You are currently viewing প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস : প্রেম, গর্ব ও আত্মবিশ্বাসের মধ্যকার দ্বন্দ্ব

প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস : প্রেম, গর্ব ও আত্মবিশ্বাসের মধ্যকার দ্বন্দ্ব

জেন অস্টিন ইংরেজি সাহিত্যে নারী লেখকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। জেন অস্টিন তার সাহিত্যে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। সমাজের মানুষের জীবনযাপন, সমাজে নারীদের অবস্থান, বিয়ে ও সমাজের শ্রেণীবিভাজন তার রচনার প্রধান উপজীব্য বিষয়। জেন অস্টিন তার ৪১ বছরের স্বল্প জীবনে মাত্র ছয়টি উপন্যাস রচনা করেছেন। তার সবগুলো সাহিত্যকর্মই ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বলে বিবেচিত হয়।

জেন অস্টিনের রচিত উপন্যাস নিয়ে প্রচুর মুভি ও সিরিজ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে তার উপন্যাস Pride and Prejudice ও Emma এই দুটো উপন্যাসকে নিয়ে অসংখ্য মুভি ও সিরিজ নির্মিত হয়েছে।

জেন অস্টিন Image Source: Britannica

জেন অস্টিন লেখক হিসেবে ছিলেন নারীবাদী চেতনার। তার লেখায় তিনি সমাজে নারীর অবস্থান ও নারী স্বাধীনতার ব্যপারে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। জেন অস্টিনের রচিত ৬ টি উপন্যাসের মধ্যে Pride and Prejudice উপন্যাসটিকে তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বলে বিবেচনা করা হয়। এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস যা প্রকাশিত হয় ১৮১৩ সালে। আর প্রথম উপন্যাসটি Sense and Sensibility, যা প্রকাশিত হয় ১৮১১ সালে।

অস্টিনের প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস উপন্যাসের শুরু হয় বেনেট দম্পতির কথাবার্তা দিয়ে। মিসেস বেনেট ৫ জন বিবাহোপযোগী কণ্যা সন্তানের মা। তার সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনা হচ্ছে মেয়েদেরকে কোনো ধনী পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে মেয়েদের স্বচ্ছ ও আর্থিকভাবে নিরাপদ একটি দাম্পত্য জীবন নিশ্চিত করা।এছাড়া স্বভাবে তিনি কিছুটা বোকা, কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ। মাঝেমধ্যেই তার এই জ্ঞানহীনতা তাকে হাস্যরসে পরিণত করে।

মিসেস বেনেটের সবচেয়ে বড় মেয়ের নাম জেন বেনেট। তার ৫ মেয়েদের মধ্যে সে সবচেয়ে সুন্দরী। সেই সাথে স্বভাবে জেন খুবই বিনয়ী, দয়ালু ও লাজুক প্রকৃতির। সব মানুষকেই সে ভালো মনে করে। আর মানুষের মধ্যকার ভালো দিকটাই তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।

বেনেট পরিবারের দ্বিতীয় মেয়ের নাম এলিজাবেথ বেনেট। তিনি এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। এলিজাবেথ তার বড় বোনের মতো বেশি সুন্দরী ও আকর্ষণীয় না হলেও তিনি বুদ্ধিমতী, আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বাধীন চেতনার মানুষ। আর এসব বিষয়ই এলিজাবেথকে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছে। বেনেট পরিবারের কর্তা মিস্টার বেনেট তার এই কণ্যাটিকে অন্যদের থেকে বেশি পছন্দ করেন।

বেনেট পরিবারের তৃতীয় মেয়ের নাম মেরি বেনেট। বোনেদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি বই পড়ুয়া, সেই সাথে খানিকটা গম্ভীর প্রকৃতির। পরিবারের অন্য মেয়েদের মতো তার অতো সৌন্দর্য বা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব নেই। নিজেকে সে খুবই বুদ্ধিমতী মনে করে। প্রায়শই তাকে কথাবার্তার মাঝে দার্শনিক ও নীতিকথা বলতে দেখা যায়।

