যে সকল বিষয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা বা অধ্যায়ন করেন তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি সম্ভবত মানুষের মন। মানুষের মন কিভাবে কাজ করে আর কিভাবেই বা এর বিকাশ ঘটছে তার জন্য হচ্ছে গবেষণা।
তবে এই গবেষণার মাঝেও রয়েছে কিছু অমানবিক ও নিষ্ঠুর পরিক্ষা নিরিক্ষা।
আজ আপনাকে জানাতে যাচ্ছি ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ৫ টি সাইকোলজি এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে।
১. দ্য মনস্টার স্টাডি (১৯৩৯)
১৯৩৯ সালে ওয়েন্ডেল জনসন এবং মেরি টিউডর নামে দুজন গবেষক শিশুদের স্বাভাবিক কথা বলা ও তোতলানো কথা বলা নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন।
পরীক্ষার জন্য তারা ২২ জন অনাথ শিশুকে ব্যবহার করেন। এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল স্বাভাবিক ভাষী শিশুদের মধ্যে তোতলাতে প্ররোচিত করা এবং তোতলানকারীদের বলা যে তাদের বক্তৃতা ভাল ছিল। তাদেরকে প্রথম দিকে বলা হয়নি তাদের উপর পরিক্ষা করা হচ্ছে।
গবেষকদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের পুরোপুরি তোতলা বানানোর পর তাদেরকে আবার স্বাভাবিক করা যায় কিনা।
তারা শিশুদের বলেছিল পরবর্তীতে তারা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার জন্য স্পিচ থেরাপি পাবে। ২২ জন এতিম শিশুকে দুটি দলে বিভক্ত করা হয়েছিল, একটি দল ক্রমাগত তাদের বক্তৃতার সাবলীলতার জন্য ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং প্রশংসা পাচ্ছিল।

অন্য দলটিকে অবশ্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হয়েছে এবং তাদের যে কোনো ধরনের বক্তৃতা অসম্পূর্ণতার জন্য অত্যন্ত কঠোর আচরণ করা হয়েছিল।
তাদের সাথে এমন অবমাননা করা হয়েছিল যে এই শিশুদের বেশিরভাগই কথাবলা বন্ধ করে দিয়েছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস তখন একটা সংবাদ প্রকাশ করেছিল,
“একজন মেয়ে শিশু সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, কারণ তাদের উপর এই ব্যাপারগুলো তীব্র ভাবে প্রভাব ফেলছিল।”
এই গবেষণার ফলে ১১ জন শিশু আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে নি। বাকিটা জীবন তাদের এই মানসিক আঘাত নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে।
২. স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট
ফিলপ জিম্বারডো ও তার গবেষক দল স্ট্যানফোর্ড কলেজের ছাত্রদের উপর একটি সাইকোলজি এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলেন।
এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে একটা গোষ্ঠীকে ক্ষমতার অপব্যবহারের দিকে নিয়ে যায়।
এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য ৭০ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ২৪ জন শিক্ষার্থী কে সিলেক্টেড করা হয়।
এই ২৪ জনের মধ্যে কয়েকজন কে কারাগারের রক্ষী বানানো হয়। আর বাকিদের কয়েদি হিসেবে রাখা হয়।
পরীক্ষা টি ১৪ দিন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মাত্র ৬ দিনের মাথায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ রক্ষীদের (আধিপত্যকারী দল) ভূমিকায় নিযুক্ত শিক্ষার্থীরা বন্দীদের (অধীন দল) সাথে খুব খারাপ আচরণ শুরু করেছিল। তারা বন্দী শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাতে শুরু করেছিল।

