ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবিদের মধ্যে তিনি একজন। তার কবিতা পাঠ করতে গেলে পাঠকদের প্যাচপ্যাচে তুষার, জোনাকি পোকা কিংবা হেমলকের ডাল থেকে খসে পড়া বরফের দেশে হারিয়ে হারিয়ে যেতে হয়। তিনি আর কেউ নন চারবার পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী কবি রবার্ট ফ্রস্ট।
কবিতার রঙতুলিতে ইংরেজি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা এই কবির জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে একাকীত্ব, বেদনাবোধ, সাংসারিক ও পারিবারিক জীবনের হতাশার মাঝে।
সময়টা ১৮৭২ সাল সাংবাদিক প্রেফকট ফ্রস্ট ভালোবেসে বিয়ে করেন সাহিত্যপ্রেমী ইসাবেল মুডিকে। ইসাবেল বেশ ভালোই লিখতে পারতেন কবিতা, কবিত্বের সহজাত গুণখানা রবার্ট ফ্রস্ট হয়তো তার মায়ের থেকেই পেয়েছিলেন।
১৮৭৪ সালের ২৬ মার্চ তাদের ঘর আলোক করে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান। বাবা মা খুব খুশি সেই শিশুকে নিয়ে। কিন্তু শিশুর নামকরণে দেখা দিলো বিভ্রান্তির। সাহিত্য অনুরাগী মা ছেলের নাম রাখতে চাইলেন বিশ্বখ্যাত কবি বিশ্বখ্যাত কবি রবার্ট বার্নসের নামানুসারে। অন্যদিকে মায়ের দেয়া এমন নাম মনঃপূত হলোনা বাবা উইলিয়ামের। বাবা চাইলেন জননন্দিত ব্যক্তিত্ব জেনারেল লি এর নামের অনুকরনেই রাখা হবে নবজাতকের নাম। সবশেষে, দুজনের নামের প্রতিই শ্রদ্ধা রেখে এই শিশুর নাম রাখা হয় রবার্ট লি ফ্রস্ট। অবশ্য, এ শিশুটিই পরবর্তীতে পৃথিবী জুড়ে পরিচিত হন রবার্ট ফ্রস্ট হিসেবে।
রবার্ট ফ্রস্ট নিজেকে খুব গর্বের সাথে একজন নিউ ইংল্যান্ডের অধিবাসী দাবী করলেও রবার্ট ফ্রস্টের জন্ম হয়েছিলো সানফ্রানসিসকোয়। রবার্টের বাবার পূর্বপুরুষরা ‘মেইন এন্ড নিউ হ্যাম্পাশায়ার’ এ বাস করতেন। ফ্রস্টের বাবা উইলিয়াম ফ্রস্ট হাভার্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে এবং শিক্ষকতাকে পেশা করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। সেই সাথে স্ত্রী ইসাবেলা মুডিকে নিয়ে পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছেড়ে সানফ্রান্সিসকোতে থিতু হন। সানফ্রানসিসকোতেই শৈশব কাটছিলো রবার্টের। বলা যায় খুব ভালোভাবেই কাটছিলো। কিন্তু সুসময় কবির জীবনে খুব বেশীদিন স্থায়ী হলোনা। বাবা উইলিয়ামের মৃত্যু কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তার জীবনের গতিপথ এলোমেলো করে দিল,১৮৮৫ সালে ক্ষয়রোগে মৃত্যুবরণ করেন তার বাবা উইলিয়াম ফ্রস্ট। কবির বয়স তখন মাত্র ৯! বাবার মৃত্যুর পর রবার্ট ফ্রস্ট ও তার মা দাদা-দাদির ভিটে নিউ হ্যাম্পশায়ারে ফিরে আসেন।
সাহিত্য জীবন
নিউ হ্যাম্পশায়ারে আসার পর কবি রবার্ট ফ্রস্ট আবর্তিত হতে থাকেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে। বাবা মায়ের কোলে বেড়ে উঠা আদরের ছোট্ট ছেলেটি কখনো হয়েছেন দিনমজুর, কখনো জুতার দোকানের কর্মচারী কিংবা কখনো কারখানার শ্রমিক। আবার কখনো বা ঠেলেছেন পশমের ববিন বোঝাই গাড়ি। তবুও থেমে থাকেনি কবির সাহিত্য সাধনা। জীবনসংগ্রাম থেকে প্রাপ্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা চিত্রায়িত করেছেন তার কবিতার অসামান্য লাইনগুলোতে। জীবনের প্রথম দিককার কবিতাগুলোয় ভেসে উঠেছে নিউ হ্যাম্পাশায়ারের পথ, ঘাট, প্রকৃতি। তার কবিতায় ফুটে উঠেছে শরতের পাতা ঝরা রঙ ঝলমলে দিন, গ্রীষ্মের আলোকিত লম্বা দুপুর।আর বসন্তের সন্ধিক্ষণে পরিযায়ী পাখিদের ফিরে আসার গল্প।
