বাংলা ভাটি অঞ্চলের গানকে যিনি সবচেয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিম। শাহ্ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজান নামে এক দরিদ্র দম্পতির কুটিরে জন্মেছিলেন। করিম তার বাবা মায়ের ৬ সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলে।
আবদুল করিমের শৈশবের পুরোটা সময়ই বেড়ে উঠেছেন সুনামগঞ্জের কালনী নদীর পাশে। আর তাই জীবনটা তার সুখকর ছিলো না। প্রতিবছর বন্যা আর নদী ভাঙ্গনের দুঃখের প্রভাব সেই অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে করিমের উপরেও পড়তো।
মাঠে ঘাটে, নদী আর বিলে ঘুরে বেড়ানো সেই ছোট্ট ছেলেটি একসময় হয়ে উঠলেন বাংলার বাউল সম্রাট। ছিলো না কোনো গানের প্রশিক্ষণ বা অন্য কিছু শুধু ছিলো গানের প্রতি নিজের অগাধ ভালোবাসা। আর এই গান গাওয়ার জন্যই সারাজীবন তাকে হতে হয়েছে লাঞ্ছিত নিপিড়ীত ও অপমানিত।
আবদুল করিমের দাদার নাম ছিলো নসিবউল্লাহ। নসিবউল্লাহ নিজেও ছিলেন একজন স্বভাব কবি। ভাবিয়া দেখ মনে মাটির সারিন্দা এর মতো অনেক গান তিনি রচনা করেছেন। বলা চলে দাদার কাছে গান শুনেই গানের প্রেমে পড়েছিলেন শাহ্ আবদুল করিম।
শাহ্ আবদুল করিমের যখন বয়স ১০/১২ বছর তখন তিনি গ্রামের মোড়লের বাড়িতে মাসিক ২ টাকা বেতনে রাখালের কাজ নেন। তার কাজ ছিলো সারাদিন মোড়লের গরু ছাগলগুলোকে মাঠে চড়িয়ে সন্ধ্যায় মোড়লের খোয়াড়ে পৌঁছে দেওয়া। যখন বর্ষাকাল আসতো তখন কাজ করতেন মুদিখানায়। এসব কাজ ছিলো পেটের দায়ে। আর গানটা তখন গাইতেন বেঁচে থাকতে।
শাহ আব্দুল করিমের স্কুলে পড়াশোনা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েক দিনের। বৃটিশ আমলে ভাটি অঞ্চলে ইংরেজ রা নাইট স্কুল স্থাপন করে, আব্দুল করিম ও সেই স্কুলে পড়তে গিয়েছিলেন। সেই পড়াশোনা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৮ দিন! গ্রামের মানুষের মধ্যে গুজব রটে যায় যে এখানে পড়াশোনা করলে ব্রিটিশ রা জার্মানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ধরে নিয়ে যাবে। এই ভয়ে স্কুলের সব ছাত্র পালিয়ে যেতে থাকে, আব্দুল করিম ও তাই করলেন। তবে তিনি স্কুল থেকে না শিখতে পারলেও শিখেছেন বাংলার মাটি ও মানুষ আর জীবন থেকে।
গান গাওয়ার কারনে আব্দুল করিম নিজের গ্রামের মানুষের কাছে কাফের উপাধি পেয়েছিলেন। শাহ আব্দুল করিমকে নিজ গ্রাম ছাড়া হতে হয়েছিল শুধু তিনি গান গেয়ে থাকেন এ কারণে।
এক ঈদের দিনে যুবক শাহ আব্দুল করিমকে দেখা গেল ঈদের জামাতে। ইতিপূর্বেই তিনি গান বাজনা করেন এই প্রচারটি গ্রামে বেশ চাউড় হয়ে আছে। ফলে, অনেকেই তাকে যেমন পছন্দ করত, তেমনি অনেকেই এই গান বাজনার অভ্যাসকে ভীষণ অপছন্দ করত। ঈদের দিনের জামাতে তাই করিমকে বাধা দেয়া হলো। তাকে বলা হলো, গান গাওয়া বেশরা-বেদাতি কাম। করিম যেন সকলের সামনে তওবা করে।
