You are currently viewing ৬ টি অদ্ভুত ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাস

৬ টি অদ্ভুত ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাস

পুরো বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০০০ বা তারো বেশি ধর্ম ও সেই ধর্মের অনুসারী রয়েছে। প্রত্যেকটি ধর্মের অনুসারীদের তাদের ধর্মের ব্যাপারে প্রত্যেকের নিজস্ব স্বতন্ত্র অনুশীলন এবং বিশ্বাস রয়েছে। এই ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্রতাই পৃথিবী জুড়ে সৃষ্টি করেছে রকমারি সংস্কৃতির।

ধর্ম অনেক মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এটি আমাদের সঠিক আর ভুল বুঝতে সাহায্য করে, জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং মানুষকে একত্রিত করে। 

সব ধর্মেরই নিজস্ব আচার বা বিশ্বাস রয়েছে। আজ বিভিন্ন ধর্মের ৬ টি অদ্ভুত ও আচার সম্পর্কে জানাবো।

তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষদের মৃত্যুর পরে দেহ টুকরো করে শকুনকে খাওয়ানো হয় স্বজনদের সামনেই

তিব্বতিদের সবচেয়ে ব্যতিক্রমি ধর্মীয় আচার হলো মৃতদেহের সৎকার। এদের মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি খুবই অদ্ভুত তথা বিস্ময়কর। তিব্বতে stupa burial বা ‘বৌদ্ধস্তূপ’ সমাধি ও sky-burial বা ‘আকাশ সমাধি’ নামে দুটি প্রথা প্রচলিত আছে। প্রথম প্রথা শুধু উচ্চ স্তরে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা লামাদের জন্য প্রযোজ্য। আর দ্বিতীয় প্রথাটি সাধারণ মানুষের জন্য।

সাধারণ কোন তিব্বতি যদি মারা যায়, তবে ওই মৃতদেহ কাউকে ছুঁতে দেওয়া হয় না। ঘরের এক কোণে মৃতদেহটি বসিয়ে চাঁদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মৃতদেহের ঠিক পাশেই জ্বালিয়ে রাখা হয় পাঁচটি প্রদীপ। তারপর পুরোহিত ‘পোবো লামা’কে ডাকা হয়। ‘পোবো লামা’ একাই ঘরে ঢোকে এবং ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর পোবো মন্ত্র পড়ে শরীর থেকে আত্মাকে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমে মৃতদেহের মাথা থেকে তিন-চার গোছা চুল টেনে উপড়ে আনে লামা। তারপর পাথরের ছুরি দিয়ে মৃতদেহের কপালের খানিকটা কেটে প্রেতাত্মা বের করার পথ করে দেওয়া হয়।

Image Source: Wikimedia Commons

এরপর শবদেহকে উলঙ্গ করে গলায় একটা রশি লাগিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় ‘লামারা’ ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকে। শবদেহকে নিয়ে তার গলার রশি বা চুল বেঁধে রাখা হয় একটা খুটির সাথে, তারপর ‘কসাই’ মন্ত্র পড়তে পড়তে মৃতদেহের শরীরে বেশ কয়েকটি দাগ কাটে। দাগ কাটার পর একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে সেই দাগ ধরে ধরে মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়, যেভাবে আমাদের কসাইরা মাংসের টুকরো করে।

এ কাজ তথা আকাশ সমাধির আগের দিন মৃতদেহকে পরিষ্কার করা হয় ও সাদা কাপড়ে মুড়ে দেয়া হয়। এরপর মৃতদেহকে এমনভাবে রাখা হয়, ঠিক যেমন মায়ের গর্ভে শিশুর ভ্রূণ অবস্থান করে। এ শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ভোর শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয়। শবযাত্রায় নেতৃত্ব দেন বৌদ্ধ লামারা। পড়তে থাকেন ধর্মীয় বাণী, যা আত্মাকে পথ দেখায়। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছানোর পর শববাহকরা মৃতদেহের উপর জড়ানো সাদা কাপড় খুলে ফেলেন। এরপর মৃতদেহটিকে উপুড় করে ফেলে পেছন দিক কুঠার ও কাটারি থেকে কেটে ফেলা হয়, যার মাথা বাঁধা থাকে খুটিতে। এভাবে খুব ভালোভাবে মৃতদেহটিকে টুকরো টুকরো করে কাটা হয়। আর দেহের হাড়গুলোকে করা হয় চূর্ণ-বিচূর্ণ। এরপর মাংসের টুকরো ছড়িয়ে দেয়া হয়, যেন শকুনরা তা খেতে পারে। তবে পুরো মৃতদেহ টুকরো করার আগ পর্যন্ত শকুনদেরকে ঘেঁষতে দেয়া হয় না।

