রাণী প্রথম এলিজাবেথ ১৫৫৮ সালে ইংল্যান্ডের রাণী হয়ে সিংহাসনে বসে এবং দীর্ঘ ৪৫ বছর রাজত্ব করেন। রাণী প্রথম এলিজাবেথ কে নিয়ে অনেক মুভি, সিরিজ ও টেলিভিশন শো তৈরি হয়েছে। তবুও এমন অনেক লোক আছেন যারা তার আকর্ষণীয় জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন না।
ইতিহাসবিদরা প্রায়ই এলিজাবেথান যুগকে ইংল্যান্ডের স্বর্ণযুগ বলে থাকেন। তবে এলিজাবেথ এর রাজত্বের সময়ে ধর্মীয় উত্তেজনা, স্প্যানিশ আর্মাডার হুমকি, প্লেগ মহামারী সহ নানান ঘটনা ঘটেছে।
১. রাণী এলিজাবেথ স্মলপক্সে (গুটিবসন্ত) আক্রান্ত হয়ে প্রায় মরতে বসেছিলেন
ষোড়শ শতাব্দীতে স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত ছিল মারাত্মক ভয়াবহ রোগ। গুটিবসন্তে আক্রান্ত মানুষদের মৃত্যুর হার ছিল খুবই বেশি, বিশেষ করে মহিলা এবং বয়স্কদের মধ্যে।
১৫৬২ সালের ১০ অক্টোবর রাণী এলিজাবেথের মধ্যে গুটিবসন্তের লক্ষণগুলি দেখা যায়। পরবর্তী ১ সপ্তাহের মধ্যে তিনি এতোটাই অসুস্থ হয়ে যায় যে কথাই বলতে পারছিলেন না। তার উপদেষ্টা এবং চিকিৎসকরা আতঙ্কিত হয়েছিলেন, কারণ এই রোগটি ইতিমধ্যে ইংরেজ রাজদরবারে অনেক সদস্যদের প্রাণ নিয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রিভি কাউন্সিল একটি বৈঠক ডেকেছিল। বৈঠক ডাকার কারণ ছিল, রাণী মারা গেলে তাদের করণীয় কি? কারণ তারা আশঙ্কা করছিল রাণীর মৃত্যুর পর বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক উত্থান হতে পারে। সত্যি তাই, রাণীর হঠাৎ মৃত্যুর পর গৃহযুদ্ধের বড় রকমের সম্ভাবনা ছিল।
সৌভাগ্যক্রমে, রাণী প্রথম এলিজাবেথ রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং মাসের শেষের দিকে তার রাজ দায়িত্বে ফিরে আসেন। বসন্ত রোগের পর সাধারণত মানুষের চামড়া ও মুখে কালো দাগ পড়ে; কিন্তু রাণী ভাগ্যবান তার শরীরে বসন্তের কোনো দাগই পড়ে নি।
২. রাণী প্রথম এলিজাবেথের ভয়াবহ দাঁতের সমস্যা ছিল
তার যুগের অন্যান্য লোকেদের তুলনায় তার স্বাস্থ সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিলো কয়েক যোজন এগিয়ে। কিন্তু রাণী প্রথম এলিজাবেথ তার দাঁতের যত্নের ব্যপারে ছিলেন উদাসীন। এলিজাবেথ অন্যান্য রাজা-রাণীদের মতোই চিনির প্রতি অনুরাগ ছিলেন। তিনি মিছরিযুক্ত ভায়োলেট, চিনির রুটি এবং মারজিপান বেশি পরিমানে আহার করতেন। এই খাবারগুলো তিনি ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দ করতেন।
এলিজাবেথ টুথপিক এবং এমনকি মাউথওয়াশ ব্যবহার করে ক্ষতি কমানোর জন্য তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, যার মধ্যে গন্ধরস, দারুচিনি এবং গোলাপজল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দুঃখের বিষয়, সমস্যাটি প্রতিরোধ করার জন্য এটি যথেষ্ট ছিল না। জীবনের শেষ দিকে এলিজাবেথের দাঁত কালো এবং হলুদ হয়ে গিয়েছিল এবং ব্যথার কারণে কিছু দাঁত উপড়ে ফেলে দিতেও হয়েছিল।
৩. রাণী প্রথম তার কাজিন কে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন
পারিবারিক কলহ ও ষড়যন্ত্র রাজপরিবার গুলোর সবচেয়ে প্রাচীন সমস্যার একটি। তবে রাণী এলিজাবেথ এর সৎ বোন রাণী প্রথম ম্যারির মতো রক্তপিপাসু রাণী তিনি ছিলেন না। তবে তিনি তার শত্রুদের মৃত্যুদন্ড দিতে মোটেও ভয় পাননি।
রাণী এলিজাবেথ ছিলেন প্রোটেস্টেন্ট মতবাদে বিশ্বাসী খ্রিস্টান। আর তাই ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক সম্প্রদায় এলিজাবেথ কে পছন্দ করতো না। তারা চাইছিল এলিজাবেথ এর চাচাতো বোন মেরি (যিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের রানী) একজন রোমান ক্যাথলিক রাণী হিসাবে ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড উভয়ের উপর শাসন করুক।
আর তাই তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১৯ বছরের জন্য বন্দী করেছিলেন। মেরি কে সেই সময়টায় কঠোর তত্ত্বাবধান ছাড়া বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। দীর্ঘকাল কোনো শরীরচর্চা ও হাঁটাচলা না করার কারনে তিনি অল্পবয়সেই গুরুতর বাত রোগে ভুগতে শুরু করেন।
১৫৮৬ সালে ব্যাবিংটন প্লট উন্মোচনের পর (রানীকে হত্যা করার এবং মেরিকে সিংহাসনে বসানোর ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের পরিকল্পনা), এলিজাবেথ জানতেন তখন তার কী করা দরকার। দীর্ঘ সাড়ে ১৮ বছর বন্দী থাকার পর ১৫৮৬ সালে তাকে এলিজাবেথকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং পরবর্তী বছর ফোদারিংহে ক্যাসলে তার শিরশ্ছেদ করা হয়।
সেসময় স্পেনের সাথে ইংল্যান্ডের দ্বন্দ্বও মেরির মৃত্যুতে ভূমিকা রেখেছিল। স্প্যানিশ রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ইংল্যান্ড আক্রমণ করে ক্যাথলিক রাজতন্ত্র আরোপ করার পরিকল্পনা করছিলেন। মেরির মৃত্যুর ঠিক এক বছর পর স্প্যানিশ আর্মাদা (স্পেনের নৌবহর এর নাম) ইংল্যান্ডে যাত্রা করে।
৪. রাণী প্রথম এলিজাবেথের সাথে ফ্রান্সিস ড্রেক এর বন্ধুত্ব ছিল
স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক এলিজাবেথান যুগে একজন সুপরিচিত নাবিক ছিলেন। তার কুখ্যাতি থাকার পরে-ও তিনি রাণীর খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছিলেন।
ইতিহাসবিদরা ফ্রান্সিস ড্রেক কে একজন জলদস্যু রূপেই বর্ণনা করেন। কারণ তিনি স্পেনিশ জাহাজ গুলোতে আক্রমণ চালাতেন, যখন তারা আমেরিকা থেকে পণ্য, ধন ও অর্থ বোঝাই করে দেশে ফিরে আসতো। রাণী এলিজাবেথ স্পেনিশদের তাদরে ক্যাথলিক বিশ্বাসের জন্য অপছন্দ করতেন। আর তিনি এই অপ্রীতিকর আক্রমণগুলো বন্ধ করার জন্য কিছুই করেন নি।
প্রকৃতপক্ষে, রানী ড্রেকের প্রতি অনুরাগী ছিলেন, তার সহজ সম্পর্ক এবং সর্ব-উদ্দেশ্য, কখনও ত্যাগ না করার মনোভাবের দ্বারা মোহিত হয়েছিলেন। তিনি নিয়মিত এলিজাবেথকে নৌ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতেন এবং এমনকি তিনি তার চুরি করা কিছু ধনসম্পদও রাণী প্রথম এলিজাবেথ কে দিয়েছিলেন।
