You are currently viewing রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ: রাণী এলিজাবেথের সম্পর্কে ১০ টি অজানা তথ্য

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ: রাণী এলিজাবেথের সম্পর্কে ১০ টি অজানা তথ্য

৭০ বছর রাজত্ব করার পর ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাজশাসক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ স্কটল্যান্ডের ব্যালমোরাল প্রাসাদে মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।

রানি এলিজাবেথ ১৯৫২ সালে সিংহাসনে আসীন হন এবং তার জীবদ্দশায় বিশাল সামাজিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে ছিলেন।

কিশোরী রাণী এলিজাবেথ Image credit: Town and cuntry Magazine

সারাবিশ্বে যে কয়জন নারী শাসক ছিলেন তার মধ্যে রাণী এলিজাবেথ অন্যতম। আর সদ্য প্রয়াত রাণী এলিজাবেথ সম্পর্কে ১০ টি অজানা তথ্য জানাবো, যা হয়তো আপনি আগে শুনেন নি!

এক প্রকার অপ্রত্যাশিতভাবে রাণী হয়েছিলেন এলিজাবেথ

দ্বিতীয় এলিজাবেথের রানী হওয়ার কথাই ছিলো না। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে তার অবস্থান ছিলো পিতৃব্য অষ্টম এডওয়ার্ড এবং পিতা ষষ্ঠ জর্জের পরে। কিন্তু রাজপরিবারের একটি ঘটনা সকল সমীকরণ পাল্টে দেয়।

তরুণী রাণী এলিজাবেথ Image credit: Harper Bazar

বিপত্নীক নারী ওয়েলিস সিম্পসনকে বিয়ে করার কারণে ১৯৩৬ সালে সিংহাসন ত্যাগ করেন অষ্টম এডওয়ার্ড। অতঃপর তার স্থলাভিষিক্ত হন এলিজাবেথের পিতা ষষ্ঠ জর্জ। তিনি ১৯৫২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর নিয়মানুযায়ী ব্রিটিশ সিংহাসনে স্থলাভিষিক্ত হন এলিজাবেথ। সে হিসেবে বলা যায়, ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের শেষ পুরুষ শাসক।

প্রচুর শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতেন রাণী এলিজাবেথ

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাণী এলিজাবেথ ব্রিটিশ রাজপরিবারে তার উপর আরোপিত কাজগুলো করে গেছেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের হিসেব অনুযায়ী রাণী এলিজাবেথ তার জীবদ্দশায় কমনওয়েলথ এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিক অঞ্চলে ১,৭৫,০০০ এর অধিক টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন।

এছাড়াও তিনি যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথ অঞ্চলের দম্পতিদের বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা হিসেবে বিভিন্ন সময় ৫,৪০,০০০ টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন তিনি। এছাড়াও তিনি নিয়মিত নবদম্পতিদের নিয়মিত টেলিগ্রাম করে শুভেচ্ছা জানাতেন। রানী এলিজাবেথ তার শাসনামলে প্রায় ৪৫,০০০ ক্রিসমাস কার্ড লিখেছেন এবং প্রাসাদে দায়িত্বরত কর্মীদের মাঝে ৯০,০০০ ক্রিসমাস কেক বিতরণ করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে কোনো শাসক এত সংখ্যক শুভেচ্ছাবার্তা, উপহার বিতরণ করেছিন বলে জানা যায় না।

অভিনয়ে রাণী এলিজাবেথ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রানী তার ছোটবোনের সঙ্গে মূকাঅভিনয় করেন। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৫ বছর। প্রথমবার থিয়েটারে তিনি প্রিন্সেস মার্গারেটের বিপরীতে প্রিন্স ফ্লোরিজেলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মূলত বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বড়দিনের ছুটি কাটানোর জন্য নতুন কিছু আয়োজনের পরিকল্পনা করেন দুই বোন। ১১ বছর বয়সী মার্গারেট হাইস্কুলের কনসার্টে দেখা মূকাভিনয় প্রদর্শনীর জন্য অনুরোধ করেন।

বোণের সাথে অভিনয় করছেন রাণী এলিজাবেথ Image credit: getty image

ছোটবোনের বুদ্ধিতে সহজেই রাজি হন এলিজাবেথ। অতঃপর ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এলিজাবেথ সর্বমোট চারটি প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটি ছিলো সিনেড্রেলা, দ্বিতীয়টি স্লিপিং বিউটি, তৃতীয়টি আলাদিন এবং শেষটি ওল্ড মাদার রেড রাইডিং বুটস। স্লিপিং বিউটিতে সালভাদরের রাজপুত্রের চরিত্রে অভিনয় করলেও আলাদিনের প্রদর্শনীতে শিরোনামে অভিনয় করেন এলিজাবেথ। আলাদিনে অভিনয় করতে গিয়েই তার সঙ্গে প্রিন্স ফিলিপের প্রেম শুরু হয়। তার পিতামহীর লেখা একটি চিঠির মাধ্যমে এর সত্যতা পাওয়া যায়। চারটি প্রদর্শনীর চারটি ছবিই এখন অবধি সংরক্ষিত রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন রাণী এলিজাবেথ

