সৈয়দ মুজতবা আলী (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ – ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) একজন বিংশ শতকী বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা। তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনির জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য এবং রম্যবোধে পরিপুষ্ট।
এই ব্লগ পোস্টে থাকছে সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্যের অসাধারণ কিছু উক্তি ও হাস্যরস।
১
মাছি-মারা-কেরানি নিয়ে যত ঠাট্টা-রসিকতাই করি না কেন, মাছি ধরা যে কত শক্ত সে কথা পর্যবেক্ষণশীল ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করে নিয়েছেন, মাছিকে যেদিক দিয়েই ধরতে যান না কেন, সে ঠিক সময়ে উড়ে যাবেই।
২
চোখ বাড়াবার পন্থাটা কী? প্রথমত : বই পড়া এবং তার জন্য দরকার বই কেনার প্রবৃত্তি
৩
রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়। তাই বোধ করি খৈয়াম তাঁর বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি
৪
বাঙালির বই কেনার প্রতি বৈরাগ্য দেখে মনে হয়, সে যেন গল্পটা জানে, আর মরার ভয়ে বই কেনা, বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে
৫
পরিপূর্ণ আনন্দের সময় মানুষের মন ভিন্ন ভিন্ন দিকে ধায় না। একটা আনন্দ নিয়ে সে পড়ে থাকতে ভালবাসে
৬
জীবনই অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন আর জীবনকে খন্ড খন্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক-একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁধা হয়ে যে তসবী-মালা হয় তারই নাম জীবন
৭
রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়। তাই বোধ করি খৈয়াম তাঁর বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি ”
৮
এক দোর বন্ধ হলে দশ দোর খুলে যায়; বোবার এক মুখ বন্ধ হলে দশ আঙুল তার ভাষা তর্জমা করে দেয়
৯
বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি
চিরজীবী হয়ে তুমি।
১০
রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়!
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়!
১১
সমুখে রয়েছে সুধা পারাবার
নাগাল না পায় তবু আঁখি তার
কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধা রে।
১২
এমন সময় সেই পায়ের মৃদু চাপ।
সব সংশয়ের অবসান, সব দুঃখ অন্তর্ধান।
১৩
পরিপূর্ণ আনন্দের সময় মানুষের মন ভিন্ন ভিন্ন দিকে ধায় না। একটা আনন্দ নিয়ে সে পড়ে থাকতে ভালবাসে ”
১৪
কে বলে আমি টাকার মর্ম বুঝি না? ফুরিয়ে গেলেই টের পাই।
১৫
জীবনই অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন আর জীবনকে খন্ড খন্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক-একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁধা হয়ে যে তসবী-মালা হয় তারই নাম জীবন।
১৬
ভেবে-চিন্তে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে বই কেনে সংসারী লোক। পাঁড় পাঠক বই কেনে প্রথমে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, তারপর চেখে চেখে সুখ করে করে, এবং সর্বশেষে সে কেনে ক্ষ্যাপার মত, এবং চুর হয়ে থাকে মধ্যিখানে। এই একমাত্র ব্যসন, একমাত্র নেশা যার দরুন সকালবেলা চোখের সামনে সারে সারে গোলাপি হাতি দেখতে হয় না, লিভার পচে পটল তুলতে হয় না।
১৭
ইউরোপে cold blooded খুন হয়, ভারতবর্ষে কোল্ড-ব্লাডেড্ বিয়ে হয়।
১৮
যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন, সে ব্যামো ওষুধে সারে না।
১৯
পৃথিবীর আর সব সভ্য জাত যতই চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য-উপন্যাসের এক-চোখা দৈত্যের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করি আর চোখ বাড়াবার কথা তুললেই চোখ রাঙাই।
চোখ বাড়াবার পন্থাটা কী? প্রথমত : বই পড়া এবং তার জন্য দরকার বই কেনার প্রবৃত্তি।
২০
কিন্তু বাঙালি আর কিছু পারুক না পারুক,বাজে তর্কে খুব মজবুত ।
২১
আইন মানুষকে এক পাপের জন্য সাজা দেয় একবার, সমাজ কতবার, কত বৎসর ধরে দেয় তার সন্ধান কোনো কেতাবে লেখা নেই, কোনো বৃহস্পতিও জানেন না।
২২
বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ী ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ী, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়!
