প্রাচীন যেসব সভ্যতা নিয়ে আধুনিক যুগে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় তার শীর্ষে থাকে প্রাচীন রোম, মিশর কিংবা গ্রীস।
কেমন ছিলো সেসময়কার মানুষদের জীবন ব্যবস্থা? কিভাবে কাটতো তাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা?
যদি টাইম মেশিনে চেপে হাজার বছর পেছনের রোম শহরে ফিরে যাওয়া যেতো। তখন তখন কেমন দেখতে পাবেন সেখানকার জীবন? টাইম মেশিন নেই তাই সেসব সম্ভব নয়। তবে ইতিহাস বেত্তারা গবেষণা করে যেসব তথ্য উপাত্ত বের করেছেন তা দিয়ে আজকে একটু প্রাচীন রোম নগরীতে একটু টাইম ট্রাভেল করাই যায়, তবে সেটা আপনাকে আপনার ইমাজিনেশন দিয়ে দেখতে হবে।
প্রাচীন রোমের সকাল
বর্তমান সময়ের মতোই প্রাচীন কালেও নগর ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। নগর জীবন ছিল এখনকার সময়ের মতোই গতিশীল আর গ্রাম ছিল তুলনামূলক শান্ত। শহরগুলো ছিলো বর্তমানের মতোই ব্যবসাকেন্দ্রীক আর গ্রামগুলো কৃষিকেন্দ্রিক।
প্রাচীন রোমের মানুষদের সূর্যোদয়ের আগেই দিনের কাজকর্ম শুরু হয়ে যেতো রোমের বাসিন্দাদের। সেসময় যেহেতু বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিলো না তাই সূর্যালোক থাকতে থাকতেই নিজেদের সব কাজকর্ম শেষ করে ফেলতে চাইতো। আর তাই সাধারণ মানুষরা সাজগোজ করে পরিপাটি হওয়ার জন্য অযথা সময় ব্যায় করতো না।
রোমের সাধারণ মানুষেরা সকালের নাস্তায় তেমন কিছুই খেতো না। বেশিরভাগ মানুষই জল পান ছাড়া তেমন কিছু খেতো না। সকালে বেলা গোসল ও করতো না সেসব তারা বিকেলের জন্য রেখে দিতো। গোসলের জন্য রোমের মানুষজন পাবলিক স্নানাগার ব্যবহার করতো।
প্রাচীন রোমের রাস্তাঘাটে চলাচল করা ছিলো ভয়াবহ ব্যপার। রোম এতো দ্রুত বর্ধনশীল নগরীতে পরিনত হয়ে উঠেছিলো যে এতো এতো মানুষের গাড়িতে রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম লেগে থাকতো। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও সত্যি হাজার বছর আগেও জ্যাম নামক পীড়াদায়ক ব্যাপারটা ছিল।
রোমের রাস্তাগুলো ছিলো বেশিরভাগই কাঁচা ফলে একটু বৃষ্টি হলেই বেহাল দশা হয়ে যেতো। আর যানজট এড়াতে বেশিরভাগ মানুষই তাদের গাড়ি শহরের ফটকে রেখে পায়ে হেঁটে চলাচল করতো। জুলিয়াস সিজার তো ট্রাফিক জ্যামের ঝামেলা কমাতে আইনই করে দিয়েছিলেন শহরে সিনেটর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না।
বিকালের জীবন
রোমানরা খুব ভোর থেকে নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করে দুপুরের মধ্যেই নিজের দিনের কাজকর্ম প্রায় গুছিয়ে নিতো। আর বিকেলটা ছিলো তাদের আমোদ প্রমোদের জন্য বরাদ্দ।