ঐ সময় মৃতের স্বজনরা দাড়িয়ে সব দেখতে থাকে। সাধারণত শকুন দিয়ে মৃতদেহ খাওয়ানো পবিত্র বলে মনে করা হয়। তিব্বতিরা শকুনদেরকে চেনে ‘ডাকিনিস’ হিসেবে। তিব্বতীয় মতে ‘ডাকিনিস’রা হলো দেবদূত। ডাকিনিসের অর্থ হচ্ছে আকাশের নৃত্যশিল্পী। তিব্বতীয়দের বিশ্বাস ডাকিনীরা মৃতের আত্মাকে স্বর্গে নিয়ে যায়। এটা হচ্ছে শান্তিময় এক স্থান, যেখানে আত্মাদেরকে পুনর্জন্মের পূর্ব পর্যন্ত রাখা হয়। এছাড়া শকুনদেরকে মৃতদেহ ভক্ষণ করতে দেয়া হলে মৃতের পুণ্য হয় বলে মনে করে সবাই, এমনকি মৃতের স্বজনরাও।

থাইপুসাম উৎসব

থাইপুসাম হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, প্রধানত তামিল সম্প্রদায় এটি বেশি উৎযাপন করে থাকে। এটি প্রতি বছর থাইয়ের তামিল বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে পূর্ণিমার সময় এই উৎসব পালন করা হয়; সাধারণত এটি ইংরেজি জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে ঘটে। উৎসবটির উদ্দেশ্য হিন্দু ধর্মের যুদ্ধের দেবতা মুরুগানের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন।

উৎসবটি একটি শোভাযাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় যেখানে ভক্তরা একটি ‘কাভাদি’ বা রথ কাঁধে করে টেনে নিয়ে যায়। দেবতা মুরুগানকে সম্মান জানাতে রথটি জমকালো ভাবে সাজানো হয়। তবে এই সাজসজ্জায় ময়ূরের পালকের ব্যবহার বেশি দেখা যায়।

Image Courtesy: Timeout

এই উৎসবের আকর্ষণীয় একটি আচার হচ্ছে স্ক্যুয়ার দিয়ে চামড়া ছিদ্র করা হয়। তারা তাদের গাল বা জিহ্বা দিয়ে প্রায়শই স্ক্যুয়ার দিয়ে তাদের শরীর ছিদ্র করে।  কেউ কেউ তাদের পিঠ থেকে হুক ঝুলিয়ে রাখে, মিছিলে চলার সময় ভারী জিনিস টেনে নেয়।

প্রভু মুরুগানের প্রতি তাদের ভালবাসা এবং প্রতিশ্রুতির চিহ্ন হিসাবে লোকেরা এটি করে। এই যন্ত্রণা সহ্য করে তারা দেবতাকে তাদের বিশ্বাস ও নিষ্ঠার পরিচয় দেন। ছিদ্রগুলি যত্ন সহকারে করা হয় এবং অনেকেই বিশ্বাস করেন যে দেবতা মুরুগানের ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ রক্তপাত বা সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

সতীদাহ – বিধবা নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা

সতীদাহ প্রথা হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মাহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা। সতীদাহ প্রথা হিন্দু ধর্মে ঠিক কবে থেকে প্রচলন শুরু হয় তা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে ধারণা করা হয় খ্রীস্টপূর্ব ৩০০ সাল বা তার-ও পূর্বে থেকে এই প্রথার প্রচলন শুরু হয়, এবং তা চলে গত শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত।

সনাতন ধর্মমতে বিশ্বাস করা হয় যে একজন নারী সতী হওয়ার মাধ্যমে তার স্বামীর পাপ মুছে ফেলতে পারে সেই সাথে নিজেরও মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। এই ধর্মীয় তত্ত্বে বিশ্বাস করে অনেক নারীই স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় নিজেকে বিসর্জন দিতেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলারা সতী হতে রাজী হতো না, তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করে স্বামী সঙ্গে চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো।