বেনেট পরিবারের চতুর্থ মেয়েটির নাম ক্যাথরিন বেনেট। সে কিছুটা অস্থির ও চঞ্চল প্রকৃতির। জেন কিংবা এলিজাবেথর মতো ব্যক্তিত্বও তার নেই। পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে তার গুরুত্ব সবচেয়ে কম। আর বেনেটে পরিবারের সবচেয়ে ছোট মেয়েটির নাম লিডিয়া বেনেট। তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। স্বভাবে সে খুবই চঞ্চল, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অস্থির ও ফুর্তিবাজ প্রকৃতির। বোনেদের মধ্যে সে সবচেয়ে ছোট হলেও সবচেয়ে লম্বা। মিসেস বেনেট তার এই মেয়েটিকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন। লিডিয়ার সকল আবদারেই তিনি সমর্থন দেন।

প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস

উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় মিস্টার বেনেট তার লাইব্রেরীতে বই পড়ছেন। মিস্টার বেনেট বই পড়ুয়া ও একাকি স্বভাবের মানুষ। সেই সময় তার স্ত্রী মিসেস বেনেট তাকে বলতে শুরু করেন, মিসেস লং এর কাছে তিনি খবর পেয়েছেন যে নেদারফিল্ড পার্কে চার্লস বিংলি নামের এক ধনী সুদর্শন ব্যাচেলর পুরুষ ভাড়া নিয়েছেন। বছরে তার আয় ৪ হাজার পাউন্ডের বেশি। এমন সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। তার ৫ মেয়ের মধ্যে একজনকে তার কাছে বিয়ে দিতেই হবে।

মিসেস বেনেট তার স্বামীকে চাপ দিতে থাকেন যেনো তিনি নিজে গিয়ে চার্লস বিংলির সাথে পরিচিত হয়ে আসেন। মিসেস বেনেট বলেন যে মিসেস লং মিস্টার বিংলির সাথে তাকে ও তার মেয়েদের পরিচয় করিয়ে দেবেন না, কারণ তার নিজেরই বিবাহোপযোগী দুই জন ভাগ্নী রয়েছে।

মিস্টার বেনেট তার স্ত্রীর প্রস্তাবে বিরক্ত হন। তিনি তার স্ত্রীকে কিছুটা ব্যাঙ্গ করেই বলেন তিনি মিস্টার বিংলির সাথে দেখা করবেন না। কিন্তু পরে তিনি সত্যিই চার্লস বিংলির সাথে দেখা করেন। দেখা করার কথা তিনি তার স্ত্রী ও মেয়েদের কাছে গোপন রাখেন। যখন তিনি দেখা করবার কথা তার স্ত্রী ও মেয়েদের জানান মিসেস বেনেট আনন্দে ফেটে পরেন।

চার্লস বিংলির সাথে বেনেট পরিবারের প্রথম দেখা হয় মেরিটনের বল নাচের অনুষ্ঠানে। মেরিটন একটি ছোট্ট শহর, এটি বেনেটদের বাড়ি লংবর্নের একদম কাছেই। সেই বল নাচে চার্লস বিংলির সাথে আরো একজন অপরিচিত পুরুষ উপস্থিত হয়। বিংলির থেকে সেই লোকটি আরো বেশি সুদর্শন। টাকা পয়সায় তিনি বিংলির চেয়েও অনেক বেশি ধনী। এই লোকটির নাম ডার্সি। তিনি এই উপন্যাসের নায়ক।

ডার্সি বল নাচের অনুষ্ঠানে প্রবেশ করার সাথে সাথে সকল উপস্থিত মানুষদের দৃষ্টি তার উপর চলে যায়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ডার্সি সম্পর্কে সেখানকার মানুষের মনে খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়। ডার্সির হাবভাব দেখে সেখানকার মানুষ ধরে নেয় ডার্সি প্রচন্ড অহংকারী একজন মানুষ। বল নাচের অনুষ্ঠানে কোনো মেয়ের সাথেই সে নাচে অংশগ্রহণ করে না। তিনি সবসময় বিংলির বোনেদের আশেপাশে থাকতেন, তাদের সাথেই কথাবার্তা বলতেন। বল নাচের এই অনুষ্ঠানে বিংলির সাথে জেন বেনেটের ভাব হয়ে হয়ে যায়। বিংলি ও জেন একাধিকবার সেই নাচে একে অপরের সাথে নাচেন।