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করেছিল।লর্ড হেইলশাম, পরামর্শ দেন যে রাজকুমারী এলিজাবেথ এবং মার্গারেটকে বোমাবর্ষণ এড়াতে কানাডায় স্থানান্তর করা উচিত। তাদের মা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন,”বাচ্চারা আমাকে ছাড়া যাবে না। আমি রাজাকে ছাড়া নড়ব না। এবং রাজা কখনও যাবেন না।” রাজকন্যারা ১৯৩৯ সালের ক্রিসমাস অবধি স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসলে থাকতেন, তারপর তারা নরফোকের সান্দ্রিংহাম হাউসে চলে আসেন।১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত তারা উইন্ডসর রয়্যাল লজে থাকতেন, উইন্ডসর ক্যাসলে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, যেখানে তারা পরবর্তী পাঁচ বছর বেশিরভাগ সময় বাস করতেন।

উইন্ডসর-এ, রাজকন্যারা কুইনস উলের তহবিলের সহায়তায় ক্রিসমাসে প্যান্টোমাইমস তৈরি করেছিল, যা সামরিক পোশাকগুলিতে বুননের জন্য সুতা কিনেছিল।১৯৪০ সালে, ‘বিবিসি’র চিলড্রেন আওয়ার’ চলাকালীন ১৪ বছর বয়সী এলিজাবেথ তার প্রথম রেডিও সম্প্রচার করেছিলেন, শহরগুলি থেকে সরিয়ে নেওয়া অন্য শিশুদের উদ্দেশে। তিনি বলেছিলেন:”আমরা আমাদের সাহসী নাবিক, সৈনিক এবং বিমানবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি এবং আমরাও যুদ্ধের বিপদ ও দুঃখের নিজস্ব অংশটি বহন করার চেষ্টা করছি। আমরা জানি, আমাদের প্রত্যেকেই জানি যে, শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হবে।

১৯৪৩ সালে, এলিজাবেথ গ্রেনাডিয়ার গার্ডস সফরে প্রথম একা প্রকাশ্যে উপস্থিত হন, যার আগের বছর তিনি কর্নেল নিযুক্ত হন।তিনি তার ১৮তম জন্মদিনের কাছে আসার সাথে সাথে সংসদ আইনটি পরিবর্তন করে যাতে তিনি তার পিতার অক্ষমতা বা বিদেশে অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন, যেমন ১৯৪৪ সালের জুলাইয়ে ইতালি সফর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাণী এলিজাবেথ Image credit: ww2 photo

১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, তিনি সহায়ক টেরিটোরিয়াল সার্ভিসে সম্মানিত সেকেন্ড সাবআল্টার্ন হিসাবে ২৩০৮৭৩ নম্বর সংখ্যার সাথে নিযুক্ত হন।তিনি চালক এবং মেকানিক হিসাবে প্রশিক্ষিত হন এবং পাঁচ মাস পরে তাকে সম্মানসূচক জুনিয়র কমান্ডার (সেই সময়ে অধিনায়কের মহিলা সমতুল্য) পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।

প্রচুর অদ্ভুত উপহার পেয়েছেন রাণী এলিজাবেথ

দীর্ঘ সময় ধরে রাজকার্য পরিচালনার সময় রানী এলিজাবেথ জীবন্ত প্রাণী সহ বিভিন্নরকম অদ্ভুত উপহার পেয়েছেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের নিজস্ব ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৭২ সালে সিসিলি ভ্রমণকালে দুটো কচ্ছপ উপহার পেয়েছিলেন তিনি। একই বছর তার বিয়ের রৌপ্য বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ক্যামেরুনে সাত বছর বয়সী জাম্বো নামের একটি জংলি হাতির বাচ্চা উপহার দেওয়া হয় তাকে।

Image credit: Good housekeeping

অতঃপর কানাডায় রাজকীয় ভ্রমণের সময় দুটো কালো বেভার উপহার পান রাণী এলিজাবেথ। সবগুলো প্রাণী লন্ডনের চিড়িয়াখানায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও সানগ্লাস, সাত কেজি ওজনের চিংড়ি এবং রাখালদের জুতো জোড়া উপহার পেয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন গবেষকের দাবি, রানীর পাওয়া অদ্ভুত উপহারের মধ্যে আরও অনেক কিছুই থাকতে পারে, যেগুলোর নাম বা সংখ্যা প্রকাশ করতে চান না রাজপরিবারের মুখপাত্ররা।

রাণীর রাজকীয় সম্মতি

ব্রিটেনের নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো আইন প্রণয়নের জন্য সর্বপ্রথম হাউজ অভ লর্ডস এবং পরবর্তীতে হাউজ অভ কমন্সে পাশ হয়ে রানীর কাছে পৌঁছায়। পরবর্তী সময়ে রানী এলিজাবেথ এবং রাজপরিবারে তার বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান সদস্যরা সবকিছু মূল্যায়ন করেন। তারপর শুধুমাত্র রানীর সম্মতি পেলেই সেসব আইন পাশ হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। ১৯৫২ সাল থেকে এখন অবধি পার্লামেন্টের ৩,৫০০ এর বেশি আইন পাশে সম্মতি দিয়েছেন রাণী এলিজাবেথ।

