সাম্প্রতিক সময়ের সিরিয়াল কিলার বা গত শতাব্দীতে ধরা পড়া অনেক সিরিয়াল কিলারদের কথা হয়তো আপনি শুনে থাকবেন। কিন্তু হাজার বছর আগের কোনো সিরিয়াল কিংবা মধ্যযুগের সিরিয়াল কিলারদের সম্পর্কে কি আপনি কিছু জানেন?
আজ আপনাদের সামনে থাকছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ৭ জন ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য।
১. প্রক্রস্টেস: দ্য স্ট্রেচার
গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে প্রক্রুস্টেসকে উল্লেখ করা হয়েছে প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে। তিনি একজন দুর্বৃত্ত ও দস্যু ছিলেন। প্রক্রুস্টেসের একটি অতিথিশালা ছিলো। তার এই অতিথিশালায় তিনি পথ ভ্রমণে ক্লান্ত পথিকদের আপ্যায়ন করতে। আর তাদের ঘুমানোর জন্য বিছানার ব্যবস্থা করতেন। অতিথিরা আশা করতেন আপ্যায়ন হিসেবে তাদের গরম খাবার ও পানীয় দেয়া হবে তারপর শান্তির নিদ্রা।
কিন্তু তার পরিবর্তে তারা দেখতেন এই আপ্যায়ন করা লোকটার স্বভাব হঠাৎই পাগলাটে হয়ে গেছে। সে অতিথিকে বিছানায় বেঁধে ফেলতো। যদি অতিথির শরীর বিছানার সাইজের থেকে ছোট হতো তাহলে তাকে তার শরীর কে টেনে বিছানার সমান করার দানবীয় প্রচেষ্টা চালাতো। দেখা যেতো টানাটানির ফলে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গই আলাদা হয়ে গেছে।
আর যদি অতিথির শরীর বিছানার চেয়ে বড় হতো তখন তিনি অতিথির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলতেন। আর একসময়ে তাদের মৃত্যু হতো। তার এই উম্মাদনার কথা জানতে পারার পর রাজা থিসাস প্রক্রস্টেসকে তারই বিছানায় তার উম্মাদনার রাজত্বের অবসান ঘটান।
২. লিউ পেংলি
লিউ পেংলি ছিলেন খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দীর একজন হান প্রিন্স, লিউ তার হত্যার তাণ্ডবে তাকে সহায়তা করার জন্য তার ছোট সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন। অনুমান করা হয় যে তিনি একশোরও বেশি লোককে হত্যা করেছিলেন এবং হত্যা করা সেই মানুষদের সম্পত্তি লুট করেছিলেন।
এতো বড় অপরাধের পরে-ও লিউ পেংলির কোনো বিচার হয়নি। যেহেতু তিনি রাজপরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, রাজার কাছে তার দুষ্ট কাজের জন্য নালিশ করা সত্ত্বেও, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি বরং কেবল তার উপাধি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং তাকে রাজ নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।
৩. বিষের রাণী লোকাস্টা
লোকাস্টা ছিলেন খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে প্রাচীন রোমের সিরিয়াল কিলার। তাকে ইতিহাসের প্রথম সিরিয়াল কিলার ভাবা হয়। লোকাস্টা মানুষের কাছে বিষ বিক্রি করতেন আর সেই বিষ দিয়ে রোমের লোকেরা নিজেদের শত্রুকে হত্যা করতো।
শুধু সাধারণ মানুষ নন তার বিষ ব্যবহার করে ক্লডিয়াস এবং ব্রিটানিকাস এর মতে রোমান সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে। তার অপরাধের জন্য তিনি জেলেও ঢুকেছিলেন কিন্তু সম্রাট নিরো যখন সম্রাটের সিংহাসনে বসেন নিরো তাকে মুক্ত করে দেন। আর তিনি নিরোর প্রিয় ব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেন। এছাড়াও তিনি মানুষকে বিষ বানানো শেখাতেন, এবং তার প্রয়োগও।
তিনি কতজন লোককে হত্যা করেছিলেন তা অজানা, তবে নিরো যতদিন সম্রাট ছিলেন ততদিন পর্যন্ত তার প্ররোচনা স্থায়ী হয়েছিল। নিরোর আত্মহত্যার পর, লোকস্টাকে বন্দী করা হয় এবং অবশেষে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৪. গিলস ডি রাইস
গিলস ডি রাইস ফ্রান্সের ব্রিটানি নামক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ফ্রান্সের জাতীয় বীর জন অব আর্কের একজন নাইট এবং সঙ্গী ছিলেন।
