You are currently viewing মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা: মানুষ ভাইয়ের শিম্পাঞ্জি বোন

মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা: মানুষ ভাইয়ের শিম্পাঞ্জি বোন

১৯২৭ সাল উইনথ্রপ কেলগ নামে কলম্বিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ‘ Wolf children of India’ শিরোনামের একটি আর্টিকেল পড়ে চমকপ্রদ হন। এই আর্টিকেলটি পড়ার পর তিনি এক প্রজাতি কিভাবে অন্য প্রজাতিকে লালন-পালন করতে সক্ষম এসব ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন। আর তাই একটা সময় তিনি তা পরীক্ষা করার জন্য নিজের সন্তান কে একটি শিম্পাঞ্জির সঙ্গে লালনপালন করেছিলেন।

৩ সদস্যের পরিবার

ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নের সময় উইনথ্রপের দেখা হয় লুয়েলা কেলগের সাথে। উইনথ্রপ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে। এরপর তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য। তার বিভিন্ন বিষয়ে জানা ও শেখার আগ্রহ ছিল; তবে তিনি Conditioning and Learning এই দুটো বিষয়ে বেশি আগ্রহী ও কৌতুহলী হয়ে ছিলেন।

১৯২৯ সালে উইনথ্রপ ও লুয়েলা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। এবং বিয়ের বছর খানেক পর তাদের এক ছেলে সন্তানের জন্ম হয়, তার নাম রাখেন ডোনাল্ড। আর এই ছোট্ট শিশু ছেলেটিই তাদের পরীক্ষার বিষয় হয়ে উঠেন।

শিশু শিম্পাঞ্জিকে দত্তক নেওয়া

উইনথ্রপ ১৯৩১ সালে পিয়েরে আব্রেউ নামে একজন ব্যাক্তির মাধ্যমে একটি মেয়ে শিম্পাঞ্জিকে দত্তক নেন। শিম্পাঞ্জি টির বয়স ছিল তখন মাত্র ৭ মাস। সে জন্মেছিল কিউবার একটি লোকাল প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টারে।১৯৩১ সালে যখন শিম্পাঞ্জি টি সাড়ে সাত মাস বয়সী হয়েছিলেন, তখন তাকে তার মায়ের কোল থেকে ছাড়িয়ে কেলগ দম্পতির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। শিশু মেয়ে শিম্পাঞ্জিটির নাম দেওয়া হয়েছিল গুয়া। শিশু শিম্পাঞ্জিটিকে তারা ডোনাল্ডের বোন হিসাবে লালন-পালন করা শুরু করেন।

কেলগ দম্পতি জানতেন যে এই পরীক্ষা -নিরীক্ষা এবং গবেষণার বিষয়টি হয়তো ভবিষ্যতে তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে; সেই সাথে তাদেরকে প্রচুর সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হবে।

পরীক্ষা- নিরীক্ষার শুরু

উইনথ্রপ এবং লুয়েলা কেলগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন যা তারা ১ দিন বা ১ সপ্তাহ নয় তারা দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চালিয়েছিল।

তাদের ছেলে ডোনাল্ডের বয়স ছিল তখন ১০ মাস যখন তিনি সাড়ে সাত মাস বয়সী গুয়ার সাথে পরিচয় হয়েছিল। কেলগ দম্পতি তাদের দুজনকে পরিচয় করিয়েছিলেন ভাই বোন হিসেবে। গুয়াকে তারা মানব শিশুর মতো বড় করতে শুরু করে এবং একসাথে বাসবাস করতে থাকে।

ডোনাল্ড ও গুয়া দুজনেই শিশু বাচ্চার পোশাক পরতেন, চেয়ারে বসতেন, একই বিছানায় ঘুমাতেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে একে অপরকে গুড নাইট কিস করতো, একই চামচ দিয়ে খাবার খেতো, একসাথে হাঁটতে শিখেছিল একটি স্ট্রলার ব্যবহার করে, একই গেম খেলতো একই কমিক বই পড়তো।

Image Source: Google
Image source: Google

তখন তো এখনকার মতে মোবাইল ইউটিউব ছিলো না তবে কেলগ দম্পতি তাদের ব্যাপারগুলো ভিডিও করে রেখেছিলেন। (আপনি ইউটিউব ঘাটাঘাটি করলে তাদের বেশ কিছু ফুটেজ পাবেন)

Image source : Psychology history

তাদের দৈনন্দিন রুটিন ছিলঃ-

সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে উঠা ও ৭ঃ৩০ এ নাস্তা করা।সকাল ৯টা থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে চলতো দুপুর ১২টা পর্যন্ত।

দুপুর ১২ঃ১৫ থেকে চলতো ঘুমের সময়। বিকাল ৩ঃ৩০ থেকে ৪ টার মধ্যে ছিল পর্যবেক্ষণের সময় ছিল।

