আফ্রা বেন ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম নারী কবি ও লেখক। ওরুনৌকো আফ্রা বেনের লেখা একটি ছোট্ট উপন্যাস।এই ওরুনৌকো উপন্যাসটিকে মনে করা হয় ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস।
উপন্যাসটি লেখিকা আফ্রা বেন সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে লিখেছিলেন। ১৬৪৩ ও ১৬৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সুরিনামে ঘুরতে গিয়েছিলেন, সেখানকার ব্রিটিশ কলোনির ভয়াবহতা দেখেই পরবর্তীতে ওরুনৌকো উপন্যাসটি রচনা করেন। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৬৮৮ সালে; আফ্রা বেনের মৃত্যু মাত্র ১ বছর আগে।
উপন্যাসের কাহিনী সংক্ষেপ
উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয় আফ্রিকার এক দেশ যার নাম কোরামেন্টিন (বর্তমানে তা পরিচিত ঘানা নামে)। সেই কোরামেন্টাইনের এক রাজার নাতির নাম ওরুনৌকো। সেই রাজার বয়স প্রায় ১০০ এর অধিক। তার ছেলে ছিলো ৩২ জন, তাদের সকলেই যুদ্ধে মারা গেছেন। কারন আফ্রিকায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে তখন সবসময় যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকতো।
ওরুনৌকো ছিলেন ১৭ বছর বয়সী সুদর্শন, শক্তিশালী বুদ্ধিমান ও যুদ্ধে পারদর্শী যুবক। এছাড়াও সে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা শিখেছিল এবং ইউরোপের কালচার ও সভ্যতা সম্পর্কেও জেনেছিলেন তার ইউরোপীয় শিক্ষকের কাছ থেকে। সে কোরামেন্টাইনের হবু রাজা, কারণ বর্তমান রাজা অর্থাৎ ওরুনৌকোর দাদার মৃত্যুর পর সেই হবে ভবিষ্যতে কোরামেন্টিনের রাজা।
তখন কোরামেন্টাইনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ওরুনৌকো সেই যুদ্ধে যোগদান করে। যুদ্ধ চলাকালীন শত্রুপক্ষের একটি বিষাক্ত তীর ওরুনৌকোর দিকে ছুটে আসতে থাকে। আর তা দেখে তরুণ যুবরাজ ওরুনৌকোকে বাঁচাতে; সেই সেনাদলের জেনারেল ঝাঁপিয়ে পড়েন সেই বিষাক্ত তীরের সামনে। জেনারেল সেখানেই মারা যান; ওরুনৌকো ও তার দল সেই যুদ্ধে জয়লাভ করে।
যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ওরুনৌকো অনুভব করেন যিনি আমার জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন ত্যাগ করলেন তার পরিবারকে শান্তনা দেওয়া ও তাদের দেখভাল করা তার দায়িত্ব। আর তাই ওরুনৌকো জেনারেলের পরিবারের কাছে ছুটে গেলেন। জেনারেলের পরিবার বলতে ছিলো তার এক মেয়ে। মেয়েটির নাম ইমুইন্ডা। সে ছিলো খুবই সুন্দরী এক তরুণী। আফরা বেন তাকে তুলনা করেছেন ব্ল্যাক ভেনাসের সাথে।
ওরুনৌকো ইমুইন্ডাকে কে তার বাবার মৃত্যুর জন্য তাকে শান্তানা দেন এবং এক সময় তার প্রেমে পড়ে যান। ইমুইন্ডাও সুদর্শন ওরুনৌকোর প্রেমে পরে যান। তারা উভয়ের একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেন এবং তারা ভবিষ্যতে বিবাহের প্রতিশ্রুতি নেয়। ইমুইন্ডা ওরুনৌকো কে শর্ত দেয় যে সে ভবিষ্যতে আর অন্য কোনো নারীকে বিবাহ করতে পারবে না, কারন সেসময় আফ্রিকার পুরুষ বা রাজারা একাধিক বিবাহ করতো। ওরুনৌকো হাসিমুখে সেই প্রস্তাব মেনে নেয়।
সেই সময়ে কোরামেন্টিনের সেই বুড়ো রাজা; মানে ওরুনৌকোর দাদা ইমুইন্ডার সৌন্দর্যের ব্যাপারে জানতে পারেন। ইতোমধ্যে সেই রাজা অনেকগুলো বিবাহ করেছেন। সেই বৃদ্ধ রাজা ইমুইন্ডাকে রাজকীয় ওড়না পাঠানোর মাধ্যমে ইমুইন্ডাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। সে সময়ে কোনো মেয়ের পক্ষেই রাজার এই প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করা সম্ভব ছিলো না।
