আমি তখন ক্লাস ৪/৫ এ পড়ি, বাবা প্রায়ই পড়ার জন্য পত্রিকা (প্রথম আলো) নিয়ে আসতেন। পত্রিকা পত্রিকা পড়ার জন্য শুধু খেলার পাতাটাই তখন থেকে পড়তাম, এখন পর্যন্ত এটাই করে আসছি। তখন খেলার পাতা ছাড়া আর পড়তাম বিনোদন টা, কোন চ্যানেলে কোন প্রোগ্রাম কখন শুরু হবে সেটা দেখার জন্য।
পত্রিকা ঘাটাঘাটি করতে গিয়েই একদিন আমার চোখে পড়ে রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট!
কিসব অদ্ভুত ঘটনা সেখানে লেখা। পড়ে ভাবলাম আরে দারুণতো।
তখন রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট! এর এতোটাই ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি পত্রিকা কেটে কেটে ওগুলো রেখে দিতাম। আমার বাসার কাছেই একটা দেয়াল পত্রিকা ছিলো, যেদিন বাসায় পত্রিকা আসতো না সেদিন সেখানে চলে যেতাম পড়তে, এবার খেলার পাতাটা আমায় টানে নি টেনেছে রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট!
রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট! পড়তে গিয়ে প্রথম যে খটকা টা লেগেছিলো রিপলি’স নামটা নিয়ে। বিলিভ ইট অর নট না হয় বুঝলাম। কিন্তু এই রিপলি’স টা আবার কি?
সেসময় অবশ্য হাতের কাছে ইন্টারনেট ছিলো না আর আমার প্রশ্নের উত্তর ও দেবার মতো কেউ ছিলো।
এই প্রশ্নের উত্তরটা পেতে আমার লেগে গিয়েছে আরো ৫ বছর।
রবার্ট রিপলি
সারা বিশ্বে আজ যিনি রিপলি নামে পরিচিত সেটি আসলে তার বংশ পদবি। রিপলির পুরো নাম লেরয় রবার্ট রিপলি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা রোজা শহরে ১৮৯০ সালের কোনো এক দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তার জন্মের সঠিক মাস বা তারিখ কোনোটাই জানা যায় না। রিপলির বাবা আইজ্যাক রিপলি ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রী আর মা লিলি রিপলি ছিলেন গৃহিণী। দরিদ্র পরিবারেই বেড়ে উঠেন রবার্ট রিপলি।
রবার্ট রিপলি ছোট বেলা থেকেই ছিলেন খুব শান্ত শিষ্ট ও লাজুক ধরনের। চুপচাপ থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। তবে ভ্রমণের নেশা ছিলো অতি মারাত্মক। একবার ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে জাগলে আটকে রাখা ছিলো খুবই মুশকিল।
রবার্ট রিপলি স্কুলে যেতে শুরু করেন ছোট বয়স থেকেই। পড়াশোনায় তিনি খুবই ভালো ছাত্র ছিলেন তাই অল্পদিনেই সকল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে রিপলি প্রিয় হয়ে উঠেন। পড়াশোনার পাশাপাশি রিপলি দারুণ আঁকতে পারতেন আর সেই সাথে বেসবল খেলাটা দারুণ খেলতে পারতেন। স্কুলে তিনি বেসবল দলের সেরা প্লেয়ার ছিলেন। সম্ভাবনা ছিলো বেসবল দিয়েই জীবনে উন্নতি করার। কিন্তু ভাগ্য বিধাতা হয়তো তা চাননি। হঠাৎ একদিন খেলতে গিয়ে ডান হাতে মারাত্মক চোট পান। রিপলির বেসবল এর সম্ভাবনার ও সমাপ্তি সেখানে।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো, রিপলির উপর সবচেয়ে বড় ঝড়টা আসে ১৯০৫ সালে যখন রিপলির বাবা আইজ্যাক রিপলির মৃত্যু হয়। আর্থিক সংকটের কারনে রিপলি স্কুলের পড়াশোনার ইতি টানেন।
বইপত্র ছেড়ে রবার্ট রিপলি হাতে তুলে নেন দৈনিক পত্রিকার বান্ডিল। সকাল সকাল তিনি সেসব পত্রিকা এখানে সেখানে ছুটোছুটি করে তা বিলি করতেন। তবে এতো ছুটোছুটির মাঝেও রবার্ট রিপলি আঁকাআকি ছাড়েন নি, ওটা ছিলো তার নেশা। আর আঁকার হাতটাও ছিলো যে দারুণ। পত্রিকা বিলি করতে করতে সংবাদপত্রের অনেকের সাথেই রিপলির ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। রিপলি বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিজের আঁকা পাঠাতে থাকেন। ১৯০৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রিপলির আঁকা অনেক কার্টুন ও ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে শুরু শুরু করে।
১৯১৩ সাল, রবার্ট রিপলি তখন ২৪ বছরের টগবগে যুবক, সান্তা রোজার মতো ছোট্ট শহরে পড়ে থাকলে তার চলবে না। এবার কার্টুনিস্ট হিসেবে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারি জমান প্রত্যেক আমেরিকানদের স্বপ্নের শহর নিউ ইয়র্কে।
রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট এর যাত্রা
নিউইয়র্ক শহরে এসেই রিপলির চাকরি জুটে যায় ‘The Globe’ পত্রিকার। গ্লোব পত্রিকায় রিপলি স্পোর্টস বিষয়ক কার্টুন আকাঁআকি করতেন। বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর রিপলি একই ধরনের কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এবার তিনি তার কাজে অদ্ভুত পরিবর্তন আনেন। রিপলি ক্রিয়াবিষয় অদ্ভুত রেকর্ডের ছবিগুলোর কার্টুন আঁকেন আর তার সাথে ছোট্ট করে সেসব কার্টুনে তথ্য লিখে দেন। রিপলি এবার এই ফিচারটির নাম দ্যান ‘Champs and Champs’, গ্লোগ পত্রিকায় এই ফিচার প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে তা সারা ফেলে দেয়। এরপরই রিপলির উপরে উঠা শুরু। বেশ কয়েক মাস এই ফিচার নিয়ে কাজ করার পর রিপলির মাথায় আসে শুধু স্পোর্টস এর অদ্ভুত তথ্য ছাড়াও তো আরো বিভিন্ন সব অদ্ভুত তথ্য পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আসে সেগুলো নিয়ে একটা ফিচার বানালে কেমন হয়?
রিপলির আইডিয়ার কথা শোনে গ্লোব পত্রিকার সম্পাদক সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান। রিপলি এবার সংগ্রহ করতে নেমে পড়লে মানুষের অদ্ভুত সব ঘটনা ও তথ্য সংগ্রহ করতে। কিছুদিন পরই রিপলি তার বিখ্যাত ‘বিলিভ ইট অর নট! এর ফিচার বের করেন। এই ফিচার তখন পাঠকদের গ্লোব পত্রিকার প্রতি আগ্রহ মারাত্মক বাড়িয়ে দেয়। প্রথম দিকে এই ফিচারটি কয়েক মাস পর পর বের হতো। নিউ ইয়র্ক শহরের পাঠক সমাজে বাড়তি চাপ দিতে থাকে নিয়মিত এর ফিচার প্রকাশ করতে।
কিন্তু নিউইয়র্ক শহরে বসে থেকে তো আর সেসব তথ্য জোগাড় করতে পারবেন না। তার জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের প্রয়োজন। আর এই উদ্দেশ্যে ১৯২২ সালে ‘দ্য গ্লোব’-এর অর্থায়নে রবার্ট সর্বপ্রথম তার ফিচারের তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিশ্বভ্রমণে বের হন।
এর মাঝেই ১৯১৯ সালে রবার্ট রিপলির মার্কিন অভিনেত্রী Beatrice Roberts এর সাথে রবার্ট এর প্রণয় হয়। Beatrice Roberts তখন ছিলেন মাত্র ১৪ বছরের কিশোরী, রিপলির থেকে প্রায় ১৫ বছরের ছোট। রিপলির Beatrice Roberts এর সাথে সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় নি সম্পর্কের ৭ বছরের মাথায় তাদের বিচ্ছেদ হয়।
গ্লোবে প্রায় দীর্ঘ ১ যুগের বেশি সময় কাজ করার পর ১৯২৬ সালে রিপলি ‘Evening Post’ পত্রিকাতে চাকরির অফার পান, তাও বিশাল পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। রিপলি তখন অনেক বিখ্যাত হয়ে গেছেন। সারা দেশ ও দেশের বাহিরেও তার অসংখ্য ফ্যান। নিজের ডাকবক্সে প্রতিদিন শতশত শুভাকাঙ্ক্ষীদের চিঠি পেতেন।
এতো এতো শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভেতরে রিপলির নিন্দুকের সংখ্যা ও কম ছিলো না। একশ্রেণীর লোক ছিলো যারা বলে বেড়াতো রিপলির এসব অদ্ভুত ফিচার সমাজের জন্য একদম অনপুযুক্ত খবর। তবে রিপলি তাদের কথায় একদম কান দেন নি।
১৯২৯ সালে কিং ফিচার সিন্ডিকেট নামক একটি সংস্থা রিপ্লিকে সমসাময়িক কর্মীদের তুলনায় বেশ মোটা অংকের সম্মানী প্রদান করে নিজেদের দলে ভেড়ায়। এর ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হলেন রিপলি। ফলে তার বিলিভ ইট অর নট মাত্র একটি বা দুইটি পত্রিকার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলো না। সারাদেশের শত শত পত্রিকায় রিপলির বিলিভ ইট অর নট ফিচার প্রকাশওত হতে লাগলো।
এই বছরেই রিপলি তার এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়া ফিচার গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ভালো তথ্য গুলে নিয়ে ‘Believe it or not’ নামে একটি বই প্রকাশ করে ফেলেন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তা ৫ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে যায়।
রবার্ট রিপলির কালজয়ী ফিচার
১৯২৯ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখ, তখন রিপলির বিলিভ ইট অর নট ইতিমধ্যে পুরো দেশে সারা ফেলে দিয়েছে। পত্রিকা পাঠ করতে বসা সকল পাঠকের কেন্দ্রীয় আকর্ষণীয় বিষয় থাকে রিপলির বিলিভ ইট অর নট ফিচার।
সেদিন মার্কিনিরা রিপলির বিলিভ ইট অর নট ফিচার দেখে আতৎকে উঠেন।রিপলি তার এই ফিচারে যেনো আস্তো একটা বোমা ফাটিয়ে দিয়েছেন। রিপলি তার ফিচারে লিখেছেন।
“বিশ্বাস করুন বা না করুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, যার কোনো জাতীয় সঙ্গীত নেই!”
The Star-Spangled Banner নামক যে গানটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তা অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গীত হিসেবে বিখ্যাত ছিল। কিন্তু কংগ্রেস তখনও সেই গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। তাই রিপ্লির ফিচারের প্রতিবাদ করার মতো কোনো যুক্তি ছিল না রাজনীতিবিদগণের নিকট। দুয়েকদিন এদিক ওদিক কানাঘুষা চলার পর ব্যাপারটি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হার্বার্ট হুভারের কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। ওদিকে জনগণ একটি জাতীয় সঙ্গীতের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন সমাবেশ কর্মসূচি পালন করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রগতিশীল দেশের নাগরিক হয়ে কিনা কোনো জাতীয় সঙ্গীত নেই তাদের!
শেষ পর্যন্ত দুই বছরের জল্পনা-কল্পনা শেষে ৩ মার্চ, ১৯৩১ তারিখে রাষ্ট্রপতি The Star-Spangled Banner-কে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি প্রদান করেন।
রেডিও ও টেলিভিশনে বিলিভ ইট অর নট!
বহু বছর পত্রিকায় আঁকাআকির পর রিপলি ভাবলেন এবার এটাকে একটু আধুনিকতার ছোঁয়া দেয়া যাক। আর তাই রিপলি তার অদ্ভুত কাণ্ড কাহিনী নিয়ে হাজির হলেন বেতার অফিসে।
১৯৩০ সালে নিউইয়র্ক বেতার রিপলির উপস্থাপনায় ‘বিলিভ ইট অর নট’ নামক একটি নতুন ধারার তথ্যবহুল বিনোদন অনুষ্ঠান প্রচার করা শুরু করে। বেতারেও সফলতা পেলেন তিনি। তারপর টোয়েন্থিথ সেঞ্চুরি ফক্সের পরিবেশনায় রিপ্লি তার ফিচারকে রূপালি পর্দায় চিত্রায়িত করার প্রয়াস নিয়ে তৈরি করেন বেশ কয়েকটি শর্ট ফিল্ম। রিপ্লির জনপ্রিয়তা বিভিন্ন গণমাধ্যমের বদৌলতে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো। আর সেই সুবাদে কিং সিন্ডিকেট রিপ্লির সাথে দ্বিগুণ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে নেয়।
রিপলির মিউজিয়াম
এতো কিছু করার পরেও রিপলি থেমে যান নি, তার মাথায় এলো নতুন আরেক বুদ্ধি। মানুষ পত্রিকার ফিচার পড়ে কতটুকুই বা জানতে পারে? এর চাইতে কেমন হয় যদি সেসম অদ্ভুত মানুষ ও জায়গা গুলোর সাথে যদি তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়!
আর তাই রিপলি তার সকল সংগ্রহ দিয়ে ৭ টি বিশাল সংগ্রহশালা তৈরি করেন। আর সেই সংগ্রহ শালার নাম দেন ‘Odditorium’ ইংরেজি Odd শব্দের অর্থ অদ্ভুত আর সেজন্যই এমন নাম দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৩৩ সালের শিকাগো বিশ্ব মেলাতে সর্বপ্রথম রিপ্লির সংগ্রহশালার উদ্ভোধন করা হয়। সারাবছর দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন বলে সমালোচকরা তাকে ‘আধুনিক যুগের মার্কো পোলো’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অডিটোরিয়াম, পত্রিকা, বেতার এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার আয়ের ফলে রিপ্লি খুব দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। ব্যক্তিগতভাবে শৌখিন রিপ্লি এবার নিউ ইয়র্কের উত্তরে একটি দ্বীপ ক্রয় করে ফেলেন। এর ফলে অনেকেই বিস্মিত হয়ে পড়ে।
রিপলির আকস্মিক মৃত্যু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভ্রমণ প্রিয় রিপলির বিশ্বভ্রমণে ব্যাঘাত ঘটে। নিজের কেনা দ্বীপে বন্দী থেকে তিনি যেনো একদম পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন। আর তাই তার স্বাস্থ্য তখন খুব খারাপ হয়ে যায়। অবশ্য বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি একদমই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। স্টুডিওতে নিয়মিত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে যাচ্ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালের মে মাসের ২৪ তারিখ ‘বিলিভ ইট অর নট’এর ১৩তম পর্বের রেকর্ড চলাকালীন অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু রিপ্লির সময় তখন শেষ। টানা তিনদিন চিকিৎসা শেষে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পিতামাতার সমাধির পাশেই সমাধিত হন এই কিংবদন্তি।