শাহ আব্দুল করিম অবাক হলেন। নিজ গ্রামেই এই কথা শুনবেন ভাবেননি। তিনি শান্ত এবং দ্বিধাহীনভাবে বললেন,
“পরে করিব যাহা এখন যদি বলি করব না,
সভাতে এই মিথ্যা কথা বলতে পারব না।”
আব্দুল করিমের উত্তরে গ্রামবাসী হতাশ হলো। আর তখনই শাহ আব্দুল করিমকে কাফের আখ্যা করে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সত্যি সত্যিই তাকে নিজ গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল সেই সময়।
গানের জন্য ছাড়তে হয়েছিল প্রথম স্ত্রীকে
শাহ আব্দুল করিম বিয়ে করেছেন,স্ত্রীর নাম কাচামালা। নতুন স্ত্রীর সাথে যেখানে সাধারণ মানুষজন চুটিয়ে প্রেম করেন, সেখান শাহ আব্দুল প্রেম করছেন গানের সাথে। গানের আসরে গান গাইতে গাইতে তার ভোর হয়ে যায় অথচ তিনি যে ঘরে নতুন বউ রেখে এসেছেন তা ভুলেই গেছেন। এই অবস্থায় তার প্রথম বিয়ে বেশি দিন টিকলো না, প্রথম প্রেম গানের কাছে।
শ্বশুরবাড়িতে শাহ আব্দুল করিমকে ডাকা হলো। তাকে শর্ত দিয়ে বলা হলো, যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। হয় বউ নয়ত গান। বউ চাইলে গান চাইতে পারবে না। শাহ আব্দুল করিম বউকে ছেড়ে দিলেন৷ হয়ত তিনিও জানেন, জোর করে সংসার করে মেয়েটার উপর অবিচার করা হবে, তাকে সময় দিতে পারবেন না। তিনি তো সাময়িক সুখ, স্বস্তি পেতে মিথ্যার আশ্রয় নেন না। এটা তো আগেও দেখিয়েছেন ঈদের দিনে, আরো একবার সেটাই করলেন। তার গানের মতোই তার জীবন।
আব্দু করিমের প্রথম বিয়েটা ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল শুধু গান ছাড়তে চাননি বলে। সেই আব্দুল করিম দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আফতাবুন্নেসা নামক এক সরল নারীকে। যে নারী তার জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল শুধু সহচর হয়ে থাকার জন্যে। মানুষটিকে আব্দুল করিম ডাকতেন সরলা বলে। সরলা কখনো আব্দুল করিমের কাছে কিছু চাননি। উলটা বরং আব্দুল করিমের গান নিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন জনমভর। দিনের পর দিন আব্দুল করিম থাকতেন বাইরে বাইরে৷ গ্রামে গঞ্জে আব্দুল করিম থাকতেন গানের বায়না নিয়ে, সরলা কখনো অভিমান করে থাকেননি। এই কারণে সরলার কথা মনে উঠলেই শেষ বয়সে কেঁদে কেটে বিষণ্ণ হয়ে যেতেন আব্দুল করিম।
তিনি নিজের স্ত্রীকে মুর্শিদ বলে মানতেন। নিজের স্ত্রীকে মুর্শিদ বলে সম্মানিত করা সহজ কথা নয়। সরলার সাথে আব্দুল করিমের প্রেমের মাহাত্ম্য লিখে বোঝানো কার সাধ্য। আব্দুল করিম এমনিতে আর্থিক ভাবে কখনোই তেমনটা স্বচ্ছল ছিলেন না। তিনি যখন ঘরবিবাগী হয়ে গানে গানে মানুষের মন মাতাতেন, তখন সরলা অনাহারের সাথে যুদ্ধ করতেন। এমনও সময় গেছে যখন সরলা একটু খাবার যোগাড়ের তাড়নায় মানুষের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কাজ করে ভাতের পয়শা উপার্জন করতেন। তবুও এসব কখনো আব্দুল করিমকে বুঝতে দিতেন না। সংসারের সমস্যা নিয়েই যদি আব্দুল করিমকে মাথা ঘামাতে হয় তিনি গান বাঁধবেন কখন, সংসার নিয়ে ভাবতে গিয়ে আব্দুল করিমের মনের খাদ্য গানের উপর প্রভাব পড়ুক এমনটা কখনো চাইতেন না সরলা।