Image Courtesy: Unfoldbd

উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হলে শুরু থেকেই কোম্পানি এই বর্বর প্রথা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। তবে এই প্রথা বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রাজা রামমোহন রায়। তার চেষ্টায় কোম্পানি ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর শুধুমাত্র বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সতীদাহ নিষিদ্ধ করেন। এরপরেও দীর্ঘকাল সতীদাহ প্রথা ভারতে বিচ্ছিন্নভাবে ঘটেছে।

এক্সরসিজম

এক্সরসিজম হচ্ছে কোনো ব্যক্তি বা স্থান থেকে শয়তান বা মন্দ আধ্যাত্মিক সত্তাকে উচ্ছেদ করার একটি ধর্মীয় আচার। এই অনুশীলনটি বেশ প্রাচীন এবং এখনও বিশ্বের অনেক স্থানে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদেরকে করতে দেখা যায়। তবে এর চর্চা রোমান ক্যাথলিক বা অর্থডক্স খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের বেশি চর্চা করতে দেখা যায়।

Image Courtesy: The Atlantic

গির্জার ক্যানন আইন অনুসারে, স্থানীয় বিশপের অনুমতি নিয়ে শুধুমাত্র একজন নিযুক্ত ধর্মযাজক দ্বারা এক্সরসিজম করা যেতে পারে। এক্সরসিজম এর মাধ্যমে ধর্মযাজক খারাপ আত্মা বা শয়তানের সাথে কথপোকথনের চেষ্টা করেন।

এক্সরসিজম নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনা হচ্ছে ১৯৫০ এর দশকের যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড ডো এর ঘটনা। পরবর্তী কালে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৩ সালে দ্য এক্সরসিজম নামে একটি মুভি তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে অস্কার জিতেছিলো।

ভাল্লুক হত্যা করে উপাসনা

জাপান ও রাশিয়ার আইনু সম্প্রদায়ে ভাল্লুক উৎসর্গ করার একটি প্রথা প্রচলিত রয়েছে। ধর্মীয় আচার অনুযায়ী তারা বিশ্বাস করে ভাল্লুক হলো ঈশ্বরের একটি রূপ। ভাল্লুকের মাধ্যমেই ঈশ্বর মানবজাতিতে অধিষ্ঠান করছেন। আর তাই ভাল্লুক উৎসর্গ করলে তা মানবআত্নার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

বহিরাগতদের কাছে এই আচার অবশ্যই অদ্ভুত ঠেকবে। গুহা থেকে ঘুমন্ত মা ভাল্লুককে হত্যা করে তার বাচ্চাকে নিয়ে আসা হয়। বাচ্চাগুলোকে দুই বছর ধরে প্রতিপালনের পর বর্শা দিয়ে হত্যা করা হয়।

ভাল্লুক হত্যা করে উপাসনা
Source: SARAH MAX RESEARCH –

ভাল্লুকের চামড়া বর্শার সাথে মুড়িয়ে এর মাথায় ভাল্লুকের খুলি ঝুলিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হয়। এরপর ভাল্লুকের রক্ত পান করে ও মাংস ভোজন করে গ্রামবাসীরা এই আচার পালন করে থাকে।

এই প্রথার জন্য রাশিয়ায় সাদা ভাল্লুক প্রায় বিলুপ্তি পথে। রাশিয়ার সরকার তাই ভাল্লুক ধরা বা হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন। তাই বর্তমানে এই প্রথাটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের কাপরোট প্রথা

কাপরোট হল একটি ঐতিহ্যবাহী ইহুদি ধর্মীয় আচার যা সাধারণত ছুটির দিনগুলিতে করা হয়। এই আচার পালন করার জন্য একটি মুরগিকে ধরে একজনের মাথার চারদিকে ৩ বার ঘুরানো হয়। এই তিনবার ঘোরানোকে মনে করা হয় সেই মানুষের পাপ এই মুরগীর দেহে স্থানান্তরিত হয়েছে। এরপর মুগিটির মাথা ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা হয়। কেটে ফেলার পর তা ইয়োম কিপ্পুর ভোজে খাওয়া হয়।

Image Courtesy : Brandeis

বর্তমান আধুনিক যুগে এই ঐতিহ্য বেশিরভাগই ইহুদি ধর্নের হেরেদি সম্প্রদায়ের লোকেরাই বেশি পালন করে। এই আচার পালনের সময় ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোরাহ এর Psalms 107:17-20 এবং Job 33:23-24 এই অংশগুলো পাঠ করা হয়।