সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচন্ড রকম ব্যবহারের ফলে আজকের দিনের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচন্ড রকমের ক্ষতি হচ্ছে। জরিপে দেখা যায় পৃথিবীর ৩.৮% মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগেছেন। আর ডিপ্রেশনের ফলে সুইসাইড করছেন অনেকে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন সুইসাইড করছেন।
ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে বই, মিউজিক,মেডিটেশন, সাইকোথেরাপি সেশন এবং ওষুধ থেকে, আমরা আমাদের মনকে সুস্থ রাখার জন্য ক্রমাগত নতুন এবং আরও ভাল উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আজকের আধুনিক যুগে আমরা মানসিক চিকিৎসার জন্য যেসক পদ্ধতি অবলম্বন করি তা রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বাস্তবতা হচ্ছে সাইকিয়াট্রির সূচনা ছিল অন্ধকার, বিপজ্জনক এবং মারাত্মক।
আজ আপনাকে ৫ টি ভয়ংকর মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতির কথা জানাবো।
ইনসুলিন কোমা থেরাপি
বার্লিনে একটি মানসিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময়, অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ‘ম্যানফ্রেড সাকেল’ মাদকাসক্ত এবং সাইকোপ্যাথদের নিরাময়ের জন্য ইনসুলিন ব্যবহার করেছিলেন। ১৯২৭ সালে সেই রোগীদের মধ্যে একজন রোগী দুর্ঘটনাক্রমে ইনসুলিনের একটি বড় ডোজ গ্রহণ করার পরে কোমায় চলে যান।
কোমা থেকে ফিরে এলে সেই রোগী বলেন যে তিনি আর ওষুধ চান না এবং তিনি তার মানসিক স্বচ্ছতা ফিরে পেয়েছেন।
‘ম্যানফ্রেড সাকেল’ ভিয়েনায় ফিরে এসে মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীদের উচ্চ হারে ইনসুলিন ডোজ দিতে থাকেন। রোগীদের মধ্যে অনেকে দাবি করেন যে এই চিকিৎসায় তারা সুস্থ হয়েছেন।
১৯৩৩ সালে ‘ইনসুলিন কোমা থেরাপি’ কে তিনি সর্বজনীন করে তোলেন। এই চিকিৎসা ইউরোপ, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
‘ইনসুলিন কোমা থেরাপি’ সাধারণত দুই মাস স্থায়ী হয়, যার সময় সপ্তাহে ছয় দিন ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া হয়। থেরাপির ফলে রোগীদের গ্লুকোজের মাত্রা অত্যন্ত কম যেতো, যার ফলে ত্বক ফ্যাকাশে, অস্থিরতা, ঘাম, তন্দ্রা, খিঁচুনি এবং স্থূলতা দেখা দেয়। আরও গুরুতর পরিণতি ছিল মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং মৃত্যু।
মাথার খুলি ছিদ্র করা (ট্রেপানেশন)
ট্রেপানেশন হল ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ করা লোকেদের মাথার খুলিতে ছিদ্র করার মাধ্যমে চিকিৎসা করার প্রাচীন পদ্ধতি। আগের মানুষ মনে করতো রোগীর মাথার ভেতরে কোনো অশুভ আত্মা ঢুকে গেছে, যা তাকে এমন অদ্ভুত আচরণ করতে বাধ্য করছে। আর সেই অশুভ আত্মাকে মাথা থেকে বের করতে করা হতো মাথায় ছিদ্র।
ট্রেপানেশন বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের করা হতো। এছাড়াও মাথাব্যথা,মৃগীরোগ এবং অন্যান্য মানসিক রোগের চিকিৎসা এই পদ্ধতিতে করা হতো।
এই চিকিৎসা করার সময় কোন প্রকার চেতনানাশক ব্যবহার করা হতো না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ছিলো খুবই কম!