সন্ধ্যা ৬ টায় রাতের খাবার খাওয়া হতো আর ঘুমানো হয় ৬ঃ৩০ মিনিটের মধ্যে।

কেলগস দম্পতি অনেক পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তারা গুয়া এবং ডোনাল্ডের রক্তচাপ, স্মৃতিশক্তি, শরীরের আকার, গভীরতা উপলব্ধি, কণ্ঠস্বর, গতিবিধি, সুড়সুড়ির প্রতিক্রিয়া, শক্তি, ম্যানুয়াল দক্ষতা, সমস্যা সমাধান, ভয়, ভারসাম্য, খেলার আচরণ” পরীক্ষা করা ও শুরু করেছিলেন। এছাড়া আরোহণ, বাধ্যতা, আঁকড়ে ধরা, ভাষা বোঝা, মনোযোগের স্প্যান এবং অন্যান্য অনেক বিষয় তাদের সাইকোলজিক্যাল রেকর্ডে উল্লেখ করা হয়েছিল।

Image source: google

এছাড়া পর্যবেক্ষণের জন্য তারা ডোনাল্ড ও গুয়া কে উঁচু চেয়ারে বসাতো এবং দুজনের চেয়ার গুলোকে জোরে ঘুরাতে থাকতো।

কেলগস দম্পতির পরিচালিত আরেকটি পরীক্ষা ছিল তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করা। এজন্য তারা ক্যামেরা সেট আপ করার পরে, উইনথ্রপ বাতাসে একটি বুলেট গুলি করতো। গুলির আওয়াজ শুনে উভয় শিশুই চমকে উঠল কিন্তু গুয়া দ্রুত সাড়া দিল।

Image source: history tv

পরীক্ষার বিভিন্ন দিক দিয়েই, শিম্পাঞ্জির শিশুটি মানব শিশুর চেয়ে বেশি স্মার্ট ছিল। গুয়ার শারীরিক দিক দিয়ে ভালো করছিলো কিন্তু ডোলান্ডের ততোটা উন্নতি হচ্ছিলো না। আবার ডোনাল্ড যখন ভাষাতে পারদর্শী হতে শুরু করছিল তখন গুয়া তা করতে পারছিল না।

পরীক্ষার ফলাফল

প্রাথমিকভাবে কেলগস দম্পতি ৫ বছর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু ৯ মাসের মাথায় তা হঠাৎ বন্ধ করে দেয়। কেনো বন্ধ করেছিল কেলগস দম্পতি তা স্পষ্টভাবে বিশ্বকে জানায় নি। কিন্তু ধারণা করা হয় যে গুয়া হয়তো ডোনাল্ডের জন্য শারীরিকভাবে খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। তারা হয়তো ভয় পেয়েছিলেন এজন্য যে গুয়া ডোনাল্ডের ক্ষতি করতে পারেন।

এছাড়াও, ডোনাল্ড তার বোনের কাছ থেকে শিম্পাঞ্জির মতো আচরণ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। সে মানুষকে কামড়াতে থাকে এবং তার বোনের মতো হামাগুড়ি দিতে থাকে। সে তার মতোই ঘেউ ঘেউ করে উঠতো। আরো বলা হয় যে একই সময়ে দুটি শিশুর যত্ন নেওয়া এবং নয় মাস ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে তারা দুজনে ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন।

কেলগস দম্পতি গুয়াকে তার আগের জায়গায় ফেরত পাঠায়। দুই ভাইবোন একে অপরের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিল। তারা একজন আরেকজনকে দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যেতো।

১৯৭২ সালে লুয়েলা এবং উইনথ্রপ দুজনেই মারা যান। কেলগস দম্পতি এবং ডোনাল্ড থেকে তার বিচ্ছেদের পর মাত্র এক বছর পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গুয়া মারা যান। আর ডোনাল্ড মাত্র ৪৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন।

এই পরীক্ষা কি নৈতিক?

আমি এখানে অনৈতিক ও নৈতিকতার ব্যাপারে নিশ্চিত নই। ডোনাল্ডের আত্মহত্যার পেছনে এই পরীক্ষার সম্পর্ক আছে কিনা তার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। এছাড়াও তার জীবন সম্পর্কে খুব বিস্তারিত তথ্যও জানা যায় নি।

বর্তমানে পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ পোষা প্রাণীকে তাদের সন্তানের পাশাপাশি রেখে লালন পালন করছেন। সে হিসেবে একটি বানরকে পরিবারের সদস্য হিসেবে লালন পালন করার মধ্যে খুব একটা বেশি পার্থক্য আমি দেখি না। পরীক্ষা এবং বিজ্ঞানের খাতিরে, এটি খারাপ নয়। এই পরীক্ষাগুলি আমাদেরকে প্রচুর নতুন তথ্য দিয়েছে যা আমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হয়।

Leave a Reply