২৩
বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয়নি।
২৪
যে ডাক্তার যত বড় তার হাতের লেখা তত খারাপ
২৫
মানুষের ভক্তি যতই গভীর হোক, সেটা অতল নয়-গভীরতম মহা-সমুদ্রেরও তল আছে।
২৬
সেনসর বোর্ড ফোর্ড ও তখন শিশু, এখনকার মত জ্যাঠা হয়ে উঠেনি, কাজেই হরেক রুচির ফিল্ম তখন এদেশে অক্লেশে আসত এবং আমরা সেগুলো গোগ্রাসে গিলতুম, তার ফলে আমাদের চরিত্র সর্বোনাশ হয়েছে সে কথা কেউ কখনো বলেনি এবং আজ যে সেন্সর বোর্ডের এত কড়াকড়ি, তার ফলে এ যুগের চ্যাংড়া চিংড়িরা যীশুখেস্ট কিংবা রামকেষ্ট হয়ে গিয়েছে এ মস্করাও কেউ করেনি।
২৭
আমি এ জীবনে তিনখানা হিন্দি ছবিও দেখিনি এবং অন্য কোন পাপ করিনি বলে এই পূণ্যের জোরেই স্বর্গে যাবো বলে আশা রাখি। তবে বলা যায়না, সেখানে হয়তো হিন্দী ছবি-ই দেখতে হবে। যদি প্রশ্ন শোধান, সে কি করে হয়? – তুমি হিন্দী ফিলিম বর্জন করার পূণ্যে স্বর্গে গেলে, সেখানে আবার তোমাকে ঐ ‘মাল’ই দেখতে হবে কেন? তবে উত্তরে নিবেদন, কামিনীকাঞ্চনসুরা বর্জন করার জন্য আপনি যখন স্বর্গে যাবেন তখন কি ইন্দ্রসভায় ঐ গুলোরই ছড়াছড়ি দেখতে পাবেননা?
২৮
ডাক্তার উৎসাহিত হয়ে আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আস্তে আস্তে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন এক সুন্দরী- হ্যাঁ, সুন্দরী বটে।
এক লহমায় আমি নর্থ সীর ঘন নীল জল, দক্ষিণ ইটালির সোনালি রোদে রূপালি প্রজাপতি, ডানয়ুবের শান্ত-প্রশান্ত ছবি, সেই ডানয়ুবেরই লজ্জাশীল দেহচ্ছন্দ, রাইনল্যান্ডের শ্যামলিয়া মোহনীয়া ইন্দ্রজাল সব কিছুই দেখতে পেলুম।
আর সে কী লাজুক হাসি হেসে আমার দিকে তিনি হাত বাড়ালেন।
আমি মাথা নীচু করে ফরাসিস কায়দায় তাঁর চম্পক করাঙ্গুলিপ্রান্তে ওষ্ঠ স্পর্শ করে মনে মনে বললুম,
বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি
চিরজীবী হয়ে তুমি।
২৯
আমার চাকরের নাম কাট্টু, কেননা সে পকেট কাটে, মাছের মাথা কাটে, আর প্রয়োজন হলে মনিবের মাথা কাটে।
৩০
জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে, ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়।
৩১
সরল হৃদয় মনে করে প্রেম লুকায়ে রাখিতে পারে
কাঁচের ফানুস মনে ভাবে লুকায়েছে শিখাটারে।।
৩২
শত্রুর মিলনে মনে অতি কষ্ট হয়
বন্ধুর বিচ্ছেদে কষ্ট হয় সাতিশয়।
উভয়েই বহু কষ্ট দেয় যদি মনে
শত্রু মিত্রে কিবা ভেদ তবে এ ভুবনে?
৩৩
ভাষাতত্ত্ব নিয়ে আমার মনে তখন আরও একটা খটকা লাগল ৷ রেডিয়ােওয়ালার চোস্ত ফার্সী জানার কথা। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ঐ যে সরাইওয়ালা বলল, ‘মাল-জানের’ তদারকি আপন আপন কাঁধে এ কথাটা আমার কানে কেমনতরো নূতন ঠেকলো। সমাসটা কি ‘জান-মাল’ নয়?’