তার এই সাহিত্য সাধনার শুরুর দিকে চরম বাধার সম্মুখীন হন তার আশেপাশের বন্ধুদের দ্বারা। উপহাসের পাত্র হয়েছিলেন বহুবার।
একবার দ্য আটলান্টিক মান্থলি নামে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ রবার্টের কবিতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন (!) এই বলে যে, ‘মাসিক আটলান্টিক’-য়ে এসব কবিতার স্থান নেই। তখন রবার্ট খুব দুঃখ পেয়েছিলেন।
রবার্ট ফ্রস্টের প্রথম দুটি কবিতা প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালে, তার স্কুলের ম্যাগাজিনে (বয়স তখন তার ১৬)।
প্রথম কবিতার নাম ছিলো ‘লা নচে ট্রিস্ট’ আর দ্বিতীয়টির নাম “দ্যা সং অব দ্যা ওয়েভ”। পরের বছর ঐ স্কুল ম্যাগাজিনের ইডিটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ফ্রস্ট। স্কুল জীবন শেষ করে হাবার্ট কলেজে ভর্তি হন ফ্রস্ট। তবে অর্থনৈতিক দুর্দশায় কলেজ ছাড়তে হয় তাকে। এরপর ১৮৯২ সালে ডারমাউথ কলেজে ভর্তি হন তিনি। এসময় তার স্কুল জীবনের সহপাঠিনী এলিনর মেরিয়ামকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হন। ডারমাউথ কলেজে থাকাকালীন মেথুয়েনের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি।
১৮৯৪ সালের মার্চে ‘দি ইনডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকায় তার কবিতা ‘মাই বাটারফ্লাই’ এবং ‘এ্যান এলিজি’ প্রকাশিত হয়। বিনিময়ে তিনি ১৫ডলার সম্মানী পান। এই অর্জিত অর্থ দিয়ে তিনি ‘টোয়াইলাইট’বইয়ের দুটি কপি প্রকাশ করেন। তার একটি কপি তিনি প্রাণপ্রিয় এলিনরকে উপহার করেন। ভাগ্যের পরিহাস এমন হলো যে, এলিনর বইটি ছুড়ে ফেলে দেন। এঘটনার পর রবার্ট মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পরেন যে, তিনি সেই স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
এতসব নাটকীয়তার শেষে ১৮৯৫ সালের ১৯ডিসেম্বর লরেন্সে এলিনরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রবার্ট। ১৮৯৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তাদের প্রথম সন্তান ইলিয়টের জন্ম হয়। যদিও কয়েক বছর পরই তাদের এই সন্তান মৃত্যুবরণ করে। ১ম সন্তানের মৃত্যুতে তার স্ত্রী এলিনর প্রবল মানসিক আঘাতে ভেঙে পরেন। আর এর ফলে রবার্টের স্বাস্থ্যেরও চরম অবনতি ঘটে। সে বছরের ২ নভেম্বর তার মাও মৃত্যুমুখে পতিত হন । মা ও সন্তানের শোক কাটাতে না কাটাতেই পরের বছর তার দাদাও পাড়ি জমান পরপারে।
এসব ঘটনা রবার্টের জীবনের স্বাভাবিক গতি একেবারেই মন্থর করে ফেলে। তাই হয়তো এসময়ে নিজেকে একটি নীল পাখির সাথে তুলনা করে লিখেছিলেন,
“I have wished a bird would fly away,
And not sing by house all day;
Have clapped my hands at him from the door,
When it seemed as if I could bear no more.