শুধুমাত্র কিছু উত্তর খোঁজার উদ্দেশ্যে মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন এবং মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মানব বিষয়কে রাখা কি সত্যিই ন্যায্য? না, এটি নয় এবং এটি নৈতিকও নয়।
৩. দ্য এভ্যারশন প্রোজেক্ট
এই পরীক্ষাটি দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বর্ণবিদ্বেষের প্রকট যুগে করা হয়েছিল। আর এই পরীক্ষার বলির পাঠা ছিল সেনাবাহিনীর সমকামী পুরুষ ও নারীরা।
পরীক্ষাটি কর্নেল অব্রে লেভিন দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল যিনি একজন মনোবিজ্ঞানীও ছিলেন।
তিনি কয়েক হাজার সমকামীকে তখন একটি সামরিক হাসপাতালে বন্দী করেছিলেন এবং তাদের উপর থেরাপি প্রয়োগ করেছিলেন।
তার পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল সমকামী পুরুষদের যৌন ইচ্ছেগুলো পরিবর্তন করা, যাতে তারা সমকামী থেকে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের দিকে আগায়।
এই থেরাপির সাথে আরও যোগ করা হয়েছিল রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, বৈদ্যুতিক শক, বিভিন্ন ওষুধ, হরমোন চিকিৎসা এবং আরও অনেক কিছুর!

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষ যুগের অবসানের সাথে সাথেই, ডঃ অউব্রে লেভিন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন কারণ তিনি ভালভাবে জানতেন যে তিনি অনেক লোককে নির্যাতন করেছিলেন এবং অনৈতিক অনুশীলনে জড়িত ছিলেন।
এরজন্য তার জেল বা ফাঁসি ও হতে পারে
৪. মাংকি ড্রাগ ট্রায়ালস
অনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল আমাদের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কখনও কখনও তারা পশুদের মধ্যেও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে!
এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৬৯ সালের দিকে। তখন গবেষকরা মাদকের অপব্যবহারের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে তারা বানরের উপর মাদক প্রযোগ করেছিল। তারা দেখতে চাইছিল মানুষের বাহিরে অন্য প্রজাতির মাদকাসক্তি হতে পারে কিনা?
পরীক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে, বানরদের মাদকাসক্ত করার জন্য নিয়মিত ডোজ দেওয়া হয়েছিল।কিভাবে তাদের শরীরে মরফিন, কোকেন, কোডাইন, এক্সট্যাসি এবং অ্যালকোহলের মতো বিভিন্ন ওষুধ ইনজেকড করতে হয়।
একপর্যায়ে বানরদের এই মাদকগুলো পর্যাপ্ত পরিমানে দিয়ে একা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
বানরগুলো সেই সময়ে, মাদকাসক্ত ছিল! তারা প্রতি ঘন্টা পর পর এই ওষুধগুলি দিয়ে নিজেদেরকে ইনজেকড করতো। এই মাদক গ্রহণের প্রভাবগুলি এতটাই ভয়ানক ছিল যে বানররা তাদের নিজের পশম, আঙুল ছিঁড়ে ফেলছিল এবং পরে তাদের অঙ্গগুলি ভেঙে ফেলছিল। আর যারা মরফিনে আসক্ত ছিল তারা দুই সপ্তাহের মধ্যে মারা গিয়েছিল।
পশুদের কেও কি আমাদের বিজ্ঞান গবেষণার জন্য মূল্য দিতে হবে?
৫. MKUItra (মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ)
MKUltra ছিল একটি গোপন অপারেশন যা আমেরিকার CIA দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং জনসাধারণ ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এটি সম্পর্কে সচেতন ছিল না।
সিআইএ পরিচালক অ্যালেন ফস্টার ডুলেস গবেষকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কি ধরনের ওষুধ, সম্মোহন, ইলেক্ট্রোশক থেরাপি, চরম বিচ্ছিন্নতা, মৌখিক অথবা যৌন নির্যাতন এবং অন্যান্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এজন্য তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষদের বাছাই করেছিল তা বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং এমনকি কারাগারই হোক না কেন।
এই প্রকল্পের সবচেয়ে হতাশাজনক কারণ হল যে জড়িতদের বেশিরভাগই তাদের সাথে কী করা হচ্ছে সে সম্পর্কেও সচেতন ছিল না!
জনসাধারণ এই পরিক্ষার ব্যাপারে জানলেও সিআইএ তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা থামায় নি। সবশেষে সরকার এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এই প্রজেক্ট বন্ধ করে।
Featured Image Credit: Duft the psych