নাইটের মতো মর্যাদাপূর্ণ খেতাব থাকা সত্ত্বেও, তিনি নীচু মানসিকতার কাজকর্ম করে গেছেন। গিলস শিশুদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতেন। শিশুদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং অবশেষে হত্যা করে তিনি পাশবিক আনন্দ পেতেন।
তিনি যে একজন শিশু সিরিয়াল কিলার ছিলেন তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন। মাত এক দশকেই তিনি ১৪০ জনপর অধিক শিশু হত্যা করেছিলেন। ১৪৪০ সালে মৃত শিশুদের শত শত বাবা-মা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে তাকে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৫. পিটার স্টাম্প
১৬ শতকের ইউরোপ তখন ওয়্যারউলফের উন্মত্ততার উচ্চতায়। পিটার স্টাম্প নিজেকে তখন ডেভিল থেকে উপহার ওয়্যারউলফ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই উদ্ভট ধারণাই তাকে একটি ক্ষুধার্ত, হত্যাকারী পশুতে রূপান্তরিত করেছিল। পিটার স্টাম্প, যদিও একজন ওয়্যারউলফ ছিলেন না, তবে তিনি অবশ্যই একজন দানব ছিলেন। তার নরখাদক প্রবণতার জন্য তিনি তার নিজের ছেলে সহ ১৪টি শিশুকে হত্যা করেছিলেন।
শুধু তাই নয় তিনি সহিংসভাবে দুই গর্ভবতী মহিলাকে হত্যা করেছিলেন এবং নিজের মেয়েকেও তিনি ধর্ষণ করেছিলেন।
তার এই জঘন্য অপরাধের জন্য তাকে সম্রাট নৃশংসভাবে মৃত্যু দেয়ার আদেশ দেন। তার মৃত্যুদন্ড এতোটাই নৃশংস ছিলো যে তার মৃত্যু বহুকাল পড়েও তা মানুষের মুখে প্রচলিত ছিল।
মৃত্যুদন্ডের সময় স্টাম্পকে একটি টর্চার হুইলে রাখা হয়, তারপরে তার মাথাটি বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং একটি নেকড়ের ছবির পাশে খুঁটির উপরে রাখা হয়। এটি করা হয়েছিল যাতে অন্য আর কোনো ব্যক্তি নিজেকে ওয়্যারউলভ হিসাবে জাহির করার চেষ্টা না করে।
৬. পিটার নিয়ার্স: নবজাতক খাদক
পিটার নিয়ার্স জর্মানির নুরেমবার্গের কাছের নিউমার্কট শহরের বাসিন্দা এবং আশেপাশের শহরগুলিতে ডাকাত হিসাবে পরিচিত ছিলেন। মানুষের কাছে প্রচলিত ছিলো সে কালো জাদু জানতো, তাই মানুষজন ও তাকে খুব ভয় করতো।
পিটার ৫০০ টিরও বেশি হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল অনাগত শিশু, যাদের মৃত্যু তাকে তার কালো জাদুতে সাহায্য করবে বলে সে মনে করতো। আর সেই উদ্দেশ্যে, সে গর্ভবতী মহিলাদের টার্গেট করতেন এবং তাদের থেকে (তার নিজের ভাষায়) বাচ্চা বের করতেন এবং তাদের খেতেও এগিয়ে যেতেন। বন্দী হওয়ার পরে এবং সমস্ত খুনের কথা স্বীকার করার পরে, তাকে তিন দিন ধরে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং অবশেষে ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ১৫৮১ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
৭.ক্রিস্টম্যান জেনিপারটেইঙ্গা
ক্রিস্টম্যান জেনিপারটেইঙ্গাকে ছিলেন ১৬ শতাব্দীর একজন দস্যু। ক্রিস্টম্যান জেনিপারটেইঙ্গাকে দেখতে অনেকটা খ্রিষ্টান সেইন্ট অর্থাৎ সাধুদের মতো দেখতে ছিলো। তিনি তার জীবনে প্রায় ১,০০০ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হয়।
ক্রিস্টম্যান জেনিপারটেইঙ্গা তার হত্যার রেকর্ড রাখার জন্য একজন জার্নাল রেখেছিলেন। সেই জার্নালই হয়ে উঠেন তার ৯৬৪ তম শিকার। তিনি যেসকল লোকেদের হত্যা করেছিলেন তাদের জন্য তার কোন অনুশোচনা ছিল না এবং তিনি ১০০০ জন হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিক্ষুব্ধ ছিলেন।
তিনি মূলত ভ্রমণরত ক্লান্ত পথিকদের হত্যা করতেন। কখনো তাদের বিষ পান করিয়ে হত্যা করতেন। কখনওবা তাদের ছুড়ি দিয়ে হত্যা করতেন। হত্যা করার পর সে নিজেদের সহযোগীদেরকে হত্যা করতেন যেনো সেই লুটের পুরো ভাগ নিজে ভোগ করতে পারেন।
১৫৮১ সালের মে মাসে তাকে বন্দী করা হয় এবং ১৫৮১ সালের জুনে ব্রেকিং হুইল ব্যবহার করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাকে নয় দিন ধরে নির্যাতন করা হয়েছিল, যার প্রতিটি সেকেন্ড ৯৬৪ জনকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ব্যয় করেছিল। ২৬ জুন ১৫৮১ সালে প্রচুর নির্যাতনের ফলে তার অভ্যন্থরীন অঙ্গের ক্ষতি হয় এবং তার মৃত্যু হয়।