ডার্সিকে বল নাচের একপাশে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বিংলি ডার্সিকে বলেন, সে কোনো বল নাচে অংশগ্রহণ করছে না। সে কি কোনো নাচের জন্য উপযুক্ত পার্টনার খুঁজে পাচ্ছে না? ডার্সি তখন বিংলিকে বলেন এই বল নাচের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির সাথেই বিংলি নাচছেন। আর তিনি হলেন জেন বেনেট। তখন বিংলি ডার্সিকে তার কাছেই বসে থাকা বেনেট পরিবারের দ্বিতীয় মেয়ে এলিজাবেথ বেনেট কে নির্দেশ করে বলেন এই মেয়েটিও কিন্তু সৌন্দর্যের দিক থেকে কম যায় না।

চার্লস বিংলির এই কথা শুনে ডার্সি এলিজাবেথ বেনেটের দিকে চেয়ে মন্তব্য করেন,
She is tolerable, but not handsome enough to tempt me.

বিংলি ও ডার্সির সব কথাই এলিজাবেথ শুনতে পাচ্ছিলেন। এসব কথা শুনে এলিজাবেথ অপমানবোধ করেন। তিনি অন্যদের মতো ডার্সিকে তার অহংকারের জন্য অপছন্দ করতে শুরু করেন।

বলনাচের পরের ঘটনা, চার্লস বিংলির বোন ক্যারোলিন বিংলি চিঠির মাধ্যমে জেন বেনেটকে তাদের নেদারফিল্ড পার্কে ডিনারের জন্য নিমন্ত্রণ করেন। সেদিন আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। মিসেস ব্যানের তার মেয়েকে ক্যারেজ ছাড়াই ঘোড়ায় করে সেখানে পাঠান। তিনি চাইছিলেন যেনো আজকে বৃষ্টি হয়। আর আজকেই যেন তার মেয়ে বাড়ি ফিরতে না হয়। হলোও ঠিক তাই। জেন বৃষ্টিতে প্রায় ভিজে যান সেই নেদারফিল্ড পার্কের সেই বাড়িতে পৌঁছাতে। পরের দিন জেনের চিঠি আসে, সে চিঠিতে জানায় গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে তার শরীর অসুস্থ হয়ে গেছে।

বোন অসুস্থ হয়েছে শুনে এলিজাবেথ ন্যাদারফিল্ড পার্কের দিকে রওনা করেন। বৃষ্টিতে রাস্তার কাদায় এলিজাবেথের জামা কাপড় ও শরীর ময়লা হয়ে যায়। বোনের জন্য ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ দেখে ডার্সি তখন এলিজাবেথের ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। চার্লস বিংলির বোন ক্যারোলিন আবার ডার্সিকে পছন্দ করতেন। তিন লক্ষ করেন জার্সি এলিজাবেথের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ক্যারোলিন তখন এলিজাবেথকে বিভিন্নভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন।

জেন সুস্থ হয়ে উঠলে এলিজাবেথ তাকে নিয়ে তাদের বাড়ি লংবর্নে ফিরে আসেন। লংবর্নে এসে দেখতে পান তাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন তাদের দূর সম্পর্কের এক কাজিন মিস্টার কলিন্স। এই কলিন্স লোকটি বেনেট পরিবারের সকল সম্পত্তির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার। কারণ তখনকার ইংল্যান্ডের আইন অনুযায়ী মেয়েরা বাবার সম্পত্তির ভাগ পেতো না। বেনেট পরিবারের এই দূর সম্পর্কের কাজিন উইলিয়াম কলিন্স হলেন একজন বোকা ও বিরক্তিকর প্রকৃতির মানুষ। তিনি বর্তমানে একটি চার্চের দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সাথে তিনি লেডি ক্যাথরিন নামের এক ধনী মহিলার বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেছেন। লেডি ক্যাথরিনের অনুগ্রহের ফলে সমাজে তার এক বিশেষ মর্যাদা ও অবস্থান তৈরি হয়েছে।