মানুষটাকে আব্দুল করিম কখনো কিছু দিতে পারেননি, উলটা সরলাই তাকে বলতেন, “আমি যদি আপনাকে আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে রাখি, আপনি বাইরে যাবেন কেমনে? আর আপনি যদি বাইরের মানুষের সঙ্গে না মেশেন, তবে জগৎ চিনবেন কেমনে আর গান বানাইবেন কেমনে?” একজন নির্লোভ মানুষ কতটা ভাগ্যবান হলে এমন নির্লিপ্ত স্বার্থহীন এমন প্রেয়সীর দেখা পান! এই প্রেমের গল্প হয়ত ইতিহাসে অমর হবে না, কিন্তু, এই প্রেমটা ভীষণ রকমের সত্যি। ভীষণ রকমের অদ্ভুত।
সরলা যেদিন মারা গেলেন সেদিনও কাছে কিনারে ছিলেন না শাহ আব্দুল করিম। তিনি তখন পড়ে আছেন, কোনো গানের আসরে। যখন জানলেন তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল তার! কে জানে। যদিও এক জীবনে তিনি সরলার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ব্যাপারটা ভুলতে পারেননি কখনো আর।
কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন যখন দেখলেন তিনি গান বাজনা করেন দেখে সরলার লাশ জানাজার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না।
গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, বাউলের স্ত্রীর আবার কিসের জানাজা, বাউলার স্ত্রীর জানাজা পড়ানোর দরকার নেই। আব্দুল করিম নিজেই নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় নিজের স্ত্রীর জানাজা পড়ালেন। সম্রাট শাহাজাহান সূদূর ইতালি থেকে সাদা মার্বেল এনেছেন, ইশা আফিন্দিকে দিয়ে বানিয়েছেন প্রিয়তমার জন্য এক বিশাল মহল, তাজমহল। শাহ আব্দুল করিম ধন দৌলতে সেই বাদশার ধারে কাছেও না, কিন্তু মনের মধ্যে পুষে রাখা যে প্রেম সেটা যে সত্য। করিম নিজ হাতে বানিয়েছেন সরলামহল, যে ঘরে শুয়ে আছেন প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা।
শাহ্ আব্দুল করিমের ধর্মবিশ্বাস
আব্দুল করিম গান করেন বলে বার বার মৌলবাদের লক্ষ্যের বস্তু হয়েছিলেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে গভীর বেদনা নিয়ে তিনি বলেন,
“সবার উপরে মানুষ সত্য এটাই আমার ধর্মবিশ্বাস।
কতিপয় কাঠমোল্লা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আমার এলাকায় প্রতিবছর শীতের রাতে ওয়াজ মাহফিল হয়। দূর দূরান্ত থেকে বিশিষ্ট ওয়াজিরা ওয়াজ করতে আসেন। তারা সারারাত ধরে আল্লাহ-রসুলের কথা তো নয়, আমার নাম ধরে অকথ্য গালিগালাজ করতেন। কি আমার অপরাধ? গান গাইলেই কি কেউ নর্দমার কীট হয়ে যায়?
