You are currently viewing সেপ্পুকু বা হারাকিরি: জাপানি সংস্কৃতিতে অনুমোদিত আত্মহত্যা

সেপ্পুকু বা হারাকিরি: জাপানি সংস্কৃতিতে অনুমোদিত আত্মহত্যা

আত্মহত্যা যে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্যই সবসময়ই একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। আত্মহত্যা ঠেকাতে সারা বিশ্বের অনেক দেশই উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

মানুষ মূলত যেসব কারণে আত্মহত্যা করেন তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণ গুলো হলো:- বিষন্নতা, প্রেম ঘটিত কারণ, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, একাকিত্ব, একঘেয়ে জীবন কিংবা অপরাধবোধ।

আত্মহত্যাকে অনেক দেশেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, করা হয়েছে অনেক কঠোর আইন। আর ধর্ম গুলোও তার বিপরীত নয়। ধর্মে তো বলাই হয়েছে যারা আত্মহত্যা করবে তাদের চরকাল জাহান্নামে বা নরকেই থাকতে হবে।

কিন্তু বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন ধর্মে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ থাকলেও জাপানে সেপ্পুকু নামে অনুমোদিত আত্মহত্যার প্রচলন আছে। সেপ্পুকু নামটি জাপানের স্থানীয় নাম তবে পশ্চিমা বা বহির্বিশ্বে তা ‘হারা-কিরি’ নামেই অধিক পরিচিত।

সেপ্পুকু বা হারা-কিরি অর্থ হল পেট কেটে ফেলা। হ্যাঁ, এই রীতিতে নিজেই নিজের পেট কেটে মৃত্যুবরণ করে আত্মহত্যাকারী।

এই আত্মহত্যার প্রচলন শুরু হয় জাপানের বিখ্যাত যোদ্ধা গোষ্ঠী সামুরাই দের মাধ্যমে। আগেকার দিনে যুদ্ধে হেরে গেলে পরাজিত বাহিনীর সেনা ও নাগরিকদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করতো বা অকথ্য নির্যাতন চালাতো। তখন তাদের কাছে এই নরকীয় জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্মহনন তাদের কাছে অধিক শ্রেয় মনে হতো।

যুদ্ধে পরাজিত সামুরাই সেপ্পুকু পালন করছেন Image Credit: Wikimedia commons

সেপ্পুকুর অধিক প্রচলন ও গ্রহনযোগ্যতা ১২’শ শতাব্দীতে জাপানের বিখ্যাত যোদ্ধা গোষ্ঠী সামুরাই এর মাধ্যমে। সামুরাইদের কাছে এটি ছিলো সম্মানজনক মৃত্যু অর্জন করার মাধ্যম। শত্রুদের হাতে বন্দী হওয়া এড়াতে সামুরাইরা এই রীতি পালন করত। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়ের পরে আত্মসমর্পণের করে অপমানিত হওয়ার চেয়ে আত্মহত্যাকেই শ্রেয় মনে করে এই পদ্ধতি অনুশীলন করতো।

এই ভয়ঙ্কর কাজটি সাধারণত একটি তরবারি দিয়ে পেটে ছুরিকাঘাত করে, পেটে টুকরো টুকরো করে এবং তারপরে একটি মারাত্মক ক্ষত নিশ্চিত করার জন্য তলোয়ারটিকে উপরের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সঞ্চালিত হত।

সেপ্পুকুতে ব্যবহিত ছুড়ি (টেনটো) Image Credit: Ancient Origin

এছাড়াও মহান নেতাদের মৃত্যুতে শোক দেখানোর জন্য সেপ্পুকু অনুশীলন করা হতো। পরবর্তীতে প্রতিবাদ জানাতে এটিও করা হয়।

কেন পেট কেটে মরে যাওয়াই এই রীতি?

মানব শরীরে এতোগুলা অঙ্গ থাকতে, কেনবই বা পেট কেই আত্মহনন করা হতো?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁতে গেলে পাওয়া যায়, প্রাচীন জাপানে মানুষজনের ধারণা ছিলো:- মানুষের আত্মার বাস হল পেটে। তাই পেট সম্পূর্ণ চিরে মৃত্যুটাকে ধরা হতো মারা যাওয়ার সবচেয়ে অকপট ও সাহসী উপায়। আর তাই এই বিশেষ অধিকার কেবল অভিজাত সামুরাই গোত্রেরই ছিল। আর সাধারণ মানুষদের আত্মহত্যা জন্য বেছে নিতে হতো ফাঁসি ঝুলে যাওয়া, পানিতে ডুবে মরা কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতি।

আত্মহত্যার এই পদ্ধতি সামুরাই গোষ্ঠীর মেয়েরাও পালন করতো, তবে তাদের আত্মহত্যা কে সেপ্পুকু বলা হতো না বলা হতো (জিগাই‘Jigai’)। এই আত্মহত্যা পদ্ধতিতে মেয়েরা নিজেদের গলাকে একটি ছুরি (ট্যান্টো নামে পরিচিত) দিয়ে কেটে ফেলে মৃত্যুর স্বাদ নিতেন।