অন্ধকারে রেডিয়োওয়ালার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তাই তার কথা অনেকটা বেতারবার্তার মত কানে এসে পৌঁছল। বললেন, ‘ইরানদেশের ফার্সীতে বলে, ‘জান-মাল’ কিন্তু আফগানিস্থানে জান সস্তা, মালের দাম ঢের বেশী৷ তাই বলে ‘মাল-জান’।
আমি বললুম, ‘তাই বোধ করি হবে। ভারতবর্ষেও প্রাণ রেজায় সস্তা — তাই আমরাও বলি ‘ধনে-প্রাণে’ মেরো না। ‘প্রাণে-ধনে’ মেরাে না কথাটা কখনো শুনিনি৷
৩৪
সর্দারজী হেসে বললেন, ‘কিছু ভয় নেই, পেশাওয়াৱ স্টেশনে এক গাড়ি বাঙালী নামে না, আপনি দু’মিনিট সবুর করলেই তিনি আপনাকে ঠিক খুঁজে নেবেন।’
আমি সাহস পেয়ে বললুম, ‘তা তাে বটেই তবে কিনা শৰ্ট পরে এসেছি —‘
সর্দারজী এবার অট্টহাস্য করে বললেন, ‘শর্টে যে এক ফুট জায়গা ঢাকা পড়ে তাই দিয়ে মানুষকে চেনে নাকি?
৩৫
রাজসভাতে এসেছিলাম বসতে দিলে পিছে,
সাগর জলে ময়লা ভাসে, মুক্তো থাকে নিচে।
৩৬
কে বল সহজ, ফাঁকা যাহা তারে, কাঁধেতে বহিতে যাওয়া।
জীবন যতই ফাঁকা হয়ে যায়, ততই কঠিন বওয়া।
৩৭
বোরকা পরে, ঐ যা। তা না হলে পাঠান মেয়েও স্বাধীন।
৩৮
খুদাবখ্শ আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু মুখে কথা ফুটল। বললেন, ‘আপনি পর্যন্ত এই কথা বললেন? ছেলে মরেছিল তো কি? আবার ছেলে হবে। বিবি মরেছেন তো কি? নূতন শাদী করব। কিন্তু ভাই পাব কোথায়?’ তারপর আবার হাউহাউ করে কাঁদেন আর বলেন, ‘আমার ভাই মরে গিয়েছে।’
অধ্যাপক বলা শেষ করলে আমি বললুম, ‘লক্ষ্মণের মৃত্যুশোকে রামচন্দ্রও ঐ বিলাপ করেছিলেন।
৩৯
শস্ত্রে সব পাওয়া যায় – কোন কিচ্ছুর অনটন নেই। সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে চান, না বিলিয়ে দিতে চান; পূজো করতে চান, না করতে চান – একখানা কিংবা বিশখানা; পূজো-পাজা করতে চান, কিংবা ব্যোম ভোলানাথ বলে বুঁদ হয়ে থাকতে চান, এমন কি মরার পর পরশুরামী স্বর্গে গিয়ে অপ্সরাদের সঙ্গে দুদণ্ড রসালাপ করতে চান কিংবা রবি ঠাকুরী ‘কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃ সমুদ্রেই’ হয়ে গিয়ে নির্গুণ নিরবাণানন্দ লাভ করতে চান, তাবৎ মালই পাবেন।
…শুধু হিন্দুশাস্ত্র না; ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম সব শাস্ত্রেরই ঐ গতি। শুধু হিন্দুশাস্ত্র এঁদের তুলনায় অনেক বেশি বনেদী বলে এঁর বাড়িতে দালানকোঠার গোলকধাঁধা ওঁদের তুলনায় অনেক বেশি, পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা পদে পদে। তাতে অবশ্য বিচলিত হওয়ার মত কিছুই নেই, কারণ স্বয়ং যীশুখ্রীষ্ট নাকি বলেছেন, যেহোভার আপন বাড়িতে দালান-কোঠা বিস্তর।
তাই শাস্ত্রের উপর আমার অগাধ শ্রদ্ধা। আর তাতে ফয়দাও এন্তার।
৪০
প্রেম গোপন রাখাতে যে গভীর আনন্দ আছে তার থেকে আমি তাকে বঞ্চিত করতে যাব কেন? শুনেছি প্রথম গর্ভধারণ করে বহু মাতা সেটা যত দিন পারে গোপন রাখে। নিভৃতে আপন মনে সেই ক্ষুদ্র শিশুটির কথা ধ্যান করতে করতে সে চলে যায় স্বর্গলোকপানে, যেখান থেকে মুখে হাসি নিয়ে নেমে আসবে এই শিশুটি।
৪১
আকাশের জল আর চোখের জল একই কারণে ঝরে না
৪২
আমি আর কি করি। বললুম, ‘হবে, হবে। সব হবে। কিন্তু টাগোর সাহেবের কোন্ কবিতা আপনার বিশেষ পছন্দ হয়?’