লেডি ক্যাথরিন চাইছিলেন কলিন্স খুব শীঘ্রই বিয়ে করে নিক। আর সেই উদ্দেশ্যেই কলিন্স বেনেট পরিবারের সাথে দেখা করতে আসেন। এছাড়াও তিনি বেনেট পরিবারের সকল সম্পত্তির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার। মিস্টার কলিন্সের ইচ্ছে ছিল বেনেট পরিবারের সবচেয়ে বড় মেয়ে জেন বেনেটকে বিয়ে করা। যখন তিনি শুনলেন জেন ও চার্লস বিংলির ব্যাপারটা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এলিজাবেথকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার। এলিজাবেথ কলিন্সের দেওয়া সেই প্রস্তাব সাথে সাথেই প্রত্যাখ্যান করেন।

এলিজাবেথের এর কাছে প্রত্যাখ্যান হয়ে কলিন্স বিয়ে করে তাদের প্রতিবেশী মিস্টার উইলিয়াম লুকাস ও লেডি লুকাসের মেয়ে শার্লট লুকাসকে। শার্লট লুকাস ছিল এলিজাবেথের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। শার্লট এমন একজন বোকা ও কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষকে বিয়ে করেছেন এটা এলিজাবেথ মেনে নিতে পারছিল না। শার্লট কলিন্সকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল কারণ তার বয়স ইতোমধ্যে ২৭ পেরিয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর তার সৌন্দর্যের আর কোন কিছুই হয়তো অবশিষ্ট থাকবে না। ফলাফল স্বরূপ তাকে সারাটা জীবন আইবুড়ো হয়েই কাটাতে হবে। তাছাড়া কলিন্সকে বিয়ে করলে তার অর্থ ও সম্পত্তির অভাব হবে না।

শার্লট এলিজাবেথকে বলেছিল, I am not romantic you know. I never was. I ask only a comfortable home.

এলিজাবেথের মিসেস ফিলিপস নামের এক মাসি আছেন। এলিজাবেথের মাসির বাড়ি এলিজাবেথের বাড়ি লংবর্ন থেকে হাটা দূরত্বে মেরিটন শহরে। এলিজাবেথের ছোট বোন বিশেষ করে কিটি ও লিডিয়া প্রতি সপ্তাহেই মাসির বাড়ি যায়। সেসময় মেরিটনে সেনাবাহিনীরা শীতকালীন ক্যাম্প করেছিল। এলিজাবেথের সাথে সেখানকার এক সেনা কর্মকর্তা জর্জ উইকহ্যামের পরিচয় হয়। তার সাথে কথাবার্তা ও পরিচয়ের এক সময় ডার্সির প্রসঙ্গ উঠে। সে বলেন তার বাবা ডার্সির বাবার অধীনে কাজ করতেন। তার বাবা মারা গেলে তিনি ডার্সির সাথেই বড় হয়ে উঠেন। ডার্সির বাবা মৃত্যুর আগে ডার্সিকে বলে গিয়েছিলেন তাকে যেন কিছু সম্পত্তির ভাগ দেয় এবং তাকে যেন চার্চের যাজক হবার জন্য লেখাপড়ার অর্থের যোগান দেয়। ডার্সি তাকে কিছুই দেয়নি। ফলে আজকে তার যাজক হওয়ার পরিবর্তে সেনাবাহিনীর মতো এই কঠিন ও কঠোর পরিশ্রমের পেশায় কাজ করতে হচ্ছে।

উইকহ্যামের কাছে ডার্সি সম্পর্কে এসব কথা শুনে ডার্সি সম্পর্কে এলিজাবেথের ধারণা আরো খারাপ হয়ে উঠে। এলিজাবেথ উইকহ্যামের প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তার মামী মিসেস গার্ডিনার সে সময় তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই উইকহ্যাম ছেলেটাকে তার সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া ছেলেটার চালচুলো কিছুই নেই। তার সাথে জড়ালে এলিজাবেথকে সারাজীবন কষ্ট করে যেতে হবে। উইকহ্যাম তখন মিস কিং নামক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কের জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে উইকহ্যামের চরিত্র সম্পর্কে এলিজাবেথের ধারণা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়।