এই মোল্লারা ইংরেজ আমলে ইংরেজি পড়তে বারণ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানের পক্ষে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, আজো তারা সমানতালে তাদের দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে মনে হয় একাই আবার যুদ্ধ করি। একাই লড়াইয়ের ময়দানে নামি। জীবনের ভয় করি না আর।”
তার সাথে গান করত, এক শিষ্য, যার নাম আকবর। অকালে মারা গেল সে। আকবরের মৃত্যুর খবরটা মাইকে ঘোষণা দেয়ার জন্য আব্দুল করিম অনুরোধ করলেন ইমামকে। ইমাম তাকে জানালো, করিম যদি তাকে হাত ধরে তওবা করে তাহলে জানাজা পড়ানো হবে, নয়ত না। গান গায় কাফিররা। করিমের সাথে থাকতে থাকতে আকবরও বেদাতি কাজকর্ম করে। সেও কাফির। তার জানাজা পড়ানো সম্ভব নয়। করিমের মনে আঘাত লাগলো সেদিন খুব। আতরাফের সবাই ইমামকে রাখার জন্য যে বার্ষিক চাঁদা দেয়, সেই চাঁদার একটা ভাগতো করিম নিজেও দেন। তবুও কেনো এই ব্যবহার? করিম অতঃপর ক্লান্ত যন্ত্রণাকাতর মনে নিজেই আকবরের জানাজা দেন।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে গানের সম্রাট
একবার হুমায়ূন আহমেদের একটা প্যাকেজ প্রোগ্রামে ডাক পান শাহ আব্দুল করিম। তার সাক্ষাৎকার নেয়া হলো। কিন্তু ফিরবার সময় হুমায়ূন আহমেদের সাথে সৌজন্য দেখা হলো না তার। এই নিয়ে হয়ত মনের কোথাও আক্ষেপ জমেছিল আব্দুল করিমের।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে আব্দুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালাল বলেন,
বিদায়ের সময় ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা দিয়েছিলেন, তিনি নিজে একবার বাবার সঙ্গে দেখাও করলেন না।
অবশ্য হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে শাহ আব্দুল করিমের গান বেশ পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, “এই লোকটি প্রাচীন ও বর্তমান এই দুইয়ের মিশ্রণ। তাঁর গানে সুরের যে ব্যবহার, তা খুবই বৈচিত্র্যময়।” তাছাড়া, বাংলাদেশ টেলিভিশনে শাহ আব্দুল করিমের গীতিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পেছনে হুমায়ূন আহমেদের অবদান ছিল। কারণ যে প্রোগ্রামটি তিনি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে, সেটি জমা দেয়ার পর জানতে পারেন যেহেতু শাহ আব্দুল করিম বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার নন, তাই বিটিভি প্রোগ্রামটি প্রচার করতে চাচ্ছে না। হুমায়ূন আহমেদ তাই এই শিল্পীকে বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার করে নেয়ার পরামর্শ দেন।
সংবর্ধনা
মানুষ হিসেবে শাহ আব্দুল করিম বড্ড সরল ছিলেন। তাকে ঘিরে আলোচনা, উৎসাহ বা বিতর্ক যা কিছুই থাকুক, তিনি থাকতেন এসবের বাইরে। নিজের জগতে। সে জগতে তার চাওয়া পাওয়ার সীমারেখা বড্ড ছোট।
একবার সুনামগঞ্জে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার কথা। প্রোগ্রামের শেষের দিকে মাইকে ঘোষণা আসলো, এবারে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার সম্মাননা চেক। আব্দুল করিম বার্ধক্যে উপনীত। তিনি বোধহয় কানে ভুল শুনলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি পাশে বসে থাকা তার একমাত্র সন্তান জালালকে বললেন, জালাল ইতা কিতা কয়! তিন হাজার টাকা! এ তো অনেক টাকা! এত টাকা দিয়ে আমি কি করতাম! আব্দুল করিমকে আস্তে করে জানানো হলো, তিন হাজার নয়, টাকার অংকটা তিন লাখ! শাহ আব্দুল করিম অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হতভম্ব। তিনি বললেন, তিন লাখ? সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু?
আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল। বলেই তিনি বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন। এই ঘটনার পর এই মানুষটিকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? একজন মানুষ কতটা আর নির্লোভ হতে পারেন!