The fault must partly have been in me,
The bird was not to blame for his key.
And of course there must be something wrong,
In wanting to silence my song.”
সবশেষে ১৯১২ সালে তিনি সপরিবারে ইংল্যাণ্ডে চলে আসেন এবং লোখালেখিতে মনোযোগ দেওয়া শুরু করেন। ১৯১৩ সালে ‘এ বয়েজ উইল’ নামে তার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ বইটি রবার্টকে সেসময়ের খ্যাতি প্রাপ্ত লেখকদের সান্নিধ্যে আসতে সাহায্য করে । এরপরের বছর মে মাসে তিনি “নর্থ অব বোস্টন” নামে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই বইটি কবিকে জগৎজোড়া খ্যাতি দেন। সেসময়ের বিখ্যাত সব পত্রপত্রিকায় আলোচনা সমালোচনা করা হয় তার বইটিকে নিয়ে। এসময় কবির বন্ধু টমাস তাকে আরো বেশী করে কবিতা লিখতে পরামর্শ দেন।
তবে দুঃখের বিষয়, এসময় বিশ্বের বুকে নেমে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া । যে ছায়া থেকে পালাতে পারেননি কবি রবার্ট ফ্রস্টও। ইংল্যান্ডের তৎকালীন সরকার তাকে আমেরিকার গোপন গোয়েন্দা হিসেবে সন্দেহ করেন।
ফলে পরের বছর ১৯১৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি ফ্রস্ট চলে যান নিউওয়ার্কে। সে বছরের ২০ফেব্রুয়ারি তার লিখিত “নর্থ অব বোস্টন” পুনরায় প্রকাশিত হয় । এরপর ১৯১৬সালে রবার্ট প্রকাশ করেন- ‘মাউন্টেন ইন্টার্ভাল’ নামের একটি গ্রন্থ। একই বছরেই তিনি আর্মহাস্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯১৭ সালে তিনি আর্মহাস্টে স্থানান্তর হন। তবে আর্মহাস্টে তার কর্মজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কলেজ কমিটির সাথে মতবিরোধের কারন হেতু ১৯২০সালে ঐ কলেজ হতে ইস্তফা নেন রবার্ট। ১৯২১সালের মার্চে কুইন্স ইউনিভার্সিটি তাকে ‘পোয়েট ইন রেসিডেন্স’ মনোনীত করে। এবছরই মিসিগান ইউনিভার্সিটি থেকে ফেলোশিপ পান।
১৯২৩ সাল ছিলো রবার্টের সাফল্যের স্বীকৃতি পাওয়ার বছর । সে বছর তিনি ডারমণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে LHD পুরষ্কার লাভ করেন। এসময় রবার্ট পুনরায় তার পূর্বের কর্মস্থল আর্মহাস্ট কলেজে নিযুক্ত হন। সেখানে তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছিলেন, ১৯২৩ সালে কোয়ান্টাম মেথডের জন্য নোবেল প্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর। সে বছরই তিনি প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘নিউ হ্যাম্পাশায়ার’ । যেটি ১৯২৪ সালে তাকে পুলিৎজার পুরষ্কার এনে দেয়। পুলিৎজার পাওয়ার পরপরই মিডিলবুরি কলেজ ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রী প্রদান করে। মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে পান আমরণ ফেলোশিপ।