ইমুইন্ডাকে বুঝানো হয় ১০০ বছরের বুড়ো রাজা ইমোন্ডাকে কিছুই করতে পারবে না। আর তাই সে রাজার হারেমে থাকতে শুরু করে। এই ঘটনা জানার পর ওরুনৌকো চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ সে যাকে ভালোবাসে তার বুড়ো দাদা তাকে বিবাহ করতে চাইছে। আর সেহেতু তিনি দেশের রাজা; তার বিরুদ্ধে কথা বলাও ওরুনৌকোর পক্ষে সম্ভব না।
ওরুনৌকো তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আবোয়ান ও রাজার প্রথম স্ত্রী ওনাহোল যার বয়স ১০০ বছরের অধিক তার মাধ্যমে ইমোইন্ডার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে থাকেন। এক সময়ে ইমুইন্ডা ও ওরুনৌকো বিয়ে করে নেন এবং তারা শারিরীকভাবে একে অপরের সাথে মিলিত হন।
অন্যদিকে রাজার প্রথম স্ত্রী যাকে রাজা বহুবছর ধরে অবহেলা করে দূরে ঠেলে রাখছেন তার সাথে ওরুনৌকোর বন্ধু আবোয়ানের প্রেম ও শারিরীক সম্পর্ক হয়ে যায়।
সেসময় ওরুনৌকোর আবার যুদ্ধে যাওয়ার ডাক আসে। কারন আবারো ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ লেগেছে। ওরুনৌকো যুদ্ধে চলে যায়। আর রাজা তার নিয়োগকৃত প্রহরীর মাধ্যমে জানতে পারেন ইমুইন্ডা তার সতীত্ব হারিয়েছেন ওরুনৌকোর কাছে; আর তাতে তাকে সাহায্য করেছে তারই প্রথম স্ত্রী ওনাহল। আর তাই রাগে ক্রুদ্ধ বৃদ্ধ রাজা ওনাহেল ও ইমুইন্ডাকে দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।
ওরুনৌকো যখন যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেন তখন রাজা তাকে বলেন তারা দুজন ভয়ংকর অপরাধ করেছে আর তাই শাস্তি হিসেবে তাদের দুজনকে মৃত্যু দেওয়া হয়েছে। আর তিনি ওরুনৌকোকে এটাও বলেন যে ‘দাসত্ব থেকে মৃত্যু ভালো’। রাজা এই মিথ্যে কথা বলেছিলেন কারন তিনি ওরুনৌকো কে কিছুটা ভয় পেতেন। কারন সত্যিটা জানলে তার নাতি ওরুনৌকোই তার বিপাদের কারন হতে পারে।
ওরুনৌকো এই খবর শুনে ভেঙে পড়েন। সে সময় তিনি ও তার সঙ্গে থাকা কিছু যোদ্ধা কোরামেন্টিনে আসা একটি ইংরেজ জাহাজের থেকে খাবার ও পানীয় ভোজের আমন্ত্রণ পান। এই জাহাজটি এখানে এসেছে দাস কিনতে। কারন এখানে সবসময় যুদ্ধ লেগে থাকে আর যুদ্ধে বন্দী হওয়া ব্যক্তিদের এই ব্যবসায়ীদের কাছেই বিক্রি করা হয়। ওরুনৌকো ও তার সাথীরা সেই জাহাজে গেলে জাহাজের কাপ্তান তাদের মদ, পানীয় ও বিভিন্ন খাবার খাওয়ান। এসব খাবার খেয়ে তারা নিজেদের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আর তখন জাহাজের ক্যাপ্টেন ও ক্রুরা ওরুনৌকো ও তার সঙ্গী সাথীদের শিকল দিয়ে বন্দী করে ফেলেন।
বন্দী করার পর তাদের সকলে একটি নতুন দেশে নিয়ে আসেন। দেশটির নাম সুরিনাম; এটি ইংরেজদের স্থাপন করা সদ্য নতুন কলোনি। কাকতালীয়ভাবে রাজা ওনাহোল ও ইমুইন্ডাকে যাদের কাছে বিক্রি করেছিলেন তারা এখানেই তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করেন।
ওরুনৌকোকে ট্রেফরি নামের এক লোক কিনে নেন। ওরুনৌকোর শারিরীক সামর্থ্য, সৌন্দর্য্য বুদ্ধিমত্তা এবং পুরো ঘটনা জানার পর তিনি ওরুনৌকোর নাম দেন সিজার। কারন ওরুনৌকোর সাথে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সাথে তিনি মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। ওরুনৌকোকে ট্রেফরি নিজের ভাই হিসেবে গ্রহণ করেন।
এমনই একদিন ট্রেফরি ওরুনৌকোকে বলেন কিছুকাল আগে সে একটি সুন্দরী আফ্রিকান নারী ক্রয় করেছে। মেয়েটি খুবই সুন্দরী। সে মেয়েটের সাথে কোনে খারাপ কাজ বা আচরণ করেনি। সে কি সেই আফ্রিকান সুন্দরী মেয়েটিকে দেখতে চায় বা কাছে পেতে চায় এমন প্রস্তাব করে ওরুনৌকোকে। ওরুনৌকোও সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। ওরুনৌকো দেখতে পায় সেই মেয়েটি আর কেউ নয়। তারই প্রেমিকা ও স্ত্রী ইমুইন্ডা, ট্রেফরি যার নতুন নাম দিয়েছে ক্লেমেনি। এই সুরিনামে যে সকল দাস দাসী আসে সকলেরই আসল নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। এতে করে তারা তাদের পূর্বের পরিচয় ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে। আর তাছাড়া তাদের নামগুলোকে বারবারিয়াস মনে করা হয় এবং উচ্চারণ করাও বেশ কঠিন।
ওরুনৌকো ও ক্লেমেনি/ইমুইন্ডা এক সাথে স্বামী স্ত্রী হিসবে সুরিনামে বসবসাস করতে থাকে। তাদের দিনকাল ভালোই চলতে থাকে। সে সময়ই ইমুইন্ডা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। ওরুনৌকো ও ইমুইন্ডার চাইছিলো তাদের অনাগত সন্তান যেনো তাদের মতোই দাস হিসেবে বেড়ে না উঠে। ওরুনৌকো তার মনিব ট্রেফরিকে অনুরোধ করে যেনো তাদেরকে তাদের দেশে ফেরত যেতে দেওয়া হয়। ট্রেফরি বলে সে সুরিনামের ডপুটির কাছে এই আবেদন পেশ করবে। অনেক নিয়ম আইন ও ছলচাতুরী করে সেই প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করা হয়।
ওরুনৌকো এক দাস টুসকানের পরামর্শে সকল দাসদের নিয়ে একটি দাস বিদ্রোহ ঘটায় তাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য। সেই বিদ্রোহে ইমোইন্ডাও সমান তালে যুদ্ধ করতে থাকে। ইমুইন্ডা সে সময় একটি বিষাক্ত তীর দিয়ে সুরীনামের ডেপুটি বয়ামকে আঘাত করে। কিন্তু একজন নেটিভ মহিলা বয়ামকে সেই বিষাক্ত তীরের আঘাত থেকে সুস্থ করে তুলেন। ইতোমধ্যে দাসরা কাবু হয়ে যায় ওরুনৌকোর সহযোগী টুসকান বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং সকল দাসরা আত্মসমর্পণ করে।
ওরুনৌকো ও ইমুইন্ডা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাবার পর তারা জানতো খুব শীঘ্রই বয়াম ও তাদের দলবল তাদের ধরে ফেলবে। আর তাই ওরুনৌকো ইমুইন্ডাকে মারা যাওয়ার প্রস্তাব করে। কারণ পরবর্তী লড়াইয়ের সময়ে ওরুনৌকো মারা গেলে বা ধরা পড়ে গেলে তখন ইমুইন্ডার সাথে খুব খারাপ কিছু করা হবে।
ইমুইন্ডা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়। ওরুনৌকো ইমুইন্ডার গলায় ছুড়ি চালিয়ে দেয়। সেই মৃত্যু যেনো শান্ত ও ধীর স্থীর। যেনো ভালোবাসা ও প্রেমের কাছে মৃত্যু যন্ত্রণা কিছুই না।
ইমুইন্ডার মৃত্যুর পর ওরুনৌকো মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েন। আর ইতোমধ্যেই তাকে বয়ামের দলবল বন্দী করে নিয়ে যায়। সে সময়ে বেনিস্টার নামে বয়ামের এক লোক ওরুনৌকোকে বলে ‘তোমাকে কুকুরের মতো মারা হবে’। ওরুনৌকো জবাবে বলেন অবশেষে কোনো শেতাঙ্গ নিজেদের আসল চেহারার পরিচয় দিলো।
ওরুনৌকোর মৃত্যুটি ছিলো খুবই বিভৎস রকমের। তার পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তারপর চাবুক আঘাত করা হয়। এরপর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একে একে কেটে নেওয়া হয়। সে সময়ই ওরুনৌকো তাদের কাছে একটি পাইপপ চায় ধূমপান করার জন্য। সেই পাইপ পান করতে করতে ওরুনৌকো নিজের শাস্তি ভোগ করতে থাকে। কিন্তু ওরুনৌকোর কাছে যেনো সেই শাস্তি কিছুই নয়, কারন সে অবশেষে কষ্টের মধ্যে দিয়েই দাসত্ব থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে চলেছে। কারণ দাসত্ব থেকে মৃত্যু ভালো। ওরুনৌকোর হাত পা সব কেটে আলাদা করে ফেলা হয়। সবশেষে তার মাথা কেটে ফেলা হয় এবং ওরুনৌকো চীরতরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।