নিজের গান বিকৃত ও কপি হওয়া নিয়ে আব্দুল করিমের কথা
ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?“
শাহ আবদুল করিম বললেন, “কথা বোঝা গেলেই হইল। আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।“
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন, “আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না। এটা কোনো কথা, এটার কোনো অর্থ আছে!“
জবাবে শাহ আবদুল করিম বললেন, “তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে, কিন্তু গান শুনতে কোনো মানুষ আসেনি। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে। গাইতে পারবে?” কালিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন, “না, পারব না।“
শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন, “আমি পারব। কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই, সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই৷ সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি।“
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেন, “সেই আদর্শটা কী?“
শাহ আবদুল করিম আবার হেসে বললেন, “একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।“
মৃত্যু
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ভাটি অঞ্চলের মানুষেরা জানতে পারলো, তাদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় বাউল শাহ আব্দুল করিম আর নেই। চিরনিদ্রায় ডুবে গেছেন খানিক আগে।
আব্দুল করিমের লাশ রাখা হয়েছিল শহীদ মিনারে। সেখানে অগণিত মানুষ এসেছেন মানুষটাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি গানের মানুষ। তাই তার শেষ শ্রদ্ধায় তাকে তার রচিত গান দিয়েই অশ্রুজলে বিদায় দেয়া হলো।
শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম প্রিয় দুই শিষ্য আবদুর রহমান ও রণেশ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাউলেরা শহিদ বেদিতে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খালি গলায় গাইতে শুরু করলেন, কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি…
কিন্তু শাহ আব্দুল করিমের জন্য যে অপেক্ষায় তার ভাটি অঞ্চলের মানুষরাও। তাকে নিয়ে যাওয়া হবে তার নিজভূমিতে।
বেলা দেড়টা। ধলগ্রামের উদ্দেশ্যে একসাথে বেড়িয়েছে অনেকগুলো নৌকার বহর। একটি নৌকা অবশ্য বেশ বড়। আলাদা করে চোখে পড়ছে। সেই নাওয়ের ছাদের অনেক ফুলের মালা। যেন একটা ফুলের কুঞ্জ। এই নৌকায় সওয়ারি হয়েছেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। নৌকা যাচ্ছে উজানধল গ্রামের দিকে। নৌকার বহরের যাত্রা গ্রামের মসজিদের দিকে। কথা আছে সেখানে হবে, এই বাউলের তৃতীয় জানাজা।
ভাগ্যের কি ফের। যে মসজিদে ঈদের জামাত পড়তে চেয়ে তিনি হয়েছিলেন অপরাধী, আজ সেই মসজিদেই হচ্ছে তার লাশের জানাজা। যেখান থেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তিনি গ্রাম ছেড়েছিলেন যৌবনে, জীবন সায়াহ্নে নিয়তি তাকে সেখানেই এনে থামিয়েছে আবার।
যে মানুষটাকে নিজের মুর্শিদ জ্ঞান করতেন, যাকে জীবদ্দশায় সময় দিতে পারেননি, স্বস্তি দিতে পারেননি, মরণকালে সেই প্রিয়তমা সরলার পাশেই তাকে শায়িত করা হলো।
Reference: wikipedia,somewhereinblog,শাহ আব্দুল করিমের সাক্ষাৎকার
এককথায় সমৃদ্ধ হলাম। বাউল সম্রাটের এই দুঃখময় জীবনের স্মৃতি আজীবন আমাকে ভাবিয়ে রাখবে বর্তমান সংকটকালীন দুঃসময়ে।
by heart I am a boul, I am a follower of LALAN SHAH, my first love is BOUL sangeet ” keno piriti baraila re bandu chere jaibay jadi”
সত্তি অসাধারন , কিছু জানলাম যেগুলো পুরো অজানাই থাকতো না পড়লে, আর এই ভগবান রুপী মানুষ তার কথা সারা জীবন মনে থাকবে , দেবদূত প্রণাম নেবেন আপনার পদযুগলে আমার মস্তক নত রাখিলাম
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ❤️