রোমে তখন অবসর সময় কাটানোর জন্য দারুন সব আয়োজন ছিল। রোমের মানুষজন বিভিন্ন উপায়ে তাদের অবসর সময় কাটাতো। সে সময়ে রোমে পাবলিক থিয়েটার ছিলো সেখানে অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা নাটক অভিনয় করতো। হাজার হাজার মানুষ একসাথে বসে তা উপভোগ করতো। এছাড়া ঘোড়ার রেস কিংবা গ্ল্যাডিয়েটর্স গেমসের মতো উত্তেজনাকর খেলাও ছিলো রোমানদের বিনোদনের অন্যতম আয়োজন।
যেদিন থিয়েটারে কোনো নাটক কিংবা রেস ও গ্ল্যাডিয়েটর্স গেমস থাকতো না সেদিন রোমানরা ঘুরেবেড়িয়ে কিংবা জুয়া খেলে অবসর সময় পার করতো। অনেকে এসবের পরিবর্তে শরীরচর্চা, পাবলিক স্নানাগারে আরামদায়ক গোসল কিংবা আড্ডা মেরে সময় পার করতো।
পাবলিক স্নানাগার ছিলো রোমান সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে এসব গণস্নানাগার তৈরি হয়েছে শহরটিতে। প্লিনি দি এল্ডারের সময়ে রোমে মোট গণগোসলখানার সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার।
শিশুরা এসব গোসলখানায় গোসল বিনামূল্যে গোসল করতে পারত। প্রাপ্তবয়স্কদের আজকের দিনের হিসাবে ১০/২০ টাকার পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হতো। এসব গোসলখানায় গরম পানি, ঠান্ডা পানিতে গোসলসহ সুইমিং পুলেও গোসল করার ব্যবস্থা ছিল। অধিকাংশ গোসলখানার ভেতরেই বাগান, ঘুরে বেড়াবার জায়গা ও ব্যায়ামের জায়গা থাকত। রোমানরা কয়েক ধরনের খেলাধুলা করত। একধরনের টেনিসও ছিল তাদের খেলার তালিকায়। আর ছিল রাগবির মতো এক ধরনের বল খেলা।
শহরে কাটা নালা দিয়ে স্নানাগারে পানি নেওয়া হতো। আর পানি গরম করা হতো জটিল এক চুলায়। এ চুলা দেওয়ালে বা মেঝের নিচে লুকানো থাকত। এত সব সুযোগ-সুবিধার কারণেই রোমান নাগরিকরা গণগোসলখানায় এত বেশি সময় কাটাত।
প্রাচীন রোমের রাতের খাবার
সূর্য ডোবার পর রোমের গোসলখানাগুলো বন্ধ হয়ে যেত। যদিও অধিকাংশ রোমান তার আগেই গোসলখানা থেকে বেরিয়ে যেত। কাজেই রোমানরা রাতের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেত। রোমানদের জন্য দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবার ছিল রাতের খাওয়া। কেননা সকালের নাস্তায় তারা স্রেফ পানি আর দুপুরে খেত রুটি-পনির ও ঠান্ডা মাংস।
অভিজাত সমাজের লোকেরা এক থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত সময় নিয়ে আয়েশ করে রাতের খাবার খেত। বিলাসী সম্রাটদের আয়োজন করা ভোজসভা চলত মাঝরাত অবধি। কখনও কখনও ভোররাত পর্যন্তও চলত।
সচ্ছলরা রাতের খাবার খেত ডাইনিং রুমে। প্রাচীন রোমে ডাইনিং রুমে চেয়ার-টেবিল থাকত না, থাকত আরামদায়ক কাউচ। বর্গাকার খাবার টেবিলের চারধারে এসব কাউচ পাতা হতো। রোমানরা এসব কাউচে কাত হয়ে আরাম করে শুয়ে খাবার খেত।
প্রাচীন রোমানরা প্রায়ই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত দিত। খাওয়ার সময় অতিথিদের ছুরি-চামচ দেওয়ার চল ছিল। এসব ছুরি-চামচ দিয়ে খাওয়া হতো না, খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হতো। খাওয়ার কাজটা রোমানরা মূলত হাতেই সারত। এ কারণে তাদের খাবার কামড়ে খাওয়ার উপযোগী করে পরিবেশন করা হতো। তাছাড়া খাওয়ার আগে-পরে হাত ধোয়াটাকে প্রাচীন রোমান সমাজে সাধারণ ভদ্রতা হিসেবেই ধরে নেওয়া হতো।