ট্রেপানেশন এশিয়া (বিশেষত চীন), আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকায় (বেশিরভাগ পেরু) প্রচলন ছিলো বেশি।
মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য
‘দ্য ফোর হিউমারসের তত্ত্ব’ ছিল প্রাচীন গ্রীক ওষুধের ভিত্তি। তত্ত্বটির পিছনে বিশ্বাস ছিল যে মানবদেহে চারটি মানসিক অবস্থা রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে বেশ কয়েকটি মানসিক ব্যাধি এবং অন্যান্য অসুস্থতা দেখা দেয়।
চারটি মানসিক অবস্থা মানবদেহ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত তরল বলে বিশ্বাস করা হতো। তারা অন্তর্ভুক্ত:
কালো পিত্ত- প্লীহা এবং কিডনি দ্বারা উৎপাদিত, যা বিষন্নতা সৃষ্টি করে।
হলুদ পিত্ত – পিত্তথলি দ্বারা উৎপাদিত, যা মানুষের ক্রোধ বাড়িয়ে তোলে।
কফ – মস্তিষ্ক এবং ফুসফুস দ্বারা উৎপাদিত, যা ফলে মানুষ গম্ভীর আচরণ করে।
রক্ত – লিভার দ্বারা উৎপাদিত,খারাপ পরিস্থিতিতে (অত্যধিক) আশাবাদ মানসিকতার সৃষ্টি করে।
এই মানসিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রক্তপাত, বমি, ঘাম, পরিষ্কার করা এবং কাপিং করা হযতো।
যেহেতু এই “পদ্ধতি”গুলির বেশিরভাগই নাপিত-সার্জন দ্বারা করা হয়েছিল, তাই এর অনেকগুলি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছিল।
তারা অদক্ষ হওয়ার কারণে, ‘সার্জন’ প্রায়শই একটি ধমনী ছিন্ন করত এবং রোগীর মাঝে মাঝে রক্তক্ষরণ হত। সংক্রমণগুলিও সাধারণ ছিল, এবং অনেকগুলি প্রয়োজনীয় তরল শরীরকে নিষ্কাশন করার ফলে লোকেরা তন্দ্রাচ্ছন্ন, দুর্বল এবং অন্যান্য রোগের জন্য সংবেদনশীল হয়ে পড়ে।
রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি খিঁচুনি
‘লাডিসলাস জোসেফ ভন মেডুনা’ ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান ‘নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট’ যিনি রাসায়নিকভাবে তৈরি খিঁচুনি আবিষ্কার করেছিলেন। তার গবেষণার সময়, মেডুনা লক্ষ্য করেছেন এই ক্যামিকেল প্রয়োগ করলে ৫% রোগীর মৃগীরোগ চলে যায় তাদের সিজোফ্রেনিয়া হয়। এবং এর বিপরীতে ৬০০০ সিজোফ্রেনিক রোগীদের প্রয়োগ করলে তাদের ২০ জন মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়, বাকিরা সুস্থ হয়ে যায়। এই পর্যবেক্ষণের ফলে মেডুনা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে মৃগীরোগের খিঁচুনি সিজোফ্রেনিয়া নিরাময় করে।
১৯৩৫ সালে ল্যাডিসলাস মেডুনা তার ফলাফলগুলি স্বাস্থ্য সংস্থার সামনে উপস্থাপন করেন। মেদুনা তার এই থেরাপি দিয়ে তার হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা করে গিয়েছিলেন।
যাইহোক, অবশেষে তাকে থামতে হয়েছিল কারণ রাসায়নিকভাবে প্ররোচিত খিঁচুনিগুলি তাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে অনিরাপদ ঘোষণা করা হয়েছিল যার মধ্যে (স্মৃতিশক্তি হ্রাস, হাড় ভাঙা এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি) অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নারীদের আবেগোন্মত্ততা বা হিস্টেরিয়া
মধ্যযুগ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত, একটি চিকিৎসা নির্ণয় নারীর সমার্থক হয়ে উঠেছে ‘ফিমেল হিস্টিরিয়া’। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, যৌন ইচ্ছা বা তার অভাব, অনিদ্রা, ক্ষুধা হ্রাস, বন্ধ্যাত্ব এবং চাপ সবই ছিল ‘ফিমেল হিস্টিরিয়ার’ লক্ষণ।
অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য, ডাক্তার এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে এসেছিলেন।
এর মধ্যে একটি ছিল,
গ্রীকরা বিশ্বাস করত যে জরায়ু অঙ্গটি একটি মহিলার দেহে চলাচল করে, তাকে শ্বাসরোধ করে এবং অসুখ ডেকে আনে। আর সমাধান হিসেবে মহিলা কে বিয়ে করতে এবং বাচ্চা উৎপাদন করতে বলা হতো, যাতে তার জরায়ু শান্ত হয়।
আরেকটি সমাধান ছিল ‘ফিমেল হিস্টিরিয়ায়’ আক্রান্ত মহিলাকে লুনাটিক অ্যাসাইলামে পাঠানো। ১৮৮৭ সালে, সাংবাদিক ‘নেলি ব্লাই’ নিউ ইয়র্কের একটি মানসিক হাসপাতালে পাগলের বেশ ধরে গিয়ে নেলি সেখানকার রোগীদের প্রতি অনিয়ম ও নির্যাতন সবার সামনে নিয়ে আসেন । চার দেয়ালে বন্দি করে মানসিক রোগীদের মরফিন ও ক্লোরাল জাতীয় ঔষধ দিয়ে মানসিকভাবে আরো বিকারগ্রস্ত করা , বরফ পানিতে গোসল করানো , ঝাড় দিয়ে পেটানো ও পানিতে মুখ ডুবিয়ে অত্যাচারসহ সেখানকার অন্যায় অনিয়ম প্রকাশ করেন, যা সে সময় ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। পরবর্তীতে ফিমেল হিস্টিরিয়া রোগীদের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
Featured Image Credit: PHILIPPE CLEMENT/ARTERRA/GETTY IMAGES