যুদ্ধে হেরে যেসকল সামুরাই যোদ্ধা আত্মহত্যার বদলে আত্মসমর্পণ বেছে নিতেন তাদেরকে তাদের সমাজ সবসময় তিরস্কার ও ঘৃণা খারাপ দৃষ্টিতে দেখতো।

সেপ্পুকুর প্রথম ঘটনা ঘটেছিল ১১৮০ সালে ইউজি(Uji) যুদ্ধে। মিনামোটো নো ইয়োরিমাশা নামের এক বিখ্যাত সামুরাই যোদ্ধা প্রথম সেপ্পুকু পালন করেন। তিনি মূলত শত্রুর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মূল্যবান তথ্য দেয়ার চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেন।

মিনামোটো নো ইয়োরিমাশার এর প্রতিকৃতি; Image Credit: Ancient Origin

মিনামোটো নো ইয়োরিমাশা এর মৃত্যুর আগে সামুরাইদের মধ্যে সেপ্পুকুর প্রচলন ছিলো না। এরপর থেকেই মূলত সামুরাইদের মধ্যে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আমাদের কাছে উদ্ভট ও অস্বাভাবিক মনে হলেও মান সম্মান কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জাপানিজদের কাছে এটা ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার

১২ শতাব্দীর দিকে সেপ্পুকু বেশ বড় পরিসরে পরিচিতি পায়। কিন্তু ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এই রীতি বেশ অগোছালোভাবেই পালিত হত। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মেনে করা হতো না, মৃত্যুর প্রক্রিয়াও মানুষভেদে বিভিন্ন ছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি ছিল ‘ট্যানটো’ নামে ছোট একধরনের ধারালো ছুরি ব্যবহার করে লম্বালম্বিভাবে পেট চিরে ফেলা, আর সবচেয়ে কম প্রচলিত পদ্ধতি ছিল যেকোনো ছুরিকে এক জায়গায় বসিয়ে তার উপর পতিত হওয়া।

১৯ শতকের শুর থেকে সামুরাই যোদ্ধাদের পতনের কারণে সেপ্পুকু ও বিবর্ন হতে থাকে। তবে এটি একেবারে হারিয়ে যায়নি।

১৯১২ সালে জাপানের সম্রাট মেইজির মৃত্যু হলে তার জেনারেল নোগি মারেসুকে সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য সেপ্পুকু করে নিজেকে রাজার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।

সেপ্পুকুর আরেকটি বিখ্যাত ঘটনা ঘটে ১৯৭০ সালে। যখন জাপানের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মিশিমা ইউকিয়ো নিজের পেট কেটে জনসম্মুখে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মূলত জাপানের ঐতিহ্যের মূল্য হারানোর ব্যাপারে তার চিন্তাভাবনাকে সমর্থন দিতেই তিনি এই পথ বেছে নেন। আর এটিই মূলত জাপানের সবশেষ আনুষ্ঠানিক সেপ্পুকুর মাধ্যমে আত্মহত্যার সর্বশেষ ঘটনা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেপ্পুকু

হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সাম্রাজ্য আত্মসমর্পণ করে।

এই পরাজয়ের পর, অনেক জাপানি অফিসার আত্মহত্যার জন্য সেপ্পুকু আচার পালন করেন।  তারা এখনও আত্মসমর্পণের পরিবর্তে মরতে তাদের সাংস্কৃতিক আচার অনুসরণ করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক সেনার সেপ্পুকু পালন; source: china-underground.com

জাপানের বিখ্যাত সামুরাই যোদ্ধা Yamamoto Tsunetomo (১৬৫৯-১৭১৯)  তার বই Hagakure তে লিখেছেন:

কেন সেপ্পুকুকে “সম্মান দেওয়া” হিসাবে দেখা হয় এবং “শাস্তি নেওয়া” নয়?
জাপানি ভাষায়, আমরা সেই সামুরাইকে উল্লেখ করি যাকে সেপ্পুকুতে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এই বলে যে ব্যক্তিকে সেপ্পুকু করার সম্মান দেওয়া হয়েছিল, এমন নয় যে ব্যক্তিটিকে সেপ্পুকু দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। 

হাগাকুরে বইতে বলা হয়েছে যে যদি একজন সামুরাই তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে ঊর্ধ্বে ক্রমানুসারে এই ৬ টি প্রধান শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হয়েছিল:

১) স্বগৃহে বন্দী
২) রক্ষীদের বিচ্ছিন্নকরণ
৩) জমি বাজেয়াপ্ত করা
৪) নির্বাসন
৫) সেপ্পুকু দ্বারা মৃত্যু
৬) পারিবারিক তলোয়ার বাজেয়াপ্ত করা

আজ জাপানে পুরো বিবের তুলনায় আত্মহত্যা হার সবচেয়ে বেশি। এই বিশাল সংখ্যক আত্মহত্যার পেছনে জাপানের অতীতের সেপ্পুকু সংস্কৃতির প্রভাব তো নিশ্চয়ই এখনো রয়ে গেছে।

তবে জাপানে সেপ্পুকুর মতো অসুস্থ প্রথা এখন আর বৈধ নয়। ১৮৭৩ সালে জাপানের মেইজি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সেপ্পুকুকে নিষিদ্ধ করে এবং নতুন সংবিধানে এটিকে অবৈধ ঘোষণা করে।

Leave a Reply