মেরিটন বল নাচের পর নেদারফিল্ড পার্কে মিস্টার বিংলি একটি বল নাচের পার্টির আয়োজন করেন। এই পার্টিতে জেন বেনেট ও চার্লস বিংলির প্রেম আরো ঘাঢ়ো হয়। তবে এলিজাবেথের ডার্সি সম্পর্কে ঘৃণা আরো বাড়ে। অপরদিকে ডার্সি এলিজাবেথ সম্পর্কে আরো আগ্রহী হয়ে উঠেন। এলিজাবেথের ব্যক্তিত্ব তাকে আরো আকর্ষণ করে। এই অনুষ্ঠানে বেনেট পরিবারের সদস্যদের আচরণ এবং কথাবার্তা এলিজাবেথকে বিব্রত করে তোলে। তার মা এবং বোনেরা যেভাবে মিঃ বিংলির মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন, তা এলিজাবেথের কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয়। সেই অনুষ্ঠানে এলিজাবেথের বন্ধবী শার্লট এলিজাবেথ কে বলেন তার বোন জেন বিংলির প্রতি ভালোবাসা চেপে রাখছে। তার উচিত বিংলির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে দেওয়া। পরবর্তীতে এজন্য হয়তো জেনকেই পস্তাতে হবে।

নেদারফিল্ড পার্কের সেই পার্টির কিছুদিন পর বেনেট পরিবারের কাছে বিংলির পরিবার থেকে একটি চিঠি আসে। এই চিঠিটি লিখেছিল চার্লস বিংলির বোন ক্যারোলিন। তিনি জানান যে তারা লন্ডনে চলে এসেছেন। তাদের আর নেদারফিল্ড পার্কে ফেরার সম্ভাবনা নেই। আর চার্লস বিংলি বিয়ে করবেন ডার্সির বোন জর্জিয়ানাকে। এই চিঠি পেয়ে জেন বেনেট মানসিকভাবে একদম ভেঙে পড়েন। জেনের শরীর ও মন তখন যেহেতু একেবারেই ভেঙে গেছে, তাই তাকে সুস্থ করে তুলতে তারা তাকে জেনের মামা মিস্টার গার্ডিনারের লন্ডনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

এলিজাবেথ ও নিজের একঘেয়েমি কাটাতে নিজের প্রিয় বান্ধবী শার্লট লুকাসের বাড়ি অর্থাৎ মিস্টার কলিন্সের বাড়িতে ঘুরতে যান। শার্লট ও কলিন্স এলিজাবেথের খুব ভালো আপ্যায়ন ও যত্নআত্তি করেন। এদিকে লেডি ক্যাথরিন তাদের সবাইকে ডিনারের জন্য তার রসিংস পার্ক স্টেটে নিমন্ত্রণ করেন। লেডি ক্যাথরিনের রসিংস পার্কের প্রাসাদ ও আভিজাত্য দেখে সকল অতিথির তাক লেগে যায়। এই লেডি ক্যাথরিন ডি বার্গ সম্পর্কে ডার্সির আন্টি হন।

সেই ডিনার অনুষ্ঠানে লেডি ক্যাথরিন এলিজাবেথের সাথে দাম্ভিক আচরণ করেন। এর কারণ মূলত তিনি জানতেন ডার্সি এলিজাবেথকে পছন্দ করে। আর লেডি ক্যাথরিন নিজের মেয়েকে ডার্সির কাছে বিয়ে দিতে চাইছিলেন। ডিনার পার্টিতে তিনি এলিজাবেথকে বলেন এলিজাবেথের আচার, আচরণ ও আদব-কায়দা অভিজাত নয়। সে টেবিল ম্যানারও জানে না। এমনকি পিয়ানোটাও ঠিকমতো বাজাতে পারে না। এলিজাবেথ লেডি ক্যাথরিনের ব্যবহারে কষ্ট পান। সেদিন পার্টিতে ডার্সি ও তার কাজিন কলোনেল ফিটসউইলিয়ামও যোগ দিয়েছিল। সেদিনের ডিনার পার্টিতে এলিজাবেথের সাথে ফিটজউইলিয়ামের কথাবার্তা হলো সবচেয়ে বেশি।

