।
ইতিহাসে কিলহলিং সর্বপ্রথম ডাচ নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। পরবর্তীতে এটি ব্রিটিশ এবং অন্যান্য ইউরোপীয় নৌবাহিনীতেও ব্যবহৃত হযওয়া শুরু হয়। ১৮শ শতকের শেষের দিকে কিলহলিংকে অমানবিক বলে বিবেচনা করা শুরু হয়; এবং ধীরে ধীরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।