আহমদ আলী একটু ভেবে বললেন, ‘আয় মাদর, শাহজাদা ইমরোজ-‘
বুঝলুম, এ হচ্ছে,
‘ওগো মা, রাজার দুলাল যাবে আজি মোর-
৪৩
বাঙালী আপন দেশে ব’সে, এভারেস্টের গায়ে ফিতে না লাগিয়ে, চূড়োয় চড়তে গিয়ে খামখা জান না দিয়ে ইংরেজকে বাৎলে দেয়নি, ঐ দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়?
৪৪
প্রেমের সঙ্গে সূর্যেরই শুধু তুলনা হয়। আকাশ আর মুখ এক। ঘড়ি ঘড়ি রঙ বদলায়। সূর্য চিরন্তন। প্রেম-সূর্য একবার দেখা দিলে আর কোনো ভাবনা নেই।
৪৫
চোখের রোশনাই নেই বলে তিনি হৃদয় দেখতে পান
৪৬
বলা তো যায় না, ফিরিঙ্গীর বাচ্চা- কখন রঙ বদলায়।
৪৭
এই তালতলারই আমার এক দার্শনিক বন্ধু একদিন বলেছিলেন যে, এমেটিন ইনজেকশন নিলে মানুষ নাকি হঠাৎ অত্যন্ত স্যাঁৎসেঁতে হয়ে যায়, ইংরিজীতে যাকে বলে ‘মডলিন’- তখন নাকি পাশের বাড়ির বিড়াল মারা গেলে মানুষ বালিশে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বিদেশে যাওয়া আর এমেটিন ইনজেকশন নেওয়া প্রায় একই জিনিস।
৪৮
তুমি বলেছিলে ‘ভাবনা কিসের? আমি তোমারেই ভালোবাসি;
আনন্দে থাকো, ধৈর্য-সলিলে ভাবনা সে যাক ভাসি।’
ধৈর্য কোথায়? কিবা সে হৃদয়? হৃদয় কাহারে কয়?
সে তো শুধু এক বিন্দু শোণিত আর ফরিয়াদ-রাশি।।
৪৯
আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেওনা।
আমার ওটুকুতেই চলবে।
৫০
মজনু যখনই শুনত, তার প্রিয়া লায়লিকে নজদ্ মরুভূমির উপর দিয়ে উটে করে সরানো হচ্ছে সে তখন পাগলের মত এ উট সে-উটের কাছে গিয়ে খুঁজত কোন মহমিলে (উটের হাওদা) লায়লি আছে। মজনু মরে গেছেন কত শতাব্দী হল। কিন্তু এখনো তার জীবিতাবস্থার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস মরুভূমির ছোট ছোট ঘূর্ণিবায়ু হয়ে লায়লির মহমিল খুঁজছে। তুমি বুঝি কখনো মরুভূমি দেখো নি? ছোট ছোট ঘূর্ণিবায়ু অল্প অল্প ধূলি উড়িয়ে এদিকে ধায়, ওদিকে ধায়, ওদিকে ছোটে, সেদিকে খোঁজে।
৫১
এই এতদিনে বুঝতে পারলুম কালিদাস কোন দুঃখে বলেছিলেন, ‘হে সৌভাগ্যবান মুক্তা, তুমি একবার মাত্র লৌহশলাকায় বিদ্ধ হয়ে তারপর থেকেই প্রিয়ার বক্ষ-দেশে বিরাজ করছ; আমি মন্দভাগ্য শতবার বিরহশলাকায় সছিদ্র হয়েও সেখানে স্থান পাই নে।
৫২
ইনসাফের (ন্যায়ধর্মের) কথা তুললেন, হুজুর, এ-দুনিয়ায় ইনসাফ কোথায়? আর বে-ইনসাফি তো তারাই করেছে বেশী, যাদের খুদা ধনদৌলত দিয়েছেন বিস্তর৷
৫৩
নীরবতা’ যে শুধুমাত্র ‘হিরণ্ময়’ তাই নয়, সরব প্রশ্নকে নিধন করার মরণাস্ত্রও বটে।
৫৪
বল দেখি, মেয়েরা অনেকক্ষণ ধরে চুমো খেতে পারে না কেন?
কি করে বলবো বল?