কুকুর পোষার শখ ছিলো রাণী এলিজাবেথের

রানীর ৩০টিরও বেশি পোষা কুকুর ছিলো। প্রথমটি তিনি ১৯৪৪ সালে নিজের ১৮ত্ম জন্মদিনে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। কথিত আছে, কুকুরটির নাম ছিলো সুজান এবং তা তিনি নিজের মধুচন্দ্রিমায় সঙ্গে নিয়ে যান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালে ব্যালমোরাল স্টেটের ব্রডল্যান্ড, হ্যাম্পশায়ার এবং বীরখালে এলিজাবেথ ও ফিলিপ দম্পতির মধুচন্দ্রিমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

Image credit: Daily express

এলিজাবেথের মতো তার পিতামহী ভিক্টোরিয়াও কুকুর পছন্দ করতেন। রানী ভিক্টোরিয়ার বেশিরভাগ কুকুরই ছিলো জার্মান ডাচশান্ড প্রজাতির। শেষ জীবনে তিনি কয়েকটি স্কটিশ কলিস পুষেছিলেন। স্কটিশ কলিসগুলোর মধ্যে একটির নাম ছিলো নোবেল। ধারণা করা হয়, রানী এলিজাবেথ এই বৈশিষ্ট্যটি পিতামহীর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন।

রাণীর বিয়ে ও রেশন

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ে নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। দ্য টেলিগ্রাফের মতে, ফিলিপের সঙ্গে এলিজাবেথের প্রথম বাগদান সম্পন্ন হয় ১৯৪৬ সালে। যদিও ১৯৪৭ সালের পহেলা এপ্রিল এলিজাবেথ ২১ বছরে পদার্পণের পর সেটি স্বীকৃতি পায়। একই বছরের ২০ নভেম্বর এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপের রাজকীয় বিয়ে সম্পন্ন হয়।

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপের বিয়ের সময়ের ছবি; Image Source: Market Watch

অন্যান্য ব্রিটিশ নাগরিকের মতো রানী এলিজাবেথও সরকার থেকে রেশনের কুপন পেতেন। কারণ তখনও তিনি রাজপরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন না। প্রতিবারের কুপনগুলো জমিয়ে রেখেছিলেন এলিজাবেথ। অতঃপর বিয়ের সময় ব্রিটিশ সরকার তাকে বিয়ের উপহার হিসেবে আরও ২০০টি রেশন কুপন প্রদান করে। তার বিবাহোত্তর শুভেচ্ছায় উপহার পাওয়া কুপনগুলো দিয়ে বিয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বলা হয়েছিল।

এলিজাবেথের বিয়ের পোশাকটি ছিলো ১৩ ফুট লম্বা। আইভরি সিল্কের কাপড়ে নানানরকম কারুকাজের পাশাপাশি ১০,০০০ মুক্তা যুক্ত পোশাকটি আমেরিকা থেকে এটি আনা হয়। দ্য টেলিগ্রাফের মতে, সে সময় শুধুমাত্র তার বিয়ের পোশাকটি তৈরি করে ব্রিটেনে আনা অবধি ৩৭,০০০ ডলার খরচ করা হয়। রানী এলিজাবেথ এবং ফ্রিন্স ফিলিপের বিয়ের ৭০ বছর পার হয়ে গেলেও তার বিয়ের পোশাকটি এখন পর্যন্ত যত্নসহকারে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

একজন দায়িত্ববান মা ছিলেন রাণী এলিজাবেথ

এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতি সর্বমোট চার সন্তানের জনক। এলিজাবেথ রানী হওয়ার পূর্বে প্রিন্স চার্লস, প্রিন্সেস অ্যানি এবং সিংহাসনে বসার পর প্রিন্স অ্যান্ড্রু, প্রিন্স এডওয়ার্ড জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে প্রিন্স অ্যান্ড্রু জন্মানোর পর রানী এলিজাবেথ প্রথম সার্বভৌম রানী হিসেবে সন্তানলাভের কৃতিত্ব অর্জন করেন।

সন্তানের সাথে রাণী এলিজাবেথ Image credit: History Extra

এর আগে ১৮৫৭ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন রানী ভিক্টোরিয়া প্রিন্সেস বিয়াট্রিসের আগমন উদযাপন করেছিলেন। রানী এলিজাবেথ তার সব সন্তানকেই সমানভাবে স্নেহ করতেন। তিনি রাজপুত্রদের মধ্যে কাউকে বিশেষভাবে বিবেচনা করেননি বলেই তার শাসনামলে ব্রিটিশ রাজপরিবারে কখনও ভাঙ্গন ধরেনি।

Featured Image credit: BBC

Leave a Reply