এরপর থেকে ফিটজউইলিয়াম ও ডার্সি নিয়মিত কলিন্স ও শার্লটের বাড়িতে ঘন ঘন আসতে শুরু করেন যেহেতু এলিজাবেথ এখন সেখানেই থাকেন। সে সময়ে ফিটজউইলিয়াম এক কথার ফাঁকে এলিজাবেথকে বলেন তার এই কাজিন ডার্সি খুবই সাহায্যপরায়ণ ব্যক্তি। কয়েক মাস আগে সে তার এক বন্ধুকে কম সামাজিক মর্যাদার এক ফ্যামিলির মেয়েকে বিয়ে করার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এলিজাবেথের বুঝতে কষ্ট হয়নি যে ফিটজউইলিয়াম আসলে তাদের পরিবার ও তার বোন জেন বেনেটের কথাই বলছেন।

এরইমধ্যে একদিন ডার্সি এলিজাবেথকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সময় সে বলে সে জানে যে এলিজাবেথ তার সামাজিক মর্যাদার পর্যায়ের মেয়ে না। কিন্তু সে এলিজাবেথের প্রেমে পড়ে গেছে। সে এলিজাবেথের কাছ থেকে নিজেকে কোনভাবেই সরাতে পারছে না। নিজের সম্পর্কে এমন কথা শুনে এলিজাবেথ রেগে যায় এবং ডার্সির দেওয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এলিজাবেথ ডার্সি কে বলেন সে তাকে এসব কথা বলে অপমান করেছে। সেই সাথে ডার্সি জেন ও বিংলির বিয়ের ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ও উইকহ্যামের সাথে ডার্সি যা অন্যায় করেছে তা ডার্সিকে শুনিয়ে দেয়।

এলিজাবেথের কাছে প্রত্যাখ্যান হয়ে ডার্সি সেখান থেকে চলে যায়। পরের দিন সকালে এলিজাবেথের কাছে ডার্সির একটি চিঠি আসে। সেই চিঠিতে তিনি বলেন তার বোন জেন বেনেট বিংলিকে আসলেই ভালোবাসেন কিনা সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান ছিলেন। কারন তাকে দেখে বোঝাই যায়নি যে সে আসলেই বিংলিকে ভালবাসেন। এছাড়া চার্লস বিংলি এর আগেও বহু নারীর সাথে সম্পর্কের জড়িয়েছেন। কিন্তু জেনের সাথে তার এবারের সম্পর্ক সিরিয়াস মনে হয়েছিল। কিন্তু জেনে হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল সে বিংলির ব্যাপারে সিরিয়াস না।

এলিজাবেথের মনে পড়ে তার বোন সবসময় নিজের ইমোশন লুকিয়ে রাখে। শার্লট তাকে একবার বলেছিল জেন যেন বেংলিকে নিজের মনের কথা খুলে বলে। এভাবে যেন চেপে না রাখে। এলিজাবেথ বুঝতে পারে এই বিয়ে ভেঙে দেবার পেছনে ডার্সির কোন দোষ নেই। এটা তাদের একটা ভুল বোঝাবুঝি।

উইকহ্যামের ব্যাপারে ডার্সি বলেন উইকহ্যাম তার বাবার জমিদারির দেখাশোনা করা ম্যানেজারের ছেলে ছিল। ডার্সির বাবা তাকে নিজের ছেলের মতো করে বড় করেঋেন। মৃত্যু সময় বাবার বলে যাওয়া কথা মতো ডার্সি তার সকল চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করেছে। আইন পড়বার কথা বলে সে হাজার পাউন্ড অকাজে উড়িয়ে দিয়েছে। এরপরেও সে আরও অনেক টাকা দাবি করতে থাকে। আর সবশেষ সে ডার্সির অপ্রাপ্তবয়স্ক বোন জর্জিয়ানা কে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। যাতে করে জর্জিয়ানার নামে থাকা ৩০ হাজার পাউন্ডের অর্থ সম্পত্তি সে হাতিয়ে নিতে পারে। ডার্সির সম্পর্কে এতদিন ধরে এলিজাবেথের ভুল ধারণার জন্য সে অনেক লজ্জা পায় ও অনুতাপ করে।

বোন জেনের সাথে দেখা করতে এলিজাবেথ তার মামা মিস্টার গার্ডিনারের লন্ডনের বাসায় যান। সেখানে তিনি তার বোন জেনের সাথে দেখা করেন। জেনের শরীর ভালো থাকলেও মন তেমন ভালো নেই। চার্লস বিংলির সেই ধাক্কা সে এখনো সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

এরইমধ্যে এলিজাবেথ একদিন তার মামা ও মামীকে সাথে নিয়ে ডার্বিশায়ারে ঘুরতে যান। ডার্বিশায়ারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে তারা ডার্সির পেম্বারলি স্টেটে চলে আসেন। এলিজাবেথ যখন জানতে পারেন এটা ডার্সির স্টেট, সে সেখানে যেতে অনিহা প্রকাশ করে কিন্তু মামা মামীর জন্য যেতে রাজি হয়। এলিজাবেথ সেখানকার ঘরবাড়ি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ডার্সির শিল্পকর্মের সংগ্রহশালা দেখে মোহিত হন। সেই পেম্বার্লি স্টেট এর পরিচায়ক তার মালিক ডার্সির অনেক প্রশংসা করেন। সেই সময় ডার্সি তাদের সামনে উপস্থিত হয়। ডার্সি এলিজাবেথের মামা ও মামি মিস্টার গার্ডিনার ও মিসেস গার্ডেনার এর সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করেন। ডার্সির এমন ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। ডার্সি মিস্টার গার্ডিনারকে তার স্টেটেট লেকে মাছ ধরবার আমন্ত্রণ ও জানান।

উপন্যাসে ডার্সির বোন জর্জিয়ানা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা না হলেও। উপন্যাসে তার সম্পর্কে বলা হয় মেয়েটি সুন্দর তবে ভাইয়ের মতো অতেটা সুন্দর নয়। জর্জিয়ানার বয়স হবে আনুমানিক ষোল বছর। মেয়েটি একদমই সাদামাটা, নিজের মধ্যে কোন অহংকার নেই। কথাবার্তা বলে খুবই কম, হিউমার আছে সেই সাাথে বুদ্ধিমতী। তবে তার সম্পর্কে যে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করা হয়েছে তা হলো সে পিয়ানো বাজানো ও শিল্পচর্চার কাজে খুবই দক্ষ।

এরই মধ্যে এলিজাবেথ চিঠিতে খবর পায় তাদের সবচেয়ে ছোট বোন লিডিয়া উইকহ্যামের সাথে পালিয়ে গেছে। উইকহ্যাম ও লিডিয়া কারোরই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সময় ডার্সি ও এলিজাবেথের মামা মিস্টার গার্ডিনার বহু চেষ্টার পর তাদের খুঁজে বের করে তাদের দুজনের বিয়ে দেন। এলিজাবেথ পরবর্তীতে তার বোন লিডিয়া ও মামির কাছে বিস্তারিত জানতে পারেন যে মিস্টার ডার্সি প্রচুর অর্থ খরচ করে তাদের খুঁজে বের করেছেন। ডার্সি তাদের বিয়েতেও উপস্থিত ছিলেন। উইকহ্যাম লিডিয়াকে বিয়ে করতে চাচ্ছিল না। বিয়ের জন্য সে প্রচুর অর্থ দাবী করে। ডার্সি উইকহ্যামের সকল দেনা পরিশোধ করে। তাকে প্রচুর অর্থ দেয এবং সেই সাথে সেনাবাহিনীতে তার প্রমোশনের ব্যবস্থাও করেন।

এসব কথা শুনে এলিজাবেথ ডার্সির মহত্ত্বে অভিভূত হয়ে যান। একদিন ভোরে লেডি ক্যাথরিন এলিজাবেথের বাড়িতে এসে হাজির হন। তিনি এলিজাবেথ কে কড়া কথা শুনান। এর কারন তিনি জানতে পারেন যে ডার্সি এলিজাবেথের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তাকে বিয়ের প্রস্তাব ও দিয়েছে। তিনি এলিজাবেথ কে নিচু ক্লাসের মানুষ বলে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন ডার্সি তার ভাইয়ের ছেলে তার মেয়ের সাথে ছোট বেলায় তাদের দুজনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এলিজাবেথ ও লেডি ক্যাথরিনকে তার সীমানা বুঝিয়ে দেন কারন সে বাড়ি বয়ে এসে এলিজাবেথ কে অপমান করছেন।