দু মিনিট মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না বলে। কথা কইতে ইচ্ছে যায়।
৫৫
এক দোর বন্ধ হলে দশ দোর খুলে যায়; বোবার এক মুখ বন্ধ হলে দশ আঙুল তার ভাষা তর্জমা করে দেয়।
৫৬
জীবনই অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন আর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক-একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবি-মালা হয়- তারই নাম জীবন।
৫৭
পরিপূর্ণ আনন্দের সময় মানুষের মন ভিন্ন ভিন্ন দিকে ধায় না। একটা আনন্দ নিয়ে সে পড়ে থাকতে ভালোবাসে
৫৮
বাঙালির বই কেনার প্রতি বৈরাগ্য দেখে মনে হয়, সে যেন গল্পটা জানে, আর মরার ভয়ে বই কেনা, বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে।
৫৯
খাওয়াটা কিন্তু একটা বড় ধরনের আর্ট । খাওয়ার সময় মুখ বন্ধ রেখে চিবোলে কোন আজেবাজে শব্দ হয় না। এটা রবি ঠাকুর আমাদের শান্তিনিকেতান শিখিয়েছিলেন। আজকাল তো কাউকেই এই নিয়মে খেতে দেখি না। সবাই হার্ঘুস হুপুস করে গিলাছ। আমার সুন্দর নাতনীরা পর্যন্ত। দেখে দুঃখ লাগে।
৬০
রবি ঠাকুরের লেখা পড়ে যদি লোকে তাঁকে বুঝতে না পারে তাহলে কারও কিছু করার নেই । আর অধিকাংশ রবীন্দ্র-বিশারদকে আমি তাঁর লেখার দাড়ি-কমা বিশেষজ্ঞ মনে করি। হ্যাঁ , রবি ঠাকুরের দর্শন নিয়ে যদি কোন কথা উঠে তাহলে দু , এক কথা বলতে পারি।
৬১
আমার মৃত্যুর পর সবাইকে বলবে আলী সাহেব তাঁর best বইটা লেখার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু কী করবেন, উনার তো প্যারালাইসিস হয়ে ডান হাতটা অবশ হয়ে গেল। হাতটা ভালো থাকলে তিনি দেখিয়ে দিতেন সৈয়দ মুজতবা আলীর best বই কাকে বলে।
৬২
জীবনে আমি কয়েকটা ভুল করেছি।
প্রথম হলো- বিয়ে করে
দ্বিতীয়ত – বেশী বয়সে বিয়ে করে
তৃতীয়ত- বৌ-ছেলেদের সঙ্গে না থেকে।
৬৩
কোন বিদেশী ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে সেই ভাষার গালি শিখতে হবে। বেশ্যাপাড়া হল গালি শেখার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। কারণ এখানে দুনিয়ার নানা ভাষার নানা রকম লোকজন আসে। বাংলাদেশ বিপ্লবী আন্দোলনের সময় অনেক বিপ্লবীই পতিতালয়ে গিয়ে পতিতাদের আশ্রায় আত্মগোপন করে থেকেছেন। এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে কোন পতিতা কোন বিপ্লবীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে এমন কোন নজির আমার জানা নেই।
৬৪
আজকাল শিক্ষক ও লেখকদের বাসায় সাধারণত তুমি কোন বই পাবে না। কাউকেই দেখবে না যে বাস বাস বই পড়ছে। তবে তাদেরকাছে একটা বই তুমি পাবেই। সেটা হল চেক বই।
৬৫
সেদিন গিন্নী আমাকে বললেন আমার ড্রিংক করা দেখে নাকি ছেলেরা এসব শিখাব। আমি তখন তাঁকে বললাম, কেন আমি যে বাইশটা ভাষা জানি সেখান থেকে দু চারটে ভাষা ওরা শিখুক না? এই জন্যই বলি কোন মূর্খ বিয়ে করে। বিয়ে করার আগে অনন্ত দুবার ভেবো।
৬৬
এই যে ছেলে ছোকরারা মদ্যপান নিয়ে অত দাপাদাপি করে, ওরা তো মদ খেতেই পারে না। বাংলায় গত শতাব্দীতে মদ খেতো মাইকেল, তারপর গিরীশ ঘোষ, তারপর শিশির ভাদুড়ী আর এখন খাচ্ছে তোমার এই সৈয়দ মুজতবা আলী।
৬৭
এমন সময় সেই পায়ের মৃদু চাপ। সব সংশয়ের অবসান, সব দুঃখ অন্তর্ধান।
৬৮
এক দোর বন্ধ হলে দশ দোর খুলে যায়; বোবার এক মুখ বন্ধ হলে দশ আঙুল তার ভাষা তর্জমা করে দেয়।
৬৯
বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি চিরজীবী হয়ে তুমি।
৭০
যে ডাক্তার যত বড় তার হাতের লেখা তত খারাপ।