রাজকীয় ক্ষমতা, বিলাসবহুল জীবন উপভোগ আর বিনোদনের চাকচিক্য আমাদের আকর্ষিত করে। কিন্তু সেই ক্ষমতা আর প্রাচুর্যে নেই কোনো সুখ কিংবা শান্তি। আছে শুধু ভয়, আতংক আর অশান্তি।
ইতিহাসের তেমনই ৩ জন রাণীর দূর্ভাগ্য নিয়ে জানাবো। যাদের জীবনে সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, এ-ই সকল মহিলাদের জীবনের শেষ পরিণতি ছিলো ভয়াবহ।
স্কটল্যান্ডের রাণী ম্যারি
মেরি, স্কটসের রানী ১৫৪২ সালের ডিসেম্বরে জেমস-৫ম এর মৃত্যুর পর স্কটল্যান্ডের নতুন রাণী হয়েছিলেন। কিন্তু মেরির বয়স তখন মাত্র এক সপ্তাহ ছিল, রিজেন্টরা (তার মা সহ) স্কটল্যান্ডে শাসন করেছিল যতক্ষণ না সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়।
কিন্তু ব্যপারটা এতোটাও সহজ ছিল না। যখন এলিজাবেথ প্রথম (যিনি একজন প্রোটেস্ট্যান্ট ছিলেন) ১৫৫৮ সালে ইংল্যান্ডের রানী হন, তখন ইংরেজ ক্যাথলিকরা এলিজাবেথের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। তারা চেয়েছিল যে মেরি এলিজাবেথের কাছ থেকে সিংহাসন গ্রহণ করুক এবং ক্যাথলিক রাণী হিসেবে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড শাসন করুক।
রাণী প্রথম এলিজাবেথ, ক্যাথলিকদের কাছে মেরির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন, আর তাই তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১৯ বছরের জন্য বন্দী করেছিলেন। মেরি কে সেই সময়টায় কঠোর তত্ত্বাবধান ছাড়া বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। দীর্ঘকাল কোনো শরীরচর্চা ও হাঁটাচলা না করার কারনে তিনি অল্পবয়সেই গুরুতর বাত রোগে ভুগতে শুরু করেন।
১৫৮৬ সালে ব্যাবিংটন প্লট উন্মোচনের পর (রানীকে হত্যা করার এবং মেরিকে সিংহাসনে বসানোর ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের পরিকল্পনা), এলিজাবেথ জানতেন তখন তার কী করা দরকার। দীর্ঘ সাড়ে ১৮ বছর বন্দী থাকার পর ১৫৮৬ সালে তাকে এলিজাবেথকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং পরবর্তী বছর ফোদারিংহে ক্যাসলে তার শিরশ্ছেদ করা হয়।
আন্সবাখের রাণী ক্যারোলিন
অ্যান্সবাখের রানী ক্যারোলিন ছিলেন রাজা জর্জ দ্বিতীয় এর স্ত্রী, ব্রিটিশ রাজা জর্জ দ্বিতীয় ১৭২৭ থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তার স্বামী তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাজ্যের রিজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছিলেন।
ক্যারোলিনের সারা জীবন ধরে অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল, যার মধ্যে গাউট, অ্যাগ এবং প্লুরিসির মতো রোগ ছিলো। তবে রাণী ক্যারোলিনের সবচেয়ে বড় শারীরিক সমস্যার শিকার হন, যখন রাজকুমারী লুইসাকে জন্ম দেওয়ার সময়, রাণী ক্যারোলিনের নাভি ফেটে যায়। রাণীর এই ক্ষতটি কখনই নিরাময় হয়নি এবং সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হয়েছে।
চিকিৎসকরা ক্ষতটি ঠিক করার জন্য সমস্ত ধরণের প্রতিকার ব্যবহার করেছেন, যেমন ইমেটিক্স এবং অ্যাপিরিয়েন্টস। কোনোভাবেই নিরাময় না হওয়ায় চিকিৎসকরা সর্পগন্ধা (একধরনের উদ্ভিদ) ও ড্যাফি’স এলিক্সির (পেটের রোগের ঔষধ) মতো ঔষধীয় উপাদান ব্যবহার করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
যেহেতু সেসময় কোনো চেতনানাশক আবিষ্কৃত হয়নি তাই চিকিৎসকরা কোনো চেতনানাশক ছাড়াই রাণী ক্যারোলিনপর নাভীর পঁচে যাওয়া মাংস কেঁটে ফেলার চেষ্টা চালান। কোনো প্রকার চেতনানাশক ছাড়া শরীরের মাংস কাঁটার জন্য তার প্রচন্ড যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, তবুও রাণী ক্যারোলিন কে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
১৭৩৭ সালের ২০ শে নভেম্বর রাণী ক্যারোলিন তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাজা দ্বিতীয় জর্জ রাণী ক্যারোলিনের মৃত্যুতে এতোটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে তিনি আর কখনও বিয়ে করেননি।
ফরাসী রাণী মারি অঁতোয়ানেত
১৭৫৫ সালে অস্ট্রিয়ায় মারি অঁতোয়ানেতের জন্ম হয়েছিল। এর ঠিক ১৫ বছর পরে, তিনি ফ্রান্সের প্রিন্স লুইকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি পরবর্তীতে ফরাসি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। ১৭৭৪ সালে তরুণ এই দুই দম্পতি ফ্রান্সের রাজা ও রাণী হয়েছিলেন।
মারি অঁতোয়ানেত প্রথমদিকে ফ্রান্সে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি একজন রাজকীয় সোশ্যালাইট ছিলেন যিনি পার্টি, নাচ এবং জুয়া উপভোগ করতেন এবং তার অসামান্য ডিজাইনের পোশাক ফ্রান্সের অন্যান্য উঁচুশ্রেণীর মহিলাদের মধ্যে ফ্যাশন ট্রেন্ডের সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু হঠাৎই ফরাসি বিপ্লব রাণী মারি অঁতোয়ানেতের জীবন পাল্টে দেয়। ফরাসী বিপ্লব সফল হলে বিদ্রোহীরা ১৭৯৩ সালের ১৫ই জানুয়ারি রাজা লুইকে বিচারের মুখোমুখি করেন। বিচারে রাজা লুইকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এর ঠিক ৬ দিন পর রাজার মাথা শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
১৭৯৩ সালের অক্টোবর মাসে মারি অঁতোয়ানেত এর বিচার করা হয়েছিল। বিচারের সময় রাণীর চেহারা দেখে দর্শক হতবাক হয়ে যায়। কিছু বছর আগেও যার রাজকীয় চাকচিক্যে সাধারণ মানুষের মাথা ঘুরে যেতো, আজ তার এ কি হাল! দীর্ঘ আড়াই বছর জেলে থাকার ফলে রাণী মারি অঁতোয়ানেত এর চুল ধূসর হয়ে গিয়েছিল এবং তার গালগুলি শুকিয়ে হাড়ের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল।
বিচারে রাণী মারি অঁতোয়ানেত কেও তার স্বামী লুই এর মতোই মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। যেদিন মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল, মৃত্যুদন্ডের ঠিক আগ মুহূর্তে উপস্থিত সাধারণ জনতা চিৎকার করে তাদের সাবেক রাণীকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। এরপর জল্লাদ তার বিশাল তরবারি দিয়ে রাণীর শিরশ্ছেদ করেন। রক্তের চারপাশ ভেসে যায়, আর সেই সাথে রাণীর মৃত্যু নিশ্চিত হয়।