You are currently viewing পেলে: বস্তি থেকে ফুটবল সম্রাট হওয়ার গল্প

পেলে: বস্তি থেকে ফুটবল সম্রাট হওয়ার গল্প

সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? পেলে না ম্যারাডোনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে ফুটবলের সম্রাট কে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কালো মানিক খ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। অনেকে আবার ভাবতে পারেন পেলে যদি সম্রাট হন তাহলে ম্যারাডোনা কি? ম্যারাডোনাকে বলা হয় ফুটবলের রাজপুত্র।

চার দশকেরও বেশি সময় আগে ১৯৭৭ সালে অবসর নেওয়ার পরেও সাবেক এই খেলোয়াড় সারা দুনিয়ায় এখনও সবচেয়ে পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন।

মূলত তিন তিনবার বিশ্বকাপ জয় করার জন্য পেলে বিখ্যাত হয়েছেন। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়- নারী কিম্বা পুরুষ- যিনি এতবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন। এছাড়াও তিনি তার ক্লাব ও দেশের হয়ে ১,৩৬৩টি ম্যাচ খেলে মোট ১,২৮১টি গোল করেছেন যা বিশ্ব রেকর্ড।

ফুটবল খেলায় পেলে যে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন সেটা মানুষের কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল খেলাধুলার বাইরের জগতেও।

পেলে নাম যেভাবে এলো!

জন্মটা সাধারণ এক বস্তিতে। ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মেছিলেন পেলে।

আজ আমরা যাকে পেলে নামে চিনি জন্মের পর তার বাবা-মা তার নাম রাখেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিল রেখে। পেলের পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট’। পর্তুগিজ উচ্চারণে এডিসনকে তাঁরা বলতেন এডসন। পেলে বলেন, যখন খেলা শুরু করলাম তখন আমাকে সবাই পেস বলে ডাকত। পেস মানে পা। পর্তুগিজে বলে শট মারাকেও বলা হয় পেস। এই পেস থেকেই এক সময় আমাকে পেলে ডাকা শুরু হলো।

১৯৫০ বিশ্বকাপের সময় পেলের বয়স তখন ১০ বছর। তখন ফুটবল বিশ্বকাপ হতো লীগের মতো করে ব্রাজিল নিজেদের শেষ ম্যাচটা উরুগুয়ের সাথে ড্র করলেই হয়ে যেতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু গিগিয়া যখন শেষ গেলটা করে উরুগুয়ে কে জিতিয়ে দেন সেদিন আবেগপ্রবণ ব্রাজিল সমর্থকদের বহু দর্শক মারাকানার স্টেডিয়ামের ছাঁদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তার মধ্যে ১৬ জন মারা যায়। পুরো ব্রাজিল তখন শোখে আচ্ছন্ন। সেদিন নিজের বাসায় বসেই কাঁদছিলেন পেলের বাবা দোনদিনহো। তখন তার ১০ বছর বয়সের ছেলে পেলে বলেছিলেন, কেঁদো না, আমি বিশ্বকাপ নিয়ে আসব। 

বাবা মায়ের সাথে পেলে Image Credit: Los afro letino

দারিদ্র্যের জীবন

দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে পরিবারের অভাব অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলাতেই পেলেকে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। এছাড়া রেলস্টেশন ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিষ্কারের কাজও করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই পেলে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। পেলে তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার বাবা খুব ভালো সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন। উনিই আমাকে খেলতে শিখিয়েছেন। বাবা আমাকে বলতেন, তার চেয়ে ৩ গুণ বেশি গোল আমাকে করতে হবে। বাবাই আমার অনুপ্রেরণা ছিলেন। তার জন্যই আমি ফুটবলে এসেছি।

ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের বস্তির এক গরিব মা-বাবার পরিবারে জন্ম নেওয়া কালো ছেলেটির জীবনের গল্প অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। ফুটবলে সহজাত প্রতিভা তো ছিলই, ব্রাজিলের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই গলির ফুটবল ছিল তারও অবসরের সঙ্গী। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বলে মোজার ভেতরে খবরের কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চলত তার অনুশীলন।

দারিদ্র্য জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এলো ফুটবল

গলির ফুটবলে ফুটবল খেলা পেলের প্রতিভা একদিন ব্রাজিলের সেরা ক্লাব সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর চোখে পড়ে গেলো। আর এখান থেকেই জীবনের মোড় ঘোরা শুরু। সে সময় পেলের বয়স ছিল ১৫ বছর। ব্রিটো পেলেকে গলি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন স্যান্টোস ক্লাবে এবং অন্তর্ভুক্ত করেন স্যান্টোসের ‘বি’ টিমে। এখানেও সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মধ্যেই স্যান্টোসের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন পেলে।
পেলে বলেন, ছোটবেলায় তিনি স্বপ্ন দেখতেন করিন্থিয়াসে খেলার। কিন্তু এক্ষেত্রেও তার বাবার জন্য তিনি সান্তোসে সই করেন। কারণ সান্তোসের প্রেসিডেন্ট পেলের বাবার ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

সান্তোসে কিশোর পেলে Image Credit: Twitter

ফুটবল মাঠে ফুটবল সম্রাট

পেলে যখন স্যান্টোসের মূল দলে যোগ দেন তখন তার বয়স ১৬ বছর। সেবার ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে স্যান্টোসের হয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন। এরপরই তাকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন ক্লাবের কাড়াকাড়ি।

বস্তির সেই ছেলেটিকে নিয়ে এবার ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। এদের মধ্যে বর্তমান সময়ের জায়ান্ত রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মতো দলগুলোও ছিল। সবাই-ই যে কোনো মূল্যে পেলেকে তাদের দলে ভেড়াতে দৌড়ঝাপ শুরু করেন। কিন্তু সেবার পেলের ইউরোপে খেলা হয়ে ওঠেনি। পেলেকে ব্রাজিলে রেখে দেওয়ার জন্য চাপ ছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও: ১৯৬১ সালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রস পেলেকে “জাতীয় সম্পদ” হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাকে “রপ্তানি করা যাবে না” বলে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন।

প্রথম ম্যাচেই বিশ্বরেকর্ড

ব্রাজিলের হয়ে পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় চিরপ্রতিদ্বন্ধী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সময়টা ছিল ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে গেলেও প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব রেকর্ডটি করতে ভুল করেনটি পেলে। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড।

বিশ্বকাপ ফুটবল

১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পেলের অভিষেক ঘটে। ম্যাচটি ছিল ১৯৫৮ বিশ্বকাপের তৃতীয় খেলা। ১ম রাউন্ডের খেলায় পেলে গোল করতে না পারলেও অন্তিম মুহূর্তে এসে পেলে ঠিকই জ্বলে উঠেন। কোয়ার্টার ফাইনালের ওই ম্যাচে ওয়েলসের বিপক্ষে পেলের করা গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে এবং পরবর্তীতে ব্রাজিল স্বাদ পায় প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের। এই গোলটিও ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের গোল। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জোড়া গোল করে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক বনে যান ১৭ বছর বয়সী পেলে।

৫৮ বিশ্বকাপে পেলে Image Credit: Fifa

এভাবে একে একে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ এর বিশ্বকাপে খেলেন পেলে। এর মধ্যে তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) সালে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তবে পেলে তিনবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন নাকি দুইবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন তা নিয়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কিছুটা বিতর্ক ছিল। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে ২য় ম্যাচেই ঘুরুতর আঘাত পান। এই আঘাতই তাকে বিশ্বকাপ দল থেকে ছিটকে দেয়। সেবারও ব্রাজিল বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে। তবে পেলে সেই দলের সদস্য কিনা তা নিয়েই চলছিল বিতর্ক। অবশেষে ১৯৯৭ সালে ফুটবলের বিশ্ব সংস্থা ফিফা বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁকে ১৯৬২’র বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ঘোষণা করে।

১৯৬৬ সালের যে বিশ্বকাপটা ব্রাজিল জিততে পারেননি সেই বিশ্বকাপেও ১ম খেলায় বুলগেরিয়ার বিপক্ষে খেলা ম্যাচে পেলে গুরুতর আহত হন।

১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দলটির সদস্য হিসেবে পেলে জিতেন তাঁর তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। জুলে রিমে ট্রফিকে নিজের করে নেওয়ার পথে ব্রাজিলের সব সাফল্যের সঙ্গী পেলে ছাড়া বিশ্বের আর কোনো ফুটবলারেরই নেই তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের সাফল্য।

১০০০ বেশি গোল করেছেন পেলে!

পেলে তার ক্যারিয়ারের ১৩৬৩ ম্যাচে গোল করেছেন ১২৮৩টি। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে ভাস্কো-দা-গামা ক্লাবের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান লিগের এক ম্যাচে যেদিন করলেন তাঁর হাজারতম গোল, সেদিন পুরো ব্রাজিল মেতে উঠেছিল উৎসবে। কোনো একক খেলোয়াড়ের গোল করার ব্যাপারে এটিই ছিল বিশ্বরেকর্ড।

১০০০ তম গোলে ১০০০ বল দিয়ে উৎপানে পেলে Image Credit: Facebook

ক্লাব ফুটবলে পেলের শুরু এবং শেষ স্যান্টোসে। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছরে জিতেছেন ব্রাজিলিয়ান লীগ, কাপ আর আন্তর্জাতিক ক্লাব টুর্নামেন্টের ২৭টি ট্রফি।

পেলে কে একমুহূর্ত দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেমে গিয়েছিল

পেলের সান্তোস এফসি ফুটবল ক্লাব ছিল ষাটের দশকে বিশ্বের জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর একটি।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এই ক্লাবটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নিতো। এই খ্যাতির কারণে তারা বাড়তি কিছু সুবিধাও পেয়েছিল।

এরকম একটি প্রীতি ম্যাচ ছিল যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নাইজেরিয়ায়, ১৯৬৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। বেনিন সিটিতে অনুষ্ঠিত ওই খেলায় সান্তোস ২-১ গোলে স্থানীয় একাদশকে পরাজিত করে।

নাইজেরিয়াতে তখন রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছিল। দেশ থেকে বায়াফ্রা রাজ্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।

ফুটবল ক্লাব সান্তোস এফসির ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন এমন একজন গবেষক গুইলহের্ম গুয়াশের মতে, এরকম একটি পরিস্থিতিতে নাইজেরিয়াতে খেলোয়াড়দের পাঠানোর ব্যাপারে ব্রাজিলের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক দুশ্চিন্তা ছিল। সেকারণে বিবদমান পক্ষগুলো তখন যুদ্ধবিরতিতে যেতে সম্মত হয়।
তবে এই গল্পটির সত্যতা নিয়ে সম্প্রতি অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এবং মজার ব্যাপার হলো ১৯৭৭ সালে পেলের যে আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় সেখানে এই ঘটনার কোন উল্লেখ ছিল না।

তবে পেলের আরেকটি আত্মজীবনী, যা কীনা আরো ৩০ বছর পর প্রকাশিত হয়, সেখানে কিন্তু তিনি ওই “যুদ্ধবিরতির” কথা উল্লেখ করেছেন।

পেলে লিখেছেন: “এই প্রদর্শনী ম্যাচের জন্য গৃহযুদ্ধ থামানো হবে বলে” খেলোয়াড়দেরকে জানানো হয়েছিল।

“আমি জানি না এই ঘটনা পুরোপুরি সত্য কীনা, তবে নাইজেরিয়ানরা আমাদের নিশ্চিতভাবে জানিয়েছিলেন যে আমরা যখন ওখানে খেলতে যাবো তখন বায়াফ্রানরা সেখানে আক্রমণ করবে না।”

পেলে ও ম্যারাডোনার মধ্যকার দ্বৈরথ

ফুটবলের সর্বকালের সেরা দুই কিংবদন্তির এই লড়াই চলছেই। সুযোগ পেলেই একে অন্যকে ক্ষতবিক্ষত করেন তারা।

পেলে নাকি ম্যারাডোনা কে সর্বকালের সেরা তা নির্বাচন করার জন্য ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা ২০০০ সালে একটি ভোটের আয়োজন করেছিল। যেখানে সারা বিশ্বের ফুটবল প্রেমী সাধারণ মানুষ ভোট দেন। সেই ভোটে পেলেকে হারিয়ে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু পরবর্তীতে ফিফা ম্যারাডোনা-পেলে দুজনকেই যৌথভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে ঘোষণা করেন।

এক ফ্রেমে দুই কিংবদন্তি পেলে ও ম্যারাডোনা Image Credit: Wikimedia commons

পরবর্তীতে ফিফার এই ঘোষণায় ম্যারাডোনা ফিফার ওপর মনক্ষুন্ন হন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সাধারণ মানুষ আমাকেই শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করেছিল। পেলে হয়েছিল দ্বিতীয়। ফিফা পেলেকে যে পুরস্কারটি দিয়েছে, সেটার সে সামান্যতম যোগ্যও নয়।

দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব

অসাধারণ ব্যক্তি হিসেবেও পেলের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তারই প্রমাণ মেলে, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের লিগে খেলার হাতছানি উপেক্ষা করা, অনেক টাকা আয়ের সম্ভাবনারও ঘটেছে অপমৃত্যু কিন্তু সেটা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন তিনি। পেলে ভুলে যাননি তাঁর নিজের দারিদ্র্ ভরা শৈশবকেও, ব্রাজিলের দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে খেলোয়াড়ি জীবনেই গড়েছেন বিশেষ ফাউন্ডেশন। আর খেলা ছাড়ার পর কখনো ইউনিসেফের বিশেষ দূত, কখনো জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত কখনো বা ব্রাজিলের ‘বিশেষ’ ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তাদের সাহায্য করতে।

বিশ্ব একাদশে পেলে

ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিন বিশ্ব একাদশ ফুটবল টিম গঠনের জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপে সাবেক খেলোয়াড়, কোচ ও সাংবাদিকদের নিয়ে প্যানেল গঠন করে ভোট গ্রহণ করেন। সেই ভোটে বিশ্বের অন্য সব নামী খেলোয়াড়দের পাশাপাশি পেলে নামটিও উঠে এসেছে প্রথম দিকেই।

সম্মাননা

১৯৯৯ সালে বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাঁকে নির্বাচিত করেছে গত শতকের সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বিবেচনায়ও একই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। ফ্রান্সের বিখ্যাত ফুটবল সাময়িকী ফ্রান্স ফুটবলের গোল্ডেন বলজয়ী ফুটবলারদের ভোটেও পেলেই গত শতকের সেরা ফুটবলার, ইউনিসেফ আর বিবিসির জরিপেও তা-ই।

নিজের জীবনী নিয়ে বই লিখেছেন পেলে

আত্মজীবনী নিয়ে নিয়ে ১৫ কেজি ওজনের একটি বই লিখেছেন পেলে। পেলে তার ফুটবলজীবনে মোট ১২৮৩টি গোল করেছেন্। তা থেকেই নিজের বইটির নাম রেখেছেন ‘১২৮৩’। পেলের এই বইয়ে রয়েছে তার ফুটবলজীবনকে মূর্ত করা দুর্লভ ছবির সমাহার। ছবির সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। আরো রয়েছে ৫০০ পৃষ্ঠায় ১২৮৩টি টেক্সট। বইটি ছাপানো হয়েছে ১২৮৩ কপি। প্রতিটি বই বিখ্যাত ফুটবলারদের অটোগ্রাফ-সংবলিত। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ২২৫ ইউরো, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো। ব্রাজিল ছাড়াও আমেরিকার নিউইয়র্ক, সংযুক্ত আমিরাতের দুবাই ও যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বইটি বিশেষ কিছু লাইব্রেরি থেকে পাওয়া যাবে।