১৫৮৮ সালে স্প্যানিশ আর্মাডার (স্পেনের নৌবহর) পরাজয়ে ড্রেকও অংশ নিয়েছিলেন। অন্যান্য বেশ কয়েকজন ইংরেজ সেনাপতির পাশাপাশি তিনি স্প্যানিশ নৌবহরকে পরাজিত করেন এবং নিজেকে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা নৌ বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
৫. রাণী প্রথম এলিজাবেথ একজন শক্তিশালী বক্তা ছিলেন
ইংরেজি সাহিত্যে রাণী এলিজাবেথ এর সময়কে বলা হয় ইংরেজি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। তার সময়ে কবিতা ও নাটক এর উত্থান ছিলো চোখে পড়ার মতো। তার সময়েই স্যার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, এডমান্ড স্পেন্সার কিংবা ক্রিস্টোফার মার্লোর মতো সাহিত্যিকদের আগমন ঘটে।
এলিজাবেথ শব্দ চয়ন ও বলায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন বিশেষ করে যখন তিনি বক্তৃতা দিতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৫৮৮ সালের আগস্ট মাসে টিলবারি, এসেক্সে এ সমবেত ইংরেজ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতায় বলেন:
‘I know I have the body of a weak and feeble woman, but I have the heart and stomach of a king, and of a king of England too, and think it foul score that Parma or Spain or any Prince of Europe should dare invade the borders of my realm …’
উপরের কথাটি সেই বক্তৃতার কিছু অংশমাত্র। ইতিহাসবিদরা এখন এই স্পিচ কে ‘গোল্ডেন স্পিচ’ বলছেন। এলিজাবেথ এর আরো একটি বিখ্যাত ভাষণ আছে; সেটি এলিজাবেথ ১৬০১ সালের নভেম্বরে পার্লামেন্টে দিয়েছিলেন।
৬. এলিজাবেথ সবসময় নিজেকে কুমারী বলে দাবি করেছেন
রাণী এলিজাবেথ স্বামী থাকার ধারণাটিকে ঘৃণা করতেন। এলিজাবেথ এর মা তার বাবা রাজা অষ্টম হেনরির দ্বারা শিরশ্ছেদ হয়েছিলেন। এছাড়া তার সৎ বোন ম্যারির স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপসের বিবাহ বিপর্যয় দেখে বিয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন রাণী এলিজাবেথ।
রাণী এলিজাবেথ তার দেশ ও সাম্রাজ্যেকেই স্বামী ভাবতেন। কুমারী হওয়ার কারনে সময়ের সাথে সাথে এলিজাবেথ এর সাথে মানুষজন যীশুখ্রীস্টের মাতা ভার্জিন ম্যারির তুলনা করতে থাকেন। অর্ধচন্দ্র এবং মুক্তার মতো প্রতীকগুলি – যা উভয়ই ভার্জিন মেরির সাথে যুক্ত ছিল -তা শীঘ্রই ইংল্যান্ডের রানীর সাথেও যুক্ত হয়।
ওয়াল্টার রেলি, বিখ্যাত ইংরেজ অভিযাত্রী (তিনি স্প্যানিশ আর্মাদার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন),তিনি আমেরিকায় একটি বিদেশী উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ভার্জিন রানির সম্মানে এটিকে ভার্জিনিয়া (বতমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য) নামে অভিহিত করেছিলেন।
রাণী প্রথম এলিজাবেথ সারাজীবন কুমারী ছিলেন কিনা সে নিয়ে ইতিহাসবিদরা দুই ভাগে বিভক্ত। আর তাই স্বামী ও সন্তান না থাকায় ১৬০৩ সালে রাণী এলিজাবেথ এর মৃত্যুর পর স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হন এবং একই সাথে উভয় দেশে শাসন করেন।