বনেদি বাড়ির লোকজন কমপক্ষে সাত পদের খাবারের আয়োজন করত। ক্ষুধা বাড়ানোর খাবার, শুরুতে তিন পদ, দুটো রোস্ট আর শেষে এক পদের মিষ্টান্ন। মধু, পপি বীজ ও খেজুর থাকত খাবার তালিকায়। রোমান সমাজে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার ছিল রেড মুলেট মাছ। অত্যন্ত দামি এই সামুদ্রিক মাছ ধরতে গিয়ে কেউ কেউ তো মাঝেমধ্যে দেউলিয়াও হয়ে যেত।
রাতের খাবারের সময় রোমানরা নানা রকমের ওয়াইন পান করত। এসবের মধ্যে ছিল মধু-ওয়াইন এবং ধূপ ও পাইনের নির্যাসমিশ্রিত ওয়াইন।
রাতের রোম
অভিজাতরা বিলাস-ব্যসনের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠলেও সাধারণ রোমানরা সাদাসিধে জীবনযাপনকে গুরুত্ব দিত। পম্পেইয়ের এক বাসিন্দার বাড়ির দেওয়ালে লেখা ছিল: ‘প্রতিবেশীর স্ত্রীর কামার্ত ও দুষ্টুমিভরা চাউনিকে উপেক্ষা করো। কথাবার্তায় সজ্জন হও…বন্ধুবৎসল হও এবং সম্ভব হলে ঘৃণ্য ঝগড়াঝাঁটি থেকে বিরত থাকো। সম্ভব না হলে নিজের বাড়ি ফিরে যাও।’
এই বাড়ি ফিরে যাওয়া ধীরে-সুস্থে, নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে যাওয়া নয়। বিশেষ করে ভোজ-উৎসবের রাতগুলোতে তো নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরার জো-ই ছিল না। স্বাভাবিক সময়ে প্রাচীন রোম নগরীর ভোজোৎসবের রাতগুলো নামত মারাত্মক বিপদের ছায়া নিয়ে। এসব রাতে রোমের সবাই নিজের বাড়িতে গৃহবন্দি থাকত, দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। ব্যারিকেড বসাত বাড়ির ফটকে। দোকানপাটে নেমে আসত নিঝুম নীরবতা। দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে দেওয়া হতো।
ধনী রোমানরা দাওয়াত ভোজোৎসব থেকে ফিরত ক্রীতদাসদের সঙ্গে নিয়ে। দাসদের হাতে থাকত মশাল। বাকিদের অন্ধকারেই বাড়ি ফিরতে হতো। কারণ রাস্তায় কোনো তেলের প্রদীপ থাকত না। সিংহভাগ সাধারণ নাগরিকদের ছেড়ে দেওয়া হতো নগরের প্রহরীদের করুণার ওপর। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এসব প্রহরী নগরে টহল দিত। কিন্তু রোম ছিল বিশাল শহর, যার জনসংখ্যা ১ মিলিয়নের অধিক। এত বড় শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো যথেষ্টসংখ্যক প্রহরী রোমের ছিল না।
প্রাচীন রোমানদের দৈনন্দিন জীবন এখনকার দিনের ইউরোপিয়ান বা ইতালিয়ানদের চেয়ে একেবারেই আলাদা ছিল। পশ্চিমা দুনিয়া থেকে গণগোসলখানার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে বহু আগেই। তবে জাঁকজমকপূর্ণ ডিনার পার্টির চল রয়ে গেছে এখনও।
তথ্যসূত্র: দ্য বিজনেস স্টন্ড্যার্ড, এনসিয়েন্ট অরিজিন