পেলের জীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র

পেলের জীবনটাই রোমাঞ্চে ভরপুর। বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেও হয়ে গেলেন ফুটবল বিশ্বের সম্রাট। পেলের বস্তির জীবন থেকে শুরু করে ফুটবল সম্রাট হওয়া পর্যন্ত বহু চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। পেলের জীবনের সেই সব দিনগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হলিউডের পর্দায়। পেলের এই মুভির নাম Pelé: Birth of a Legend.

Image Credit : Wikipedia

চলচ্চিত্রটি নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন পেলে নিজেও। পল কেমসলি ও এক্সক্লুসিভ মিডিয়ার পাশাপাশি পেলেও পালন করবেন নির্বাহী প্রযোজকের দায়িত্ব।

সংসার জীবন

১৯৬৬ সালে রোজমেরিকে বিয়ের ১৬ বছর পর তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় পেলের। সেই ঘরে এক ছেলে এডসন এবং দুই মেয়ে ক্রিস্টিনা এবং জেনিফারের জন্ম হয়। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলিয়ান মডেল জুজার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেও দৈনিকের শিরোনাম হয়েছেন পেলে। তাকে বিয়ে না করে ১৯৯৪ সালে পেলে নিজের দ্বিতীয় ঘর বাঁধেন সাইকোলজিন্ট অ্যাসারিয়া লেমসের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত সে ঘরও টিকিয়ে রাখতে পারেননি ব্রাজিলের ফুটবল কিংবদন্তি। সব মিলিয়ে পেলের সন্তানের সংখ্যা ৭ জন!

পেলের অন্যতম সন্তান এডসন চলবি দো নাসিমেন্টো ‘এডিনহো’ একজন ফুটবলার ছিলেন। তিনি মূলত গোলরক্ষকের ভূমিকায় খেলতেন। ২০০৫ সালে মাদকদ্রব্য পাচারসংক্রান্ত অভিযোগে জড়িয়ে তিনি গ্রেফতার হন।

ফুটবলের সবচেয়ে বড় নক্ষত্রের প্রস্থান

অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন ধরেই। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা তো ছিলই, কয়েক বছর ধরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল কোলন ক্যানসার। এই মরণব্যাধির সঙ্গে লড়েও কেউ কেউ জিতে যান। পেলেও লড়েছেন কয়েক বছর। কিন্তু বয়সটা যে তাঁর পক্ষে ছিল না।

সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও বুঝেছিলেন, সময় হয়ে গেছে। শুরু হয়েছিল উপশমসেবা দেওয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’, অনেকে বলেন ‘এন্ড অব লাইফ কেয়ার’। মানে কোনো রোগীর শরীর যখন স্বাভাবিক চিকিৎসায় সাড়া না দেয়, তখন তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ব্যথা আর কষ্ট উপশমের জন্য সেবা দেওয়া হয়। কে জানে হয়তো এ কষ্ট আর সয়ে যেতে চাননি পেলেও।

জীবনে কত ম্যাচ জিতেছেন, কত হেরে যাওয়ার ম্যাচে শেষ সময়ে গোল করে ফল পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু ক্যানসারের সঙ্গে এই ‘ম্যাচে’ লড়াই করেও শেষ পর্যন্ত হার মানলেন আজ, চলে গেলেন ৮২ বছর বয়সে। চলে গেলেন বেশির ভাগ মানুষের চোখে সর্বকালের সেরা ফুটবলার, চলে গেলেন ব্রাজিলিয়ানদের প্রিয় ‘ও রেই’ বা ‘রাজা’।

Leave a Reply