বেশ কিছুদিন কেটে যায় খবর আসে যে মিস্টার চার্লস বিংলি নেদারফিল্ড পার্কে ফিরে এসেছেন তবে এবার সাথে সাথে তার বোন নেই। এই খবরে বেনেট পরিবারের তেমন আগ্রহ নেই আগের মতো। একদিন সকালে চার্লস বিংলি বেনেটদের বাড়ি এসে জেন কে প্রস্তাব দেয়। জেন ও বিংলি পরিবারের সবাই সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

এরপর একদিন সকালে বিংলি ও ডার্সি বেনেটদের বাড়ি আসেন। উদ্দেশ্য হলো জেন বেনেটের সাথে বিংলির ঘুরতে বের হওয়া। মিসেস বেনেট ডার্সিকে একদমই পছন্দ করেন না কারন সে প্রচন্ড অহংকারী। ঘুরবার জন্য তাদের সাথে এলিজাবেথকেও সঙ্গী হতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে এলিজাবেথ ও ডার্সি বেশ দূরে চলে যান। ডার্সি এলিজাবেথের সাথে তার আন্টির খারাপ আচরণের জন্য ক্ষমা চান তারপর তিনি আবারও এলিজাবেথ কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এলিজাবেথ ডার্সির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

ডার্সি এই বিয়ের প্রস্তাব এলিজাবেথের বাবার কাছে দিলে তিনি মেয়ের কথা ভেবে রাজি হয়ে যান যেহেতু এলিজাবেথ ডার্সিকে ভালোবাসে। তার বাবা এলিজাবেথ কে জিজ্ঞেস করেন সে তো আগে ডার্সিকে ঘৃণা করতো। লোকটা বড়লোক হলেও ভালোবাসা না থাকলে তো তার সারাজীবন কষ্টে কাটাতে হবে। এলিজাবেথ তার বাবাকে বলেন যে সে এতোদিন ডার্সি সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে এসেছে। সে খুবই ভালো মানুষ। এলিজাবেথ ডার্সির লিডিয়াকে খুঁজে বের করা ও উইকহ্যামকে এতো টাকা পয়সা দিয়ে বিয়েতে রাজি করার কথাটাও তাদের বলেন।

এসব কথা শুনে এলিজাবেথের বাবাও ডার্সির মহত্ত্বে অভিভূত হয়ে যান। এলিজাবেথের মা এসব শুনে খুবই আনন্দিত হন। বিশেষ করে এলিজাবেথের বাবা এতোটাই খুশি হন যে আজ যেই তার বাকি দুই মেয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসবে তিনি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই রাজি হয়ে যাবেন।

বেনেট পরিবারের সকলেই এতোদিন ভাবতেন ডার্সি একজন অহংকারী মানুষ। আজ তাদের সকলের ডার্সি সম্পর্কে এই ভুল ধারণা ভেঙ্গে যায়। এলিজাবেথের সাথে ডার্সি ও জেনের সাথে চার্লস বিংলির বিয়ে হয়ে যায়। আর এর মাধ্যমেই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে।

জেন অস্টিন তার এই উপন্যাসে ১৮ শতকের ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের চিত্র আসলে কেমন তা চিত্রায়িত করেছেন। সেই সাথে সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা আসলে কোথায় সে ব্যাপারে তিনি আলোকপাত করেছেন। মেয়েরা পিতার সম্পত্তির মালিক হতে পারেনা তারা সবসময় পুরুষের ক্ষমতার বলয়ের অধীনে থাকে। আর তখনকার সমাজের নারীদের একমাত্র চিন্তাভাবনা কেবলই বিয়ে। কিভাবে একজন বড়লোক পুরুষকে বিয়ে করা যায়। বিয়েই যেন মেয়েদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। আরও একটি বিশেষ ব্যাপার লক্ষণীয় যে সেই সময়টায় ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব সদ্য শেষ হয়েছে। এত বড় একটা বিপ্লবের প্রভাব এই উপন্যাসের কোন প্লট বা চরিত্র কারোর মধ্যেই দেখা যায়নি।

Leave a Reply

This Post Has One Comment