১৯২৮ সালে রবার্টের ছোট বোন জিনি মৃত্যুবরণ করলে, আবারও তিনি মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙ্গে পরেন। এর দুবছর পর ১৯৩০ সালে ‘কালেক্টেড পয়েমস’ প্রকাশিত হয়। এ বইটির জন্য ১৯৩১ সালে পুনরায় পুলিৎজার পুরষ্কার লাভ করেন। এরপর ১৯৩৪সালে তার কণ্যা মার্জরি মৃত্যুবরণ করলে, দারুন শোকাহত হন রবার্ট। ১৯৩৬ সালে শোকাভূত কবি লিখে ফেললেন ‘এ ফার্দার রেন্জ’ নামক একটি গ্রন্থ। যা পরের বছর তাকে ৩য় বারের মতো পুলিৎজার পুরষ্কার এনে দেয়। সাথে সাথে তাকে আমেরিকান ফিলোসফিকাল সোসাইটির সদস্য করা হয়।
১৯৩৯ সালে তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব আর্টস এন্ড লেটারস এর থেকে নিউইয়র্ক স্বর্ণপদক পান। এবছরই মে মাসে তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ রালফ ওয়ালডো এমার্সন ফেলো’ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪২ সালে প্রকাশ করেন ‘A winter age’ নামের একটি কাব্যগ্রন্থ। মাত্র দু মাসেই বইটি প্রায় দশ হাজার কপি বিক্রি হয় এবং বইটি তাকে ৪র্থ বারের মতো পুলিৎজার পুরষ্কারে ভূষিত করে।
রবার্ট ফ্রস্ট নোবেল কেনো জিতেন নি?
গত শতাব্দীতে যেসকল সাহিত্যিকদের নোবেল না পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠে তাদের মধ্যে রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের পরেই রবার্ট ফ্রস্টের নাম আসবে।
সর্বোচ্চ ৪ বার (১৯২৪,১৯৩১,১৯৩৭,১৯৪৩) পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি জেতা কবি নোবেল পাননি এটা সবাইকে অবাক করে। অবশ্য ৪ বার পুলিৎজার জয়ী তিনি একা নন। মার্কিন লেখক Eugene O’Neill ও ৪ বার পুলিৎজার জিতেছেন। তবে তার নোবেল পুরষ্কার জয় মিস হয়নি, তিনি ১৯৩৬ সালে নোবেল জিতেছিলেন।
রবার্ট ফ্রস্ট তার পুরো জীবনে সর্বমোট ৩১ বার নোবেল পুরষ্কার এর জন্য নমিনেশন পেয়েছেন যা Bertrand Russell এর পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ৪৭ বার নমিনেশন পাওয়া Bertrand Russell অবশ্য ১৯৫০ সালে এসে নোবেল পেয়েছিলেন।
১৯৬১ সালে রবার্ট ফ্রস্ট কে নোবেল নমিনেশন এর তালিকা থেকে নাম বাদ দেয় নোবেল কমিটির জুরিরা এই বলে যে সে অনেক বয়ষ্ক। তখন রবার্ট ফ্রস্টের বয়স ৮৬! অবশ্য পরবর্তীতে রবার্ট ফ্রস্টের মতো বয়স কারো জন্য বাধা হয়ে দাড়ায় নি। ২০০৭ সালে সরিস লেসিং ৮৭ বছর বয়সে এসে নোবেল জিতেছিলেন।
নোবেল কমিটি সবসময় জনপ্রিয় লেখকদের নোবেল পুরষ্কার দেয়া থেকে গা এড়িয়ে চলেছেন সবসময়। নোবেল পেলে হয়তো তারা আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে যাবেন।
নোবেল হয়তো পান নি! তবে পাঠকদের ভালোবাসা পেয়েছেন প্রচুর। যতকাল সাহিত্য রবে তিনি ততকাল সাহিত্য প্রেমীদের মনে থাকবেন।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া,প্রথম আলো, ব্রিটনিকা এনসাক